শব্দটি চেনা ছিল না দু’দশক আগেও। ঘোড়দৌড়ের উদ্দীপনার আঁচ ধার করে তুমুল উত্তেজনার ফুটবল ম্যাচগুলোর এই নাম দেওয়া হল। তার পর থেকে কলকাতায় ইস্টবেঙ্গলের-মোহনবাগানের দ্বৈরথ মানেই ডার্বি ।
SC East Bengal

Kolkata Derby: শতবর্ষে কলকাতা ডার্বি

শতবর্ষ আগে ১৯২১ সালে প্রথম বার লড়ে দুই প্রতিপক্ষ। সেই প্রসঙ্গে ফুটবলারদের নানা স্বপ্নপূরণ কিংবা স্বপ্নভঙ্গের স্মৃতি-কোলাজ।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২১ ০৭:৩১
Share:

২০১৭ সালে সল্টলেক স্টেডিয়ামে আই লিগের খেলায় ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের মুখোমুখি হওয়ার মুহূর্ত।

কোভিড আবহে প্রায় নিঃশব্দে পেরিয়ে যাচ্ছে বাঙালির এক আবেগের শতবর্ষ। র‌্যাম্পার্টে দাঁড়িয়ে লাল-হলুদ, সবুজ-মেরুনের বেদনা-উল্লাস, ইলিশ-চিংড়ির দ্বৈরথ, পালতোলা নৌকা-মশালের শোভাযাত্রা, মাউন্টেড পুলিশের তাড়া, রাত জেগে টিকিট না পেয়ে গ্যালারি টপকে ঝুঁকি নিয়ে মাঠে ঢোকা, প্রিয় দলের পরাজয়ে তীব্র হতাশা, পদপিষ্ট হয়ে সমর্থকদের জীবন সংশয়, সাহিত্যে সঙ্গীতে চলচ্চিত্রে স্থান করে নেওয়া ঘটি-বাঙালের দ্বন্দ্বযুদ্ধের অসংখ্য চিত্র বাঙালি মননে তৈরি হয়েছে একশো বছর ধরে। ১৯২১ সালের ৮ অগস্ট কোচবিহার কাপে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূচনা হয়েছিল, সেটাই পরবর্তী পর্যায়ে দেশের সেরা লড়াইয়ে উন্নীত হয়। ক্রমশ ঘোড়দৌড়ের উত্তেজনার আঁচ ধার করে এই দুই দলের বড় ম্যাচ হয়ে উঠেছে ‘ডার্বি’। বছর কুড়ি আগেও ‘ডার্বি’ শব্দের ব্যবহার শোনা যায়নি। ১৯৯৭-এর ফেড কাপ সেমিফাইনালের ‘মহারণ’ নামে খ্যাত ম্যাচটিও ‘ডার্বি’ আখ্যা পায়নি। সম্ভবত ই পি এল, লা-লিগা, সিরি-এ, বুন্দেশলিগা থেকে ডার্বি কথাটির উৎপত্তি। লাজিও-রোমা, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড-ম্যাঞ্চেস্টার সিটি, আটলেটিকো মাদ্রিদ-রিয়াল মাদ্রিদ-এর তুমুল উত্তেজনার ম্যাচগুলির মতো ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচটিও ডার্বির মর্যাদা পেয়ে যায়।

Advertisement

এই ডার্বির মর্যাদা এমনই যে, এক ম্যাচেই এক জন ফুটবলার বা কোচ রাতারাতি হিরো কিংবা ভিলেন হয়ে যেতে পারেন। ক্লাব যদি টুর্নামেন্টের সপ্তমেও থাকে, ডার্বি জিতলে সমর্থকরা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দ পালন করেন। যেমন, ১৯৯৭ সালের ফেডারেশন কাপের ফাইনালে সালগাঁওকরের কাছে হেরে ট্রোফি না পাওয়ার দুঃখ ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা ভুলে যায় সেমিফাইনালে ডার্বি জয়ের আনন্দে। ১৯৬৭-তে ইডেনে কলকাতা ফুটবল লিগের ডার্বিতে জিতলেও চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি মোহনবাগান। আফসোস হলেও হতাশ হননি সদস্যরা।

এই দুই দলের প্রদর্শনী ম্যাচের গুরুত্ব যে কোনও বড় ম্যাচের চেয়ে বেশি। পরিসংখ্যান বলছে, গত ১০০ বছরে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের বছরে সাক্ষাৎ হয়েছে ৩৭৩ বার। ইস্টবেঙ্গল জিতেছে ১২৯ বার। মোহনবাগান জিতেছে ১২২ বার। খেলা অমীমাংসিত থেকেছে ১২২ বার। দেশে-বিদেশে ইস্টবেঙ্গলের প্রাপ্তি ১২৯টি ট্রোফি, মোহনবাগানের ১০১টি।

Advertisement

মোহনবাগানের ৩৩ বছর পর ইস্টবেঙ্গলের জন্ম। বাঙাল বলে নসা সেন এবং শৈলেশ বসু জোড়াবাগান ক্লাব থেকে বাদ পড়েন। সেই রাগে কয়েক জন পুব বাংলা থেকে আসা মানুষ ১ অগস্ট ১৯২০-তে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। যে কোচবিহার কাপের দল থেকে তাদের বাদ দেওয়া হয়েছিল, পরের বছর ১৯২১-এর ৮ অগস্ট সেই কাপেরই সেমিফাইনালে আজকের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগানের মুখোমুখি হয় তারা। ম্যাচ গোলশূন্য থাকার পর রিপ্লেতে মোহনবাগান জিতে যায় ৩-০ ব্যবধানে। এই বছরই খগেন্দ্রনাথ শিল্ড ফাইনালে প্রবল লড়াইয়ে ইস্টবেঙ্গল ২-১’এ ছিনিয়ে নেয় ট্রোফি। জয়-পরাজয়ে ১৯২১-এ ইতিহাস জন্ম দেয় আজকের দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের ‘ডার্বি’ ম্যাচের।

গত একশো বছরে গঙ্গাপারের দুই ক্লাব পেরিয়ে এসেছে গৌরব ও গ্লানির বহু অধ্যায়। শুরুতে মোহনবাগানের দাপট থাকলেও ক্রমশ তাদের সাফল্যে থাবা বসাতে শুরু করে ইস্টবেঙ্গল। ১৯৩৯-এর কলকাতা লিগ জয়ের সূচনা মোহনবাগানের। ইস্টবেঙ্গল লিগ জয়ের প্রথম স্বাদ পায় ১৯৪২ সালে। পরের চার বছর লিগের শিরোপা দু’বছর অন্তর লাভ করে এই দুই ক্লাবই। ১৯৪৩-৪৪ মোহনবাগান। ১৯৪৫-৪৬ ইস্টবেঙ্গল। ইস্টবেঙ্গল ১৯৪৭ শিল্ড ফাইনালে দুর্দান্ত লড়াই করেও মোহনবাগানের কাছে ০-১ গোলের পরাজয় এড়াতে পারেনি। ১৯১১-র ঐতিহাসিক শিল্ড জয়ের পর মোহনবাগানকে ৩৬ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে এই শিল্ড পেতে। সবুজ-মেরুনের কাছে সে কারণেই এই বছরটা উল্লেখযোগ্য।

পঞ্চাশের দশক থেকেই ভারতীয় ফুটবলের শীর্ষে থাকা এই দুই দলকে কেন্দ্র করে বাঙালি বিভক্ত। ১৯৬০ সালে মুম্বইয়ের কুপারেজ স্টেডিয়াম রোভার্স কাপের সেমিফাইনালে দেখল এক রুদ্ধশ্বাস লড়াই। আত্মবিশ্বাসের চুড়োয় থাকা তারকাখচিত মোহনবাগানকে উৎসাহ দিতে যেমন মাঠে উপস্থিত ছিলেন গায়ক, সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, তেমনই ইস্টবেঙ্গলের সমর্থনে অভিনেতা অশোক কুমার এবং পুত্র রাহুলকে নিয়ে এসেছিলেন শচীন দেব বর্মণ। এক গোলে এগিয়ে থাকা মোহনবাগান শেষ পর্যন্ত ইস্টবেঙ্গলের কাছে লক্ষ্মীনারায়ণ ও অরুণ ঘোষের দেওয়া গোলে ১-২ তে হার মানে।

১৯৬১-তেও কলকাতা ফুটবল লিগে তুলসীদাস বলরামের দেওয়া গোলে ইস্টবেঙ্গল জিতে যায় মোহনবাগানের বিরুদ্ধে। ষাটের দশকের শুরুটা ইস্টবেঙ্গলের হলেও পরে মোহনবাগানের স্বর্ণযুগ হয়ে যায়। ১৯৬২ সালে এশিয়ান গেমস চ্যাম্পিয়ন ভারতীয় ফুটবল দলের দলনায়ক চুনী গোস্বামীর নেতৃত্বে জার্নেল সিং-এর মতো ফুটবলারদের সঙ্গে নিয়ে এই দশকে মোহনবাগান অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। এই সময়ে ছ’বার কলকাতা ফুটবল লিগ, পাঁচ বার আইএফএ শিল্ড, চার বার ডুরান্ড কাপ মোহনবাগানের দখলে আসে।

এই দশকের শেষে ১৯৬৯-এর আইএফএ শিল্ড মোহনবাগানের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য। তরুণ প্রশিক্ষক অমল দত্ত ভারতীয় ফুটবলের চিরাচরিত আক্রমণাত্মক ২-৩-৫ থেকে সরে এসে রক্ষণকে দৃঢ় করতে দল সাজালেন ৪-২-৪ এ। নঈমুদ্দিন ও ভবানী রায়কে দু’প্রান্ত দিয়ে ওভারল্যাপে তুলে ইস্টবেঙ্গল রক্ষণকে সারা ক্ষণ ব্যস্ত রাখলেন। সেই সুযোগে নবাগত প্রণব গঙ্গোপাধ্যায় দু’টি এবং সুকল্যাণ ঘোষদস্তিদার একটি গোল করে যান। ইস্টবেঙ্গল গোলরক্ষক থঙ্গরাজের পক্ষে ম্যাচটা ছিল খুবই দুর্ভাগ্যজনক। টাইট মার্কিং-এ থাকা কান্নন কোনওক্রমে একটা গোল পরিশোধ করতে পেরেছিলেন। মোহনবাগান জয়ী হয় ৩-১ গোলে। স্কোরলাইনের চেয়েও ম্যাচটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় অমল দত্তর নতুন ফর্মেশনের সফল প্রয়োগে।

ষাটের দশক মোহনবাগানের হলে সত্তরের দশক ইস্টবেঙ্গলের। এই দশকের প্রথম পাঁচ বছর মোহনবাগানকে দাঁড়াতেই দেয়নি ইস্টবেঙ্গল। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ এবং ১৯৭৭-এর কলকাতা ফুটবল লিগ, ছ’বার আইএফএ শিল্ড, তিন বার ডুরান্ড জয়ের শিরোপা লাল-হলুদ শিবির ছিনিয়ে নেয়। ১৯৭৮-এর লিগে দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন মোহনবাগানের। ১৯৭৬-এর মতো এই মরসুমের ডার্বিতেও মোহনবাগান জয়ী হয়। ২২ ম্যাচে ৮০ গোল। বাংলার সব রত্ন ফুটবলার সবুজ-মেরুন শিবিরে। গৌতম সরকার, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যাম থাপা, সুধীর কর্মকার, সুভাষ ভৌমিক, সুব্রত ভট্টাচার্য, প্রদীপ চৌধুরী, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, কম্পটন দত্ত, শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায়, হাবিব, আকবর, মানস ভট্টাচার্য, বিদেশ বসু প্রমুখ।

উল্লাস: মোহনবাগান সমর্থকদের সবুজ-মেরুন পালতোলা নৌকো।

১৯৭৭ থেকে ১৯৮১, ইস্টবেঙ্গল এক বারের জন্যও যাকে পরাস্ত করতে পারেনি, সেই গোলরক্ষক শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, অর্জুন পুরস্কার কিংবা মোহনবাগানের অধিনায়কত্ব না পাওয়া, মোহনবাগানের হয়ে ফরোয়ার্ডে খেলে চার-চারটে গোল পেয়েও স্ট্রাইকারে স্থান না পাওয়ার সব দুঃখ তাঁর ঘুচে গেছে ১৯৭৭-এ মোহনবাগানের বিরুদ্ধে কসমস ক্লাবের হয়ে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে আসা ফুটবল-সম্রাট পেলের পা থেকে বল তুলে এবং তাঁর ফ্রি-কিক সেভ করতে পেরে। ফেডারেশন কাপ, নাগজি, সিএফএল-এর মতো আইএফএ শিল্ডও ১৯৭৮-এ যুগ্মভাবে জয় করে মোহনবাগান। ১৫ সেপ্টেম্বর শিল্ডের সেই ম্যাচে তাঁদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল কয়েকজন বিশ্বকাপারকে নিয়ে খেলতে আসা সোভিয়েট ইউনিয়নের সেরা দল ‘আরারত’-এর। যুগ্মচ্যাম্পিয়ন মোহনবাগানের অন্যতম ফুটবলার শিবাজী মনে করেন, এ দেশে খেলতে আসা তাঁর দেখা সেরা শক্তিশালী ফুটবল ক্লাব ‘আরারত’। মোহনবাগানের দাপটের কাছে তাদেরও নতি স্বীকার করতে হয়েছিল ২-২ ড্র করে। ১৯৭৭ থেকে ’৭৯ শিল্ড জয়ের হ্যাটট্রিকের সৈনিক শিবাজী মনে করতেন, তাঁদের যাবতীয় ডার্বির সাফল্য ম্লান হয়ে যায় ১৯৭৫-এর আইএফএ শিল্ডের ফাইনাল ম্যাচের বিপর্যয়ে। কোচ অরুণ ঘোষ তাঁর অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব না দিয়ে তরুণ গোলরক্ষক ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়কে বিপদের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পরে অবশ্য ভাস্কর দেশের সেরা গোলকিপার হয়ে উঠেছিলেন। শিবাজী মনে করতেন, তিনি সে দিন গোলে থাকলে মোহনবাগান পাঁচ গোল না-ও খেতে পারত। না খেলতে পারার অভিমানে তিনি পরের বছর ১৯৭৬-এ চলে যান এরিয়ান্সে। এই মরসুমে কার্ত্তিক শেঠের একটি বিতর্কিত গোল ছাড়া এক বারের জন্যও পরাস্ত হননি। ১৯৭৭-এ ফিরে এসে মোহনবাগানকে ত্রিমুকুট পাইয়ে দিতে অন্যতম ভূমিকা নেন। এই বছর থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত ইস্টবেঙ্গলের কাছে গোল না খেয়ে এক ইতিহাস গড়েন শিবাজী।

১৯৭৫-এর আইএফএ শিল্ডের ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের সুরজিৎ সেনগুপ্ত, শ্যাম থাপা, রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়, শুভঙ্কর সান্যালরা একের পর এক গোল করে মোহনবাগানের গৌরব তছনছ করে দিয়ে যান। প্রশান্ত মিত্রকে পরিবর্ত হিসেবে গোলে দাঁড় করিয়েও ইস্টবেঙ্গলের গোল আটকাতে পারেনি মোহনবাগান। ৫-০ গোলের ব্যাবধানের এই ম্যাচটিই এখন পর্যন্ত কলকাতা ডার্বির সবচেয়ে বড় ব্যবধান। এই ম্যাচের পর নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যায় মোহনবাগান তাঁবুতে। কয়েক জন ফুটবলার পালিয়ে গঙ্গার ঘাটে নৌকায় রাত্রি যাপন করতে বাধ্য হন। একাধিক ফুটবলার ক্লাব ছেড়ে চলে যান। পরাজয় মানতে না পেরে পরজন্মে ফুটবলার হয়ে এর প্রতিশোধ নেবেন বলে সুইসাইড নোটে লিখে নিজেকে শেষ করে দেন সমর্থক উমাকান্ত পালধি।

এই বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছিল ২২ বছর পর ১৯৯৭-এর ফেডারেশন কাপ সেমিফাইনালের ডার্বিতে। ডার্বির দীর্ঘ ইতিহাসে স্মরণীয় এই ম্যাচ। দুই কোচ পি কে বন্দ্যোপাধ্যায় আর অমল দত্তের বাক্‌যুদ্ধ প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে এমন পর্যায়ে পৌঁছে দেয় যে, তার টানে যুবভারতী স্টেডিয়ামে চলে আসেন রেকর্ড সংখ্যক ১ লক্ষ ৩১ হাজার দর্শক। এখনও পর্যন্ত ভারতীয় যে কোনও ক্রীড়ার সবচেয়ে বেশি দর্শক-সংখ্যা এটাই। ম্যাচ ঘিরে এতটাই টেনশন তৈরি হয়েছিল যে, তদানীন্তন ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীকে মাইক হাতে মাঠে নেমে পড়তে হয়। পি কে ব্যানার্জির ভোকাল টনিক, অমল দত্তের থ্রি-ব্যাক ডায়মন্ড সিস্টেম তাতিয়ে দেয় দর্শকদের। এই সিস্টেমে এক সঙ্গে ৭-৮ জন ফুটবলার তরঙ্গের মতো ওঠানামা করে। কোয়ার্টার ফাইনালেই চিমাকে সঙ্গে নিয়ে অমল দত্ত চার্চিল ব্রাদার্সকে ৬-০ গোলে চূর্ণ করে আসেন। আশা ছিল, ১৯৬৯-এর মতো এ বারও তিনি তার নতুন সিস্টেমে ডার্বিতে বাজিমাত করবেন। সাফল্যের ব্যপারে এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, ম্যাচের আগে ইস্টবেঙ্গলের ভাইচুংকে ‘চুংচুং’, স্যামুয়েল ওমোলোকে ‘ওমলেট’ বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্যও করেন। এটাই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে তাঁর দলে। নিজের দল ও সমর্থকদের তাতাতে গিয়ে তেতে যায় ভাইচুং, ওমোলোরা। ভাইচুং হ্যাটট্রিক করে ডার্বিতে ইতিহাস গড়েন। নাজিমুল হকও একটা গোল পান। ১-৪ গোলের পরাজয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয় অমল দত্ত ও তার দলকে। একটা গোল পেলেও চিমা আটকে ছিলেন মুসার কাছে। এই জয় ইস্টবেঙ্গলকে ফাইনালে পৌঁছে দিলেও ফাইনালে তারা ১-২ গোলে হেরে যায় সালগাঁওকরের কাছে। সেমিফাইনালে অমল দত্তের মোহনবাগানের মতো ফাইনালে পি কে ব্যানার্জির লাল-হলুদ উপরে উঠে সময়মতো আর নীচে নামতে পারেনি।

কলকাতা ডার্বির প্রসঙ্গ উঠলে ১৯৮০-র ১৬ অগস্টের দুই প্রধানের লিগের ম্যাচটির কথা আসতে বাধ্য। সেই কলঙ্কজনক দিনে ইডেনে ১৬ জন দর্শক পদপিষ্ট হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন খেলা দেখতে এসে। সে দিনের অন্যতম ফুটবলার মানস ভট্টাচার্য মনে করেন, রেফারি সুধীন চট্টোপাধ্যায় সে দিন শুরু থেকে ম্যাচের রাশ টেনে ধরতে পারলে মাঠে গন্ডগোল এড়ানো যেত। মোহনবাগানের লেফট উইঙ্গার বিদেশ বসুকে আটকাতে ইস্টবেঙ্গল কোচ পি কে লেফট ব্যাক পজিশন থেকে দিলীপ পালিতকে সরিয়ে আনেন রাইট ব্যাক পজিশনে। মানস ভট্টাচার্য বলেন, দিলীপ ক্রমাগত বিদেশকে অকারণে আঘাত করে যাচ্ছিল। এ থেকেই মাঠের গন্ডগোল ছড়িয়ে যায় গ্যালারিতে। মৃত সমর্থকদের স্মৃতিকে সম্মান জানিয়ে ১৬ অগস্ট দিনটিকে ‘ফুটবল লাভার্স ডে’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে আইএফএ। রক্তদান শিবিরেরও আয়োজন হয় দিনটিতে।

ফুটবলার বিদেশ বসু এই মর্মান্তিক ম্যাচটিকে স্মরণে রাখতে চান না, তাঁর স্মরণীয় ম্যাচ ১৯৭৯ সালের আইএফএ শিল্ডের ফাইনাল। বললেন, এটি তাঁর জীবনের সেরা ব্যর্থতার ম্যাচ। ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে ১৯৭৫-এর প্রতিশোধ তিনি একাই নিতে পারতেন। কিন্তু পাঁচ-পাঁচ বার ওপেন নেট তিনি নষ্ট করেছেন। হয় ভাস্করের হাতে বল তুলে দিয়ে এসেছেন, নয়তো বাইরে মেরেছেন। শেষ পর্যন্ত গৌতম সরকারের দেওয়া গোলে মোহনবাগান চ্যাম্পিয়ন হয়। এই ম্যাচে ইস্টবেঙ্গলের দুর্বলতার সুযোগের সদ্ব্যবহার যেমন মোহনবাগান করতে পারেনি, তেমনি ১৯৭৯-র কলকাতা লিগের ডার্বির ম্যাচটি সারা ক্ষণ নিজেদের দখলে রেখেও জিততে পারেনি ইস্টবেঙ্গল। প্রচুর গোলের অপচয় করে সাবির আলির গোলে ইস্টবেঙ্গল এগিয়ে যায়। মানস ভট্টাচার্য বললেন, “সে দিন ইস্টবেঙ্গল আউটস্ট্যান্ডিং ফুটবল খেলছিল। মোহনবাগানের গোলরক্ষক প্রতাপ ঘোষ সে দিন দুর্দান্ত হয়ে না উঠলে ইস্টবেঙ্গল ১৯৭৫-এর শিল্ড ফাইনালের ফলাফলে পৌঁছে যেত।” অবশেষে চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের সেই দুর্ভাগ্যজনক ব্যাক পাস ভাস্করের পায়ে আসার আগেই দ্রুত ছুটে গিয়ে গোল করে সমতা ফেরান মানস। সেই সঙ্গে মাত্র এক পয়েন্টের ব্যবধানে কলকাতা লিগ পায় তাঁর ক্লাব। সে বছর লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন মানসই। সে কারণেই ম্যাচটা তাঁর কাছে স্মরণীয়। বিদেশের সাফল্যের ডার্বি ১৯৮৪-র ডুরান্ড ফাইনাল। বললেন, সে বার তিনিও একই ভাবে মনোরঞ্জনের পা থেকে বল কেড়ে গোল করে মোহনবাগানকে ট্রোফি পাইয়ে দেন।

১৯৮২ থেকে ১৯৯৭, বহু ডার্বি ম্যাচ খেলা ডিফেন্ডার তরুণ দে কোনও ডার্বি ম্যাচকেই আলাদা করে প্রাধান্য দিতে চাইলেন না। বললেন, “ভুলে গিয়েছি। জীবনের শেষ ম্যাচ বলে ১৯৯৭-এর ডার্বির কথাটাই অনেক কষ্ট করে মনে রেখেছি। ১৯৯৬-তে মোহনবাগানে খেলেছিলাম বলে পি কে ব্যানার্জি আমাকে ইস্টবেঙ্গলে খেলাতে চাইছিলেন না। তুষার রক্ষিতের মধ্যস্থতায় এমন সময় সুযোগ পেলাম, যখন আমি খুবই অসুস্থ। পা চলছিল না। তবু গোপন করে খেলতে নামলাম। তা না হলে অজুহাত দেখিয়ে খেলছি না বলে বদনাম দিত ক্লাব। উল্টো দিকে চিমা। ওকে আটকানোর দায়িত্ব আমার ওপর। শরীরের যা অবস্থা, চিমার সঙ্গে বল দখলের লড়াইয়ে পেরে উঠতাম না। বার বার অফসাইডের ট্র্যাপে ফেলে ওকে আটকে দিলাম। তবু বিপদ পিছু ছাড়ল না। এক বার চিমা ও ওমোলোর সঙ্গে হেড দিতে উঠে আমার শোল্ডার ডিসলোকেটেড হয়ে যায়। ম্যাচটা গোলশূন্য ড্র হল।”

১৯৭৫ সালে আইএফএ শিল্ডের ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের কাছে পাঁচ গোল খাওয়া ম্যাচে মোহনবাগানের রক্ষণে ছিলেন সুব্রত ভট্টাচার্য। ১৭ বছর টানা সবুজ-মেরুন জার্সিতে খেলা তাঁদের ঘরের ছেলে সুব্রত ২০০৭-এ ইস্টবেঙ্গলে আসেন কোচের দায়িত্ব নিয়ে। মোহনবাগানের লাখো সমর্থক সে দিন মর্মাহত হয়েছিলেন। সুব্রতকে ভাল মনে গ্রহণ করেনি লাল-হলুদ শিবিরের একাংশও। সেই বছরই কলকাতা ফুটবল লিগের ডার্বিতে ৩২ বছর আগের স্মৃতি প্রায় ফিরে আসছিল তার প্রশিক্ষণ জীবনে। বিরতির আগেই ০-৩ গোলে পিছিয়ে যায় ইস্টবেঙ্গল। মোহনবাগানের কোচ রবার্তো কার্লোস পেরেইরার আক্রমণের কাছে গুটিয়ে যায় তাঁর রক্ষণ নীতি। মনে করা হচ্ছিল, অতীতের প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে যাবে মোহনবাগানের এই ম্যাচ থেকে। ফুটবলার হিসেবে ইস্টবেঙ্গলের কাছে খেয়েছিলেন ৫ গোল। কোচ হিসেবে তাঁর প্রিয় দল মোহনবাগানের কাছে হজম করতে হবে সেই যন্ত্রণা! নিজে স্টপার হওয়ায় তাঁর রক্ষণাত্মক কৌশলেই ইস্টবেঙ্গল ডুবতে বসেছিল। ব্যারেটোকে আটকাতে মাধব দাসকে ব্যবহার করেন, স্টপারে খেলান তরুণ ফুটবলার অমূল্য মণ্ডলকে। সেই সুযোগে মোহনবাগানের লালম পুইয়া, ভেঙ্কটেশরা ক্রমাগত আক্রমণে উঠে এসে গোল করে যান। বিরতির পর সুব্রত বুঝে যান, গোল আগলে আর লাভ নেই। বিরতিতে দলকে নির্দেশ দেন আক্রমণে উঠে যেতে। মাধবকে বসিয়ে চন্দন দাসকে নামান, অমূল্যকে রক্ষণ থেকে সরিয়ে তাঁর জায়গায় আক্রমণে নামান দীপেন্দু বিশ্বাসকে। তিন গোলে পিছিয়ে থেকে বিরতির পর খোঁচা খাওয়া বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ইস্টবেঙ্গল। আলভিটো ডি’কুনহা (দু’গোল) ও এডমিলসনের দেওয়া গোলে (৩-৪) কিছুটা মুখরক্ষা হয় ইস্টবেঙ্গলের। বদনামের হাত থেকে অব্যাহতি পান সুব্রত। শতবর্ষে স্মরণীয় ডার্বির স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে ভারতীয় ফুটবলে ২৪৮ গোল করা ইস্টবেঙ্গলের দীপেন্দু বিশ্বাস এই ম্যাচটারই উল্লেখ করে বললেন, তাঁর হেড করা বল ড্রপ খেয়ে ফাঁকা গোলে ঢোকার বদলে সে দিন কাদায় আটকে যায়। তা না হলে ৪-৪ ড্র করে সম্মান নিয়ে ফিরতে পারতেন তাঁরা।

ইস্টবেঙ্গলের লাল-হলুদ ইলিশ।

সুব্রত ভট্টাচার্যের মতো একই পরিণতির হাত থেকে পরিত্রাণ পান সুভাষ ভৌমিকও। ১৯৭৫-এর পাঁচ গোল খাওয়ার যন্ত্রণা ঘুচিয়ে ২০০৯-এর আই লিগে ইস্টবেঙ্গলের জালে পাঁচ গোলের ডালি সাজিয়ে দেয় মোহনবাগান। ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলার হিসেবে সুভাষ ভৌমিক মোহনবাগানকে পাঁচ গোলে হারানোয় যে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন, ৩৪ বছর পর সেই মোহনবাগানের কাছে ইস্টবেঙ্গলের পাঁচ গোল খাওয়ার সাক্ষী থাকলেন কোচের ভূমিকায়। মান রক্ষা হয়, সুব্রত ভট্টাচার্যের মতো তিনিও দলকে দিয়ে তিনটে গোল ফেরাতে পারায়। কলকাতা ডার্বিতে এক ম্যাচে ৮ গোল আগের সব রেকর্ড ভেঙে দেয়। জয়ে আই লিগে অষ্টম স্থানে থাকা মোহনবাগান, দশম স্থানের ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে অনেকটাই উপরে উঠে আসে। কলকাতা লিগ হয়নি। তাই ২৫ অক্টোবর মরসুমের প্রথম ডার্বি প্রত্যক্ষ করতে যুবভারতীতে এসেছিলেন প্রায় ৮০ হাজার সমর্থক। পায়ে চোট থাকায় এই ম্যাচে খেলতে পারেননি ভাইচুং ভুটিয়া। মোহনবাগানের হয়ে হ্যাটট্রিক-সহ চারটি গোল করেন চিডি। অপরটি মণীশ মাতানির। ইস্টবেঙ্গলের তিনটি গোল আসে নির্মল ছেত্রী, ইয়াকুব ও মিত্রভিচের কাছ থেকে। বিরতিতেই ৩-৩। ডার্বিতে এটাও প্রথম দেখল কলকাতা।

২০০৭ কলকাতা ফুটবল লিগ এবং ২০০৯-এর আই লিগ। মোহনবাগানের জেতা দুই ডার্বিতেই গোলরক্ষক ছিলেন শিল্টন পাল। দুই ম্যাচেই তিনটি করে গোল খান তিনি। অস্বস্তিকর সেই স্মৃতি টেনে আনতে চাইলেন না। বললেন, “এক-এক দিন ফুটবলারদের খারাপ দিন হয়েই যায়। গোলকিপাররা অধিকাংশ সময় ডিফেন্সের ভুল বোঝাবুঝির শিকার হন। যেমন হয়েছিলাম আমি। বহু ডার্বি ম্যাচ খেলেছি। জিতেওছি।” শিল্টন মনে করেন, ব্যর্থতার চেয়ে সাফল্যের ইতিহাস স্মরণ করাই ভাল। তাতে এগিয়ে যাওয়া যায়।

ইস্টবেঙ্গলের তুলসীদাস বলরাম এবং মোহনবাগানের শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়।

ডার্বির শতবর্ষের ইতিহাসে বহু টুর্নামেন্টেই দু’দলের সাক্ষাৎ হয়েছে। এর সুবাদে আমরা পেয়েছি মজিদ বাসকর, চিমা ওকোরি, ক্রিস্টোফার, চিবুজোর, ব্যারেটো, ওমেলো-র মতো বহু বিদেশি খেলোয়াড়কে। ডার্বির পরিসংখ্যানে ইস্টবেঙ্গল এগিয়ে থাকলেও ইতিহাস গড়ার লক্ষ্যে মোহনবাগান বরাবর ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছে। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় ফুটবল টুর্নামেন্ট আইএসএল-এর কথাই ধরা যাক। গত বছর এই টুর্নামেন্টের প্রথম ডার্বিতে নিজেদের শতবর্ষ স্মরণীয় করার সুযোগ ছিল ইস্টবেঙ্গলের। হাতছাড়া হয় এই ঐতিহাসিক সাফল্য। সবুজ-মেরুন শিবির জেতে ২-০ গোলে। চলতি মরসুমে দ্বিতীয় আইএসএল-এর ডার্বিতেও ইস্টবেঙ্গল হারে ১-৩ গোলে।

দুই বিখ্যাত কোচ অমল দত্ত এবং পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়।

পরিস্থিতির চাপে, প্রতিপক্ষের বিদেশি শক্তির মোকাবিলায় বাধ্য হয়েই প্রথা ভেঙেছে অনেক। বর্তমানে এটিকে-র সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ায় আরও বির্তকের মুখে ঠেলে দিয়েছে তাদের। ইস্টবেঙ্গলের পরিচালন ব্যবস্থাতেও বিরক্ত বহু ক্লাব সদস্য। কারণ খুঁজতে গিয়ে প্রাক্তন খেলোয়াড়রা বললেন, খেলায় কাজল, সমরেশ, কৃশানু, বিকাশ, সুদীপ, সুব্রত, গৌতম, বাসুদেব, দীপেন্দুদের মানুষ পাচ্ছে না— এদের নিজেদের পরিবারের খেলোয়াড় বলে ভাবতেন সমর্থকরা, তাদের সাফল্য, ব্যর্থতা সুখ-দুঃখের অংশীদার মনে করতেন নিজেদের। এখন প্রিয় দলের খেলোয়াড়দের নামই মনে রাখতে পারেন না অনেকে। ক্লাবে এখন বিদেশি ফুটবলারই বেশি। সমর্থকরাও উৎসাহ হারাচ্ছেন। ফিকে হয়ে আসছে সবুজ-মেরুন বা লাল-হলুদের ঔজ্জ্বল্য। অদূর ভবিষ্যতে ডার্বির মর্যাদা দেশের অন্য দু’টি ক্লাবও কেড়ে নিতে পারে। সে সংশয়ও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

(লেখক রাজ্য ক্রীড়া পর্ষদের
প্রাক্তন ক্রীড়াসাংবাদিক)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement