সুলেখক: সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন বহু ভাষায় পারদর্শী
সৈয়দ মুজতবা আলী বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পড়তে যান ১৯২৯ সালে। সেখানে এক দিন তিনি ‘ফোনেটিক ইনস্টিটিউট’-এর বক্তৃতাগৃহে উপস্থিত হন। হলঘরে তখন বক্তৃতা শুরু হতে দেরি নেই। চার দিকে ভারতীয় কেউ নেই দেখে তিনি ভয়ে ভয়ে বসে পড়লেন। প্রফেসর বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, “আজকের বক্তৃতা ফোনেটিক বিজ্ঞানের অবতরণিকা। নানা ভাষায় নানা দেশের লোকের নানা উচ্চারণ আজ শোনানো হবে।” ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিয়ে দেয়ালে ম্যাজিক ল্যান্টার্নের ছবি ফেলা হল।… রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!
সঙ্গে সঙ্গে কলের গানে বেজে উঠল সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর। অন্ধকার ঘরে রবীন্দ্রনাথের ঋজুদীর্ঘ অবয়বের উদ্ভাসিত প্রতিচ্ছবি। কণ্ঠস্বর রবীন্দ্রনাথের— ‘শৃন্বন্তু বিশ্বে’— ভারতবর্ষের সেই চিরন্তন বাণী।
অধ্যাপক বললেন, এমন গলা, ঠিক জায়গায় জোর দিয়ে অর্থ প্রকাশ করার এমন ক্ষমতা শুধু প্রাচ্যেই সম্ভব। পূর্বদেশে মানুষ শব্দব্রহ্মে বিশ্বাস করে। রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বরে তাঁরই পূর্ণতম অভিব্যক্তি। কণ্ঠের এমন মাধুর্য, বাক্যের এমন ওজস্বিতা পশ্চিমে হয় না।
গর্বে তাঁর বুক ভরে উঠল। তিনি মাথা উঁচু করে বসে ভাবছিলেন, “আমার গুরুদেব ভারতবর্ষের, আমিও ভারতবাসী।... আমার চিন্তা অনুভূতির জগতে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সবচেয়ে বেশি।”
আর সেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রথম দেখা হয় ১৯১৯ সালে, রবীন্দ্রনাথ যখন সিলেটে আসেন। ছাত্রদের ‘আকাঙ্ক্ষা’ সম্বন্ধে বক্তৃতা দেন। মুজতবা আলীর বয়স তখন চোদ্দো বছর। বক্তৃতা শুনে তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে চিঠি লিখে জানতে চাইলেন, “আকাঙ্ক্ষা উচ্চ করতে হলে কী করা প্রয়োজন?” সিলেট সফর শেষ করে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন আগরতলায়। সপ্তাহখানেক পরেই কবির কাছ থেকে চিঠির উত্তর পেলেন কিশোর মুজতবা। দশ-বারো লাইনের এই চিঠির মর্ম ছিল, “আকাঙ্ক্ষা উচ্চ করিতে হইবে— এই কথাটার মোটামুটি অর্থ এই— স্বার্থই যেন মানুষের কাম্য না হয়। দেশের মঙ্গলের জন্য ও জনসেবার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ কামনাই মানুষকে কল্যাণের পথে নিয়ে যায়। তোমার পক্ষে কী করা উচিত তা এত দূর থেকে বলে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে তোমার অন্তরের শুভেচ্ছাই তোমাকে কল্যাণের পথে নিয়ে যাবে।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই চিঠি কিশোর মুজতবার মনে গভীর আবেদন সৃষ্টি করেছিল। শুধু তাঁর মনেই নয়, এক ধরনের চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল তাঁর পরিবারেও। মুজতবা পরে শান্তিনিকেতনে পড়বার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন পিতার কাছে। তখন বিশ্বভারতী সবেমাত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শান্তিনিকেতনে পড়তে যান সৈয়দ মুজতবা আলী।
পৌষ সংখ্যা ‘শান্তিনিকেতন’-এ একটি উল্লেখযোগ্য সংবাদ বেরোয়: ‘বৎসরের প্রারম্ভে অনেক নূতন ছাত্র আসিতেছে। ইহার মধ্যে একটি খৃষ্টান ও একটি মুসলমান বালক ভর্ত্তি হইয়াছে। উক্ত মুসলমান ছাত্রটি হচ্ছেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক ‘সৈয়দ মুজতবা আলী’, ১৯১৯-এ শ্রীহট্টে রবীন্দ্রনাথকে দেখে অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে স্কুল ছেড়ে তিনি বিশ্বভারতীতে এসে যোগ দেন।’
রবীন্দ্রনাথ প্রথম দেখায় তাঁকে বলেছিলেন, ‘ওহে, তোমার মুখ থেকে তো কমলালেবুর গন্ধ বেরোচ্ছে!’
আসলে মুজতবা আলী ছিলেন শ্রীহট্ট তথা সিলেটের বাসিন্দা। আর সিলেট কমলালেবুর জন্য বিখ্যাত। সে কারণেই এমন সম্ভাষণ। তার পর গুরুদেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী পড়তে চাও?’
তিনি বললেন, ‘তা তো ঠিক জানিনে, তবে কোনও একটা জিনিস খুব ভালো করে শিখতে চাই।’
গুরুদেব বললেন, ‘নানা জিনিস শিখতে আপত্তি কী?’
মুজতবা বললেন, ‘মনকে চারিদিকে ছড়িয়ে দিলে কোনো জিনিস বোধহয় ভালো করে শেখা যায় না।’
গুরুদেব বললেন, ‘কে বলেছে?’
মুজতবা থতমত খেয়ে বললেন, ‘কনান ডয়েল।’
রবীন্দ্রনাথ মুজতবাদের শেলি, কিটস আর বলাকা পড়াতেন।
বিশ্বভারতীতে মুজতবা আলী এক বার রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা নকল করে ভুয়ো নোটিস দিয়েছিলেন, “আজ ক্লাশ ছুটি”... সবাই মনে করেছিল রবীন্দ্রনাথই ছুটি দিয়ে দিয়েছেন!
শান্তিনিকেতন মুজতবাকে জ্ঞান ও দীক্ষার এমন এক বহুত্বের দিকে ঠেলে দিল যে, তিনি পদে পদে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে লাগলেন।
এক এক করে ভাষা শিখতে শুরু করলেন জার্মান, ফরাসি, ইংরেজি ও হিন্দি। রুশ প্রাচ্যবিদ পণ্ডিত বোগদানোফের কাছে শিখতে লাগলেন আরবি ও ফারসি। সংস্কৃত, সাংখ্য ও বেদান্ত শিখলেন ফরমিকি এবং বিধুশেখর শাস্ত্রীর কাছে। ড. মার্ক কলিন্সের কাছে ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান। তুচ্চির কাছে ইটালিয়ান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ কবিতা এবং ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ প্রবন্ধ তাঁর মুখস্থ ছিল।
১৯২৩ সালে প্রমথনাথ বিশীর সভাপতিত্বে বিশ্বভারতীর বার্ষিক অধিবেশনে কার্যনির্বাহী সমিতিতে সৈয়দ মুজতবা আলী সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯২৭ সালে নন্দলাল বসু অঙ্কিত এবং কবিগুরুর স্বাক্ষরিত ‘স্নাতক’ শংসাপত্র নিয়ে পাড়ি দেন বিদেশে। ১৯৩১ সালে গুরুদেবের সঙ্গে সৈয়দ মুজতবা আলীর শেষ দেখা শান্তিনিকেতনে। গুরুদেব সে দিন মুজতবাকে বললেন, ‘লোকটি যে বড় চেনা চেনা ঠেকছে। তুই নাকি বরোদায় মহারাজা হয়ে গেছিস?’
মুজতবা আপত্তি জানালেন না। আপত্তি জানালে গুরুদেব প্রমাণ করে ছাড়তেন, তিনিই বরোদার মহারাজা, নয়তো কিছু একটা জাঁদরেল গোছের। গুরুদেব ফের বললেন, ‘মহারাজা নয়, দেওয়ান টেওয়ান কিছু একটা।’
মুজতবা তখনও চুপ। গুরুদেব ফের বললেন, ‘তুই এখনও বরোদা কলেজে ধর্মশাস্ত্র পড়াস না?’
মুজতবা জানতেন, গুরুদেব ঠিক জানেন শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্রেরা কে কী করে। তাই মহারাজা বা দেওয়ান আখ্যায় আপত্তি জানাননি।
তার পর কবি বললেন, ‘জানিস, তোদের যখন রাজা মহারাজারা ডেকে নিয়ে সম্মান দেখায় তখন আমার কি গর্ব হয়, আমার কি আনন্দ হয়। আমার ছেলেরা দেশে বিদেশে কৃতী হয়েছে।’ তার পর আপনমনে খানিকক্ষণ কি ভেবে বললেন, ‘কিন্তু জানিস, আমার মনে দুঃখও হয়। তোদের আমি গড়ে তুলেছি, এখন আমার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য তোদের প্রয়োজন। গোখলে, শুক্ল, তোরা সব এখানে থেকে আমাকে সাহায্য করবি। কিন্তু তোদের আনবার সামর্থ্য আমার কোথায়?... তা যাক। বলতে পারিস সেই মহাপুরুষ কবে আসছেন কাঁচি হাতে করে?’
মুজতবা অবাক, ‘মহাপুরুষ...কাঁচি হাতে করে?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ কাঁচি নিয়ে। সেই কাঁচি দিয়ে সামনের দাড়ি ছেঁটে দেবেন, পেছনের টিকি কেটে দেবেন। হিন্দু মুসলমান আর কতদিন এরকম আলাদা হয়ে থাকবে!’
মুজতবা বললেন, ‘একটা কথা বলতে চাই যদি কিছু মনে না করেন।’
‘বল, বল, ভয় কি?’
মুজতবা বললেন, ‘এই যে আপনি বললেন, আপনার সামর্থ্য নেই আমাদের এখানে নিয়ে আসবার, সেই সম্পর্কে আমি শুধু আমার নিজের তরফ থেকে বলছি যে, বিশ্বভারতীর সেবার জন্য যদি আমাকে প্রয়োজন হয় তবে ডাকলেই আসব। যা দেবেন হাত পেতে নেব।’
সে কথা রেখেছিলেন মুজতবা এবং ফিরে এসেছিলেন। ১৯৬১-র ১৮ অগস্ট ইসলামের ইতিহাস পড়ানোর কাজে যোগ দেন, থাকতেন ৪৫ পল্লির কোয়ার্টারে। লিখেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথকে সে-ভাবে দেখবার মত মনীষী এখনও এ জগতে আসেননি... বড় বাসনা ছিল, মৃত্যুর পূর্বে তাঁর বিশ্বরূপটি দেখে যাই...”