স্লগ ওভারে ঝোড়ো ব্যাটিং করে ম্যাচ বাঁচিয়েছেন বহু বার। দেশের হয়ে। আইপিএলে নাইট রাইডার্সের হয়ে। সেই ইউসুফ পাঠান লোকসভা নির্বাচনে লড়ছেন কংগ্রেসের লোকসভার নেতা অধীর চৌধুরীর গড় বহরমপুরে। তৃণমূলের টিকিটে। পাঁচ বারের সাংসদের থেকে কি ম্যাচ ছিনিয়ে আনতে পারবেন ইউসুফ? সেই খেলা দেখার অপেক্ষায় বহরমপুর থেকে গোটা রাজ্য।
১৯৮২ সালে গুজরাতের বরোদায় জন্ম ইউসুফের। খুব সাধারণ ভাবে মানুষ হয়েছেন তিনি এবং ভাই ইরফান। গলিতে ক্রিকেট খেলেই বড় হয়েছেন দুই ভাই। ১৯৯৯ সালে বরোদা অনূর্ধ্ব-১৬ দলের হয়ে বিজয় মার্চেন্ট ট্রফি ম্যাচে খেলেছিলেন।
২০০১ সালে রঞ্জি ম্যাচ খেলা শুরু করেন ইউসুফ। সৌরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। জাতীয় ক্রিকেট দলে ভাই ইরফান আগে সুযোগ পেয়েছিলেন। ২০০৭ সালে প্রথম সুযোগ আসে ইউসুফের জন্য। নাটকীয় ভাবে।
২০০৭ সালে আইসিসির টি২০ বিশ্বকাপের ফাইনাল। বিপক্ষে পাকিস্তান। বীরেন্দ্র শেহবাগ চোট পান। ম্যাচ ওপেন করতে নেমেছিলেন ইউসুফ। ১৫ রান করেছিলেন। সেই ম্যাচ জিতেছিল ভারত।
এক দিনের ম্যাচে ইউসুফের হাতেখড়ি হয় পরের বছর। আবারও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। তবে চালিয়ে খেলেন বলে টেস্ট দলে জায়গা হয়নি পাঠানের। ২০১১ সালে ৫০ ওভারের বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ছিলেন।
কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে ২০১৭ সাল পর্যন্ত খেলেছেন ইউসুফ। আইপিএলের প্রথম তিনটি মরসুমে খেলেছিলেন রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে। ২০০৮, ২০০৯ এবং ২০১০ সালে। ২০১১ সালে তাঁকে নিলামে কেনে শাহরুখ খানের দল নাইট রাইডার্স।
কলকাতা নাইট রাইডার্স ২০১২ এবং ২০১৪ সালে আইপিএল জেতে। সেই দলেও ছিলেন ইউসুফ। ২০১২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে শেষ বার ভারতের হয়ে টি-টোয়েন্টি ম্যাচে দেখা গিয়েছিল ইউসুফকে।
সেই ইউসুফকে বহরমপুরে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। রাজনীতিতে একেবারে নবীন। ইউসুফকে অধীরের গড়ে হঠাৎ কেন পাঠাল রাজ্যের শাসকদল? তৃণমূলের একটি সূত্রের বক্তব্য, ইউসুফকে প্রার্থী করার নেপথ্যে অন্যতম কারণ হল গোষ্ঠীকোন্দল এড়ানো।
জেলা সভানেত্রীর পদ যাওয়ার পরেই শাওনি সিংহ রায়কে লোকসভা ভোটের প্রার্থী করার দাবি দলের অন্দরে তুলছিলেন তাঁর অনুগামীরা। গত বারের প্রার্থী তথা বর্তমান জেলা সভাপতি অপূর্বও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কারও কারও দাবি, বহরমপুর পুরসভার চেয়ারম্যান নাড়ুগোপাল মুখোপাধ্যায়ও বহরমপুর কেন্দ্রের প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর রাজ্যের ইউসুফকে নিয়ে এসে প্রার্থী করে তৃণমূল।
আরও একটি কারণ হল সংখ্যালঘু ভোট। তৃণমূলের একটি সূত্রের বক্তব্য, কংগ্রেসের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে ভাগ বসাতে পারলে বহরমপুর দখল করা সম্ভব। সেই লক্ষ্যেই ইউসুফকে প্রার্থী করা হয়েছে।
হঠাৎ কী ভাবে যোগাযোগ হল ইউসুফের সঙ্গে? আনন্দবাজার অনলাইনকে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর থেকে ওঁর সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি। কলকাতায় খেলতে এসে ওঁর প্রতি মানুষের আবেগ দেখেছি। এখানকার ক্রীড়ামন্ত্রী (অরূপ বিশ্বাস)-র সঙ্গে খেলার সূত্রে যোগাযোগ ছিল। বাকিটা ব্যক্তিগত...।’’
২২ গজে তিনি ঝোড়ো ব্যাটিংয়ের জন্য পরিচিত। ‘পিঞ্চ হিটার’ বলা হত তাঁকে। রাজনীতির ময়দানে কিন্তু চালিয়ে খেলতে নারাজ ইউসুফ। বড়ঞা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রচার শুরু করেন তিনি। যেখানকার তৃণমূল বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহা এখন দুর্নীতি মামলায় জেলবন্দি। আর দ্বিতীয়টি কান্দি বিধানসভা। যেখানে গত লোকসভা ভোটে তৃণমূলকে বেগ পেতে হয়েছিল।
কেন এই দুই বিধানসভা দিয়ে প্রচার শুরু করেন ইউসুফ? তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, ভোটের ময়দানে আনকোরা হলেও বেশ প্রস্তুতি নিয়েই ‘খেলতে নেমেছেন’ ইউসুফ। তৃণমূল তাঁকে প্রার্থী করার পর থেকেই নাকি বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে বিভিন্ন নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে যথেষ্ট চর্চা করেছেন প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার। আর এই গোটা বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁর এক বিশ্বস্ত সহযোগীকে। তাঁর পরামর্শেই নাকি বড়ঞা, কান্দি থেকে প্রচার শুরু।
মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের শিল্প তালুকের একটি বেসরকারি হোটেলে থাকছেন তৃণমূল প্রার্থী পাঠান। ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি বরাবর শ্রদ্ধাশীল তিনি। প্রতি বছর রমজান মাসে নিয়ম করে রোজা রাখেন। মুর্শিদাবাদ এসেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বহরমপুর শহরের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে রাজা মিঞার মোড়ের মসজিদে যান নমাজ পড়তে।
প্রচারের মাঝে যোগ দিয়েছিলেন ইফতারেও। সেখানে একাধিক পদের মধ্যে বাংলার পদকেই এগিয়ে রাখেন ইউসুফ। জানান, ভেটকি মাছের ফ্রাই আর ছানাবড়া সব থেকে বেশি ভাল লেগেছে।
দোলের দিনে প্রচারে বেরিয়ে ইউসুফ দাবি করেন, আইপিএল শেষ হলেই তাঁর ভাই ইরফান পাঠান-সহ একঝাঁক ক্রিকেট তারকা আসবেন বহরমপুরে। কংগ্রেস পাল্টা কটাক্ষ করে বলে, মানুষ এ সবে ভুলবে না। ইউসুফ কথা রেখেছেন। তাঁর হয়ে প্রচার করে গিয়েছেন ভাই ইরফান।
মহিলা ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখতেও সমান উদ্যোগী ইউসুফ। প্রচারে তিনি জানান, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর মতো প্রকল্প মহিলাদের ‘ইজ্জত’ বাড়িয়েছে। ‘কন্যাশ্রী’র মতো প্রকল্পে উপকৃত হচ্ছেন প্রান্তিক পরিবারের মহিলা সদস্যেরা।
যখন ২২ গজে ছিলেন, তখন বরাবর বিতর্ক থেকে দূরেই থেকেছেন ইউসুফ। তবে ভোটের ময়দানে বিতর্কে জড়িয়েছেন তিনি। বহরমপুরের তৃণমূল প্রার্থী ইউসুফের নির্বাচনী প্রচারে তাঁর বিশ্বকাপ জয়ের মুহূর্ত এবং ভারতীয় দলের প্রাক্তন ক্রিকেটার সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গে ছবি ফ্লেক্সে ব্যবহার করা হয়েছে। বিধিভঙ্গ হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন বিরোধীরা। সেই সব অভিযোগের প্রেক্ষিতে মুর্শিদাবাদের জেলাশাসকের কাছে রিপোর্ট তলব করেছে নির্বাচন কমিশন।
১৩ মে বহরমপুরে ভোট। ২০০৭ সালের টি২০ ফাইনাল ম্যাচেরই কি পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে? ইউসুফের তেমন অবদান ছাড়াই সে বার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচ জিতেছিল ভারত। এ বারও কি তা-ই হবে? না কি নিজের নাম রাখবেন ‘পিঞ্চ হিটার’?