The Eyes of Darkness

অন্ধকারের চোখের পলক পড়ে না

বারো বছরের ছেলেটি কি সত্যিই দুর্ঘটনায় মৃত? না, তাকে আটকে রাখা হয়েছে গোপন গবেষণাগারে ভাইরাস নিয়ে পরীক্ষার গিনিপিগ করে? করোনা-আতঙ্কের যুগে তিরিশ বছর আগের মার্কিন থ্রিলার নিয়ে নেট-দুনিয়া তোলপাড়। টিনার সন্দেহ গাঢ় হতে থাকে। তার সঙ্গত কারণও রয়েছে। ড্যানির মৃতদেহ দেখতে পাননি তিনি। তাঁকে দেখার অনুমতি দেওয়া হয়নি।

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০২০ ০১:৫৪
Share:

মা জানতেন, পর্বতাভিযানে বেরিয়ে দুর্ঘটনায় তাঁর বারো বছরের ছেলে ড্যানি মারা গিয়েছে। দুর্ঘটনায় অবশ্য কেউই বাঁচেনি। সকলেই মৃত। ছেলের স্মৃতি— পোশাক, খেলার সরঞ্জাম— আঁকড়ে ধরেছিলেন মা। কিন্তু শোকযাপনের স্থিতি টলে যায় দু’টি ছোট্ট শব্দে, ‘নট ডেড’। ড্যানিরই ঘরে টাঙানো একটি বোর্ডে তার মৃত্যুর বছরখানেক পরে হঠাৎ ওই দু’টি শব্দ দেখতে পান টিনা। আকস্মিক ভাবে।

Advertisement

প্রথমে টিনা ভাবেন, ছেলের মৃত্যুর অভিঘাত সহ্য করতে না পেরে ঘোরের মধ্যে কখনও হয়তো নিজেই ওই কথাটা লিখেছিলেন বোর্ডে, এখন আর তিনি মনে করতে পারছেন না। কিন্তু পরবর্তী কালের ঘটনাপ্রবাহ তাঁর মনে সন্দেহ জাগায়, তা হলে কি ড্যানি দুর্ঘটনায় মারা যায়নি? রহস্যজনক ঘটনাপ্রবাহ যেন সঙ্কেত-চিহ্নের মাধ্যমে একটি বার্তাই দিতে চাইছিল, দুর্ঘটনায় ড্যানির মৃত্যু হয়নি। ‘নট ডেড’!

টিনার সন্দেহ গাঢ় হতে থাকে। তার সঙ্গত কারণও রয়েছে। ড্যানির মৃতদেহ দেখতে পাননি তিনি। তাঁকে দেখার অনুমতি দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছিল, দুর্ঘটনায় ড্যানির মৃতদেহের এমন ছিন্নভিন্ন অবস্থা হয়েছে যে তা দেখার মতো অবস্থায় নেই। কফিন-বন্দি হয়ে মাটির নীচে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল ড্যানি। সেই শোকের সঙ্গে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে ওঠা, তাকে ভুলতে চাওয়ার ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া টিনা অদ্ভুত সব ঘটনায় আবারও থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন ড্যানির মৃত্যুফলকের সামনে। এ বার শুধু থমকে দাঁড়ানোই নয়। চাপা পড়ে থাকা সত্যের অন্বেষণে বার হন টিনা, সঙ্গী-প্রেমিক এলিয়ট স্ট্রাইকারকে সঙ্গে নিয়ে। শেষ পর্যন্ত জানতে পারেন, তাঁর অনুমানই ঠিক। ড্যানি মারা যায়নি। দুর্ঘটনার গল্পটাও বানানো, সত্যিটাকে চাপা দেওয়ার জন্য। ড্যানিকে মার্কিন সিক্রেট সার্ভিসের এক শাখার— যাদের খাতায়-কলমে কোনও অস্তিত্বই নেই— এক সামরিক গবেষণাগারে আটকে রাখা হয়েছে। কারণ, সে এক জৈব-অস্ত্রের সংক্রমণের শিকার। আশ্চর্যজনক ভাবে ড্যানির সঙ্গে পর্বতাভিযানে বেরনো অন্য সবাই যখন একই জৈব-অস্ত্রের সংক্রমণে মৃত, তখন ড্যানির শরীরে তৈরি হওয়া নিজস্ব অ্যান্টিবডির কারণেই সে মারা যায়নি। এখন কী ভাবে সেই অ্যান্টিবডি তার শরীরে তৈরি হয়েছে, তা কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা যায় কি না, তৈরি করা গেলে কখনও শত্রু দেশের জৈব-অস্ত্রের আক্রমণের মুখে তা দিয়ে মোকাবিলা করা যাবে কি না, এমন সব প্রশ্নের উত্তর পেতেই ড্যানিকে ‘গিনিপিগ’ করে ওই গবেষণাগারে আটকে রাখা হয়েছে। ড্যানিকে শেষে ওই সামরিক গবেষণাগার থেকে উদ্ধার করেন টিনা।

Advertisement

১৯৮১ সালে প্রকাশিত, মার্কিন লেখক ডিন কুনৎজ-এর লেখা ‘দি আইজ় অব ডার্কনেস’ নামক রহস্য-থ্রিলারটির গল্পের কাঠামো মোটামুটি এ রকম। তথ্য বলছে, কুনৎজ-এর লেখা ৫৮টি বই ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর বেস্টসেলার তালিকায় ছিল। তার মধ্যে ১৫টি বই ছিল তালিকার শীর্ষে। ৩৮টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর বই। সম্প্রতি করোনাভাইরাসের প্রেক্ষাপটে ‘দি আইজ় অব ডার্কনেস’-এর কথা বার বার উঠে আসছে সামাজিক মাধ্যম-সহ সাহিত্য-সমালোচক ও সংবাদমাধ্যমের একাংশের আলোচনায়।

আলোচনার সূত্রপাত গত মাসে ড্যারেন প্লাইমাউথ নামে এক জনের করা একটি টুইট থেকে। টুইটে এই রহস্য-থ্রিলারের ৩৯ নম্বর পর্বের কিছু পৃষ্ঠা তুলে বলা হয়, এই উপন্যাসেই প্রথম করোনাভাইরাসের পূর্বাভাস ছিল। কারণ, ড্যানি যে জৈব-অস্ত্রের দ্বারা সংক্রামিত হয়েছিল, সেই ভাইরাসের নাম ছিল ‘উহান-৪০০’। ওই ভাইরাসকে ‘বায়োলজিক্যাল ওয়েপন’ বা জৈব-অস্ত্রের কার্যক্রমের কর্মসূচি হিসেবে নিজেদের গবেষণাগারে তৈরি করেছিল চিন। টুইটারে উপন্যাসের কিছু অংশ লাল কালি দিয়ে চিহ্নিত করে দেখানো হয়, ওই অংশে লেখা— ‘তারা (সামরিক বাহিনী) এর নাম দেয় ‘উহান-৪০০’, কারণ উহান শহরের অদূরেই তাদের আরডিএনএ গবেষণাগারে এটি তৈরি করা হয়েছিল।’ ‘উহান-৪০০’-র নামের কারণেই টুইটটি ভাইরাল হয়ে যায়।

শুরু হয় তর্ক, পাল্টা তর্ক। কারণ, বাস্তবে করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থলও চিনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানের একটি বাজার। একটা অংশের আবার দাবি, উপন্যাসে উল্লিখিত ওই ‘আরডিএনএ ল্যাব’ হল আসলে ‘উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি’, যা করোনাভাইরাসের উৎপত্তির কেন্দ্রস্থল থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে। রহস্য-থ্রিলার বা সায়েন্স-ফিকশন-এর কোনও ঘটনার সঙ্গে পরবর্তী কালে বাস্তবের ঘটনা মিলে গিয়েছে, এমন বহু উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের মতো বিশ্বব্যাপী এক জরুরি অবস্থায় পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠেছে, যখন মার্কিন সেনেটরদের একাংশ উপন্যাসের কাহিনি-কাঠামোর ধাঁচেই প্রশ্ন তুলছেন, চিন কি সত্যিই জৈব-অস্ত্র নিয়ে কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিল? পরীক্ষায় কোনও ফাঁক থাকার কারণেই কি এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে? না কি সচেতন ভাবেই তাকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে? এই ভাইরাসকে ‘উহান ভাইরাস’ও বলছেন অনেকে। যাতে স্বভাবতই ক্ষুব্ধ চিন বিদেশমন্ত্রক।

এখানেই অবশ্য শেষ নয়। উপন্যাসের ৩৯তম পর্বে এও লেখা হয়েছে, এই ‘উহান ৪০০’ ভাইরাস তৈরি হয়েছে কোনও শহর বা কোনও দেশকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জন্য, এবং ওই ভাইরাসের আধার একমাত্র মানবশরীর। মানবশরীরের বাইরে সে বাঁচতে পারে না। কোনও ভাবে কেউ এই ভাইরাসের দ্বারা সংক্রামিত হলে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে ‘আইসোলেশন চেম্বার’-এ রাখতে হবে। সংক্রমণের মাত্রা নিরাময়যোগ্য হলে তাঁর চিকিৎসা করা হবে। না হলে ওই চেম্বারেই যাতে তাঁর মৃত্যু হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এর সঙ্গে করোনাভাইরাসের চরিত্রগত মিলও খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে। করোনাভাইরাসও মানুষের স্পর্শ বা হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। তাই সংক্রমণের শিকার রোগীকে সকলের থেকে আলাদা করে রাখতে বলছেন চিকিৎসকেরা। শুধু তা-ই নয়, তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে করোনাভাইরাস নিষ্ক্রিয় হওয়ার যে তত্ত্ব উঠে আসছে (যদিও তার বাস্তব ভিত্তি নেই), তার পিছনেও কুনৎজ-এর উপন্যাসের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন অনেকে। কারণ, উপন্যাসের এক জায়গায় লেখা হয়েছে, তাপমাত্রা ৮৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি হলে এই ভাইরাস আর সক্রিয় থাকতে পারে না।

আজকের করোনা-আক্রান্ত পৃথিবীতে এই উপন্যাসের প্রভাব যে কী বিপুল! পেরুর নোবেলজয়ী লেখক মারিও ভার্গাস ইয়োসা সম্প্রতি লিখেছিলেন, এই ভাইরাস চিন থেকে ছড়িয়েছে। চিনের গণতন্ত্রহীন রাজনীতিই এ জন্য দায়ী। যে স্থানীয় চিকিৎসকেরা ভাইরাস প্রতিরোধে কাজ করছিলেন, চিন তাঁদের কণ্ঠরোধ করেছে।

চিন সঙ্গে সঙ্গে ৮৩ বছরের নোবেলজয়ী লেখকের কথার প্রতিবাদ জানিয়েছে।

ভার্গাস ইয়োসা অবশ্যই দক্ষিণপন্থী হিসেবে খ্যাত। কিন্তু কুনৎজ-এর উপন্যাসের ‘কনস্পিরেসি থিয়োরি’-তে কি শুধু তিনিই মগ্ন? চিনা বিদেশমন্ত্রকের এক কর্তা ঝাও লিজান টুইট করে জানিয়েছেন, আমেরিকাই এই ভাইরাসের স্রষ্টা। তারাই গোপনে এটি চিনে ছড়িয়েছে। একটি মহামারি, ভাইরাস ও চক্রান্ত-তত্ত্ব নিয়ে এত চাপান-উতোর এর আগে বিশেষ ঘটেনি।

কুনৎজ-এর উপন্যাসের প্রথম প্রকাশের সময়টা তাই ভাবতে হবে। ১৯৮১। তার কয়েক বছর আগে জৈব-অস্ত্র তৈরি, উৎপাদন এবং মজুত করে রাখার বিরুদ্ধে এবং এ রকম অস্ত্র ধ্বংসের জন্য ‘বায়োলজিক্যাল অ্যান্ড টক্সিন ওয়েপনস কনভেনশন’ বা ‘বিটিডব্লিউসি’ চুক্তির সূত্রপাত হয় আন্তর্জাতিক স্তরে। সেই চুক্তি কার্যকর হয়েছে ১৯৭৫ সাল থেকে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সামরিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞ, সকলেই একটি ব্যাপারে একমত। পরমাণু বোমা নয়, নিঃশব্দ ঘাতক হিসেবে বিশ্বের কাছে বর্তমানে অন্যতম বিপদই হল জৈব-অস্ত্র।

বিটিডব্লিউসি চুক্তি কি জৈব-অস্ত্র উৎপাদনের আশঙ্কা নির্মূল করতে পেরেছে? বিশেষজ্ঞদের একাংশ এ বিষয়ে নিশ্চিত নন। কারণ চুক্তি হলেও সত্যিই জৈব-অস্ত্র তৈরি হচ্ছে কি না তা পরীক্ষা করার সুযোগ সীমিত, ফলে বাস্তবে সংশয় রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও নিজেদের প্রস্তাবনায় জৈব-অস্ত্র নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল আগেই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, জৈব-অস্ত্র হল মাইক্রোঅর্গানিজ়ম যেমন ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়া বা অন্য কোনও বিষাক্ত পদার্থ যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে মানুষ, প্রাণিজগৎ, উদ্ভিদজগতের শারীরিক ক্ষতি ও বিনাশের জন্য ব্যবহার হয়। ‘বায়োলজিক্যাল এজেন্ট’ যেমন অ্যানথ্রাক্স, বটুলিয়াম টক্সিন বা প্লেগের কারণে অল্প সময়ে অনেক বেশি সংখ্যক প্রাণীর মৃত্যু হতে পারে। এ ধরনের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণও সহজ কাজ নয়। উল্লেখযোগ্য ভাবে বিটিডব্লিউসি চুক্তিতে সই করা দেশের সংখ্যা বাড়লেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘বায়োলজিক্যাল ওয়েপন’-এর প্রস্তাবনায় জৈব সন্ত্রাসের বিষয়টি মুছে ফেলছে না বা অস্বীকারও করছে না। বরং বলছে, জৈব-সন্ত্রাসে ইবোলা বা অন্য ভাইরাসের মতো ‘বায়োলজিক্যাল এজেন্ট’ ব্যবহার করে মহামারি ছড়ানো যেতে পারে এবং এ ধরনের জৈব-সন্ত্রাসের আশঙ্কা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

সেই আশঙ্কার কথাই উঠে এসেছে ‘দি আইজ় অব ডার্কনেস’-এও। যেখানে এলিয়টের প্রশ্নের উত্তরে কার্ল ডম্বি নামে এক গবেষক জানাচ্ছেন, প্রকাশ্যে জৈব-অস্ত্র তৈরি বন্ধ বলা হলেও শত্রুপক্ষ কখনও জৈব-অস্ত্র দিয়ে হামলা চালালে কী ভাবে তার উচিত জবাব দেওয়া যাবে, সে জন্য আমেরিকা-সহ অন্য বহু দেশের গবেষণাগারেই এই অস্ত্র নিয়ে গোপনে গবেষণা চলছে। চিন, রাশিয়া, ইরাক, লিবিয়া-সহ একাধিক দেশে জৈব-অস্ত্র তৈরির গবেষণাগার রয়েছে। ‘‘হয়তো আরও কোথাও কোথাও রয়েছে, আমরা জানি না’’, উপন্যাসে বলছেন ডম্বি।

কিন্তু আন্তর্জাতিক মহল বা কোনও দেশের মুখপাত্র আনুষ্ঠানিক ভাবে করোনাভাইরাসকে এখনও পর্যন্ত জৈব-অস্ত্র হিসেবে ঘোষণা করেননি। অনেকে বরং ‘উহান ৪০০’ ভাইরাসের উল্লেখের পিছনে আ‌লাদা অভিসন্ধি দেখতে পাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞদের একাংশ জানাচ্ছেন, যে কোনও জরুরি অবস্থার সময় বিরোধী দেশের দিকে আঙুল তোলা বা অভিযোগের রীতি নতুন নয়। সাহিত্য, সিনেমা-সহ বহু মাধ্যমেই এই রীতি চলে এসেছে। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, মার্কিন সাহিত্যিকের লেখা ‘দি আইজ় অব ডার্কনেস’ ১৯৮১ সালে যখন বেরোয়, তখন ভাইরাসটির নাম ছিল ‘গোর্কি ৪০০’, যা রাশিয়ার একটি অঞ্চলের নাম। পরে কুনৎজ যখন পরিমার্জনা করে ১৯৮৯ সালে উপন্যাসটি প্রকাশ করেন, তখন তার নাম হয় ‘উহান ৪০০’। বইটির নামের তলায়ও লেখা রয়েছে, প্রথম প্রকাশকালে, অর্থাৎ ১৯৮১ সালে বইটির লেখকের নাম ছিল লেই নিকোলস, যা কুনৎজ-এরই ছদ্মনাম। পরবর্তী কালে সংযোজন-সংশোধনের পরে প্রকাশিত সংস্করণে নিজের স্ত্রীকে বইটি উৎসর্গ করে কুনৎজ লিখেছিলেন, ‘আমি নিজেকে উন্নত করতে চাইছি। তার জন্য যা করা প্রয়োজন, সবই করছি।’ লেখকের নিজেকে উন্নত করার ওই চেষ্টার সঙ্গে তখনকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের রসায়নও মিশে গিয়েছিল। কুনৎজ নিজে ওই সংস্করণের শেষে লিখেছিলেন, ‘আমি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বেশ কিছু প্রেক্ষিতের নবতর সংযোজন করেছি।’ সেই নবতর সংযোজনের হাত ধরেই রাশিয়ার ‘গোর্কি’র পরিবর্তে চিনের ‘উহান’-এর নাম কুনৎজ উল্লেখ করেছিলেন বলে অনুমান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশের। এক বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘মনে রাখতে হবে, ’৮০-র দশক থেকে সোভিয়েট ইউনিয়নের রাজনীতিতে টালমাটাল অবস্থা শুরু হয়েছিল, যা চূড়ান্ত রূপ পায় ১৯৯১ সালে সোভিয়েট ইউনিয়নের ভাঙনের মাধ্যমে। আবার ওই আশির দশক থেকেই নিজস্ব অভ্যন্তরীণ টালমাটাল কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে আস্তে-আস্তে নিজেদের অস্তিত্ব বোঝাতে শুরু করেছিল চিন। ফলে আমেরিকার এক লেখক যদি এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাশিয়ার পরিবর্তে সম্ভাব্য অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে চিনকে বেছে নেন এবং সেই সূত্রেই ভাইরাসের নাম ‘গোর্কি ৪০০’ থেকে ‘উহান ৪০০’ করে থাকেন, আশ্চর্যের কিছু নেই!’’

অবশ্যই! উপন্যাসেও পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির ইঙ্গিত রয়েছে কার্ল ডম্বি নামক বিজ্ঞানীর কথায়, ‘'রাশিয়া... এখন তো তারা আমাদের নতুন বন্ধু।’’

নেট-গুজবে যাই হোক না কেন, করোনাভাইরাসের সঙ্গে জৈব-সন্ত্রাসের অভিযোগকে চিন তো বটেই, পশ্চিমি দেশগুলোও উড়িয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে করোনা না হলেও জৈব-অস্ত্রের বিপদ যে ওত পেতে বসে রয়েছে, সে প্রসঙ্গ ‘দি আইজ় অব ডার্কনেস’-কে নিয়ে চলতে থাকা বিতর্কে আরও এক বার উঠে এসেছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ইমনকল্যাণ লাহিড়ী অবশ্য এ বিষয়ে বলছেন, ‘‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কন্সপিরেসি থিয়োরি নতুন কিছু নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে ঔপনিবেশিক আমল, সব ক্ষেত্রেই বিশেষ কোনও জীবাণু ছড়িয়ে শত্রুপক্ষকে দুর্বল করার রীতি ছিল। বিশেষ করে কৌশলে প্লেগ ছড়িয়ে শত্রুদের দুর্বল করার নিদর্শন তো রয়েছেই। কিন্তু করোনাভাইরাসও সেই জৈব-অস্ত্র বা সন্ত্রাসের একটি অনুঘটক, তা বলাটা ঠিক হবে না। আন্তর্জাতিক স্তরের পরীক্ষা বা তদন্ত ছাড়া সেটা বলা উচিতও নয়।’’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, ২০ মার্চ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আড়াই লক্ষেরও বেশি। মারা গিয়েছেন দশ হাজারেরও বেশি মানুষ। ভারতের মতো দেশে আক্রান্তের সংখ্যা দুশো ছাড়িয়ে গিয়েছে। ১৩৪টি দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে এবং প্রতিনিয়ত এই সংখ্যাগুলি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সুবর্ণ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, প্রায় ১০২ বছর আগে, সেই ১৯১৮ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যখন স্প্যানিশ ফ্লু হয়েছিল, তখন তা মহামারির আকার ধারণ করেছিল। ‘‘কিন্তু যে হারে, যে গতিতে করোনাভাইরাস সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে, তা ১৯১৮ সালে হয়নি। অবশ্য তখন এই গতিতে ছড়িয়ে পড়াটা সম্ভবও ছিল না। কারণ, যোগাযোগের এই উন্নততর মাধ্যমই তো ছিল না,’’ বলছেন তিনি।

আধুনিক বিশ্বের ভরকেন্দ্র জুড়ে যে যোগাযোগ ব্যবস্থা, তাতেই আঘাত হেনেছে করোনাভাইরাস। যার সূত্র ধরে বিশ্বের অর্থনৈতিক বাজারও তলানিতে এসে ঠেকেছে। জীবনের এমন কোনও ক্ষেত্র নেই, যেখানে করোনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়েনি। ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে যাপনের পরিধি। তার মধ্যেই কুনৎজ বা অন্য কোনও লেখকের উপন্যাস বা কারও ভবিষ্যদ্বাণী করোনাভাইরাস সম্পর্কে পূর্বাভাস দিয়েছিল কি না, সে বিতর্ক চলছে নিরন্তর। সেই বিতর্কের মধ্যেই অনেকে আবার ‘উহান ৪০০’ ভাইরাসের অংশটুকু নয়, বরং ‘দি আইজ় অব ডার্কনেস’-এর একেবারে শেষ পরিচ্ছেদটুকু মনে করিয়ে দিচ্ছেন। যেখানে লেখা হয়েছে— ‘প্রতিটি জিনিসের নির্দিষ্ট সময় থাকে। টিনা নিজের মনে মনে বললেন। যেমন মৃত্যুর সময় থাকে, তেমন নিরাময়েরও সময় থাকে। ড্যানিকে আরও শক্ত করে নিজের কাছে চেপে ধরলেন তিনি... ড্যানি এখনও তাঁর কাছে ছোট্ট, আদরের সন্তান।— পরিবর্তন এসেছে। ভবিষ্যতের দিনগুলোর কথা ভাবতে লাগলেন টিনা। তাঁদের জন্য আগামী দিনে কী অপেক্ষা করতে পারে, ভেবে বিস্মিত হলেন।’

এই অংশটুকু মনে করিয়ে দিয়ে কুনৎজপ্রেমী পাঠকদের প্রশ্ন, এই আতঙ্কের মুহূর্তে সারা বিশ্ব যে রকম অভূতপূর্ব ভাবে একজোট হয়েছে, তা কেন আলোচনার মধ্যে আসছে না? করোনাভাইরাসের প্রবল আগ্রাসী থাবা যেমন সত্য, তেমনই সত্য—আতঙ্কের সমাধানসূত্র বার করার জন্য সমস্ত দেশের প্রচেষ্টা। ‘নিরাময় সময়’ বা নিরাময়-স্পর্শের জন্য এই যে সমবেত প্রয়াস, তা উপেক্ষা করারও উপায় নেই। সমবেত এই চেষ্টাই হয়তো ‘অন্ধকারের চোখ’-এর গণ্ডি ডিঙিয়ে এই দুনিয়াকে আলোর দিকে নিয়ে যাবে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement