আবার বিপাকে গৌতম আদানি এবং তাঁর মালিকানাধীন আদানি গোষ্ঠী। আমেরিকায় ভারতীয় শিল্পপতি-সহ সাত জনের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার ঘুষ এবং আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠার পরই বৃহস্পতিবার আদানি গোষ্ঠীর সংস্থাগুলির শেয়ারদর বেশ খানিকটা কমেছে।
আমেরিকার অভিযোগের তির গৌতমের দিকে পড়তেই আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারের দর হু হু করে নামতে থাকে। ভারতীয় শেয়ারবাজার থেকে এক ঘণ্টায় দু’লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ হারায় আদানি গোষ্ঠী।
কিন্তু হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের পর আবার কোন পচা শামুকে পা কাটল আদানিদের? গৌতম এবং বাকিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ভারতের রাজ্য বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলির সঙ্গে সৌরবিদ্যুৎ চুক্তির বরাত পেতে ভারতের সরকারি কর্তাদের কোটি কোটি ঘুষের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাঁরা।
ঘুষ-কাণ্ডে নাম জড়িয়েছে গৌতমের ভাইপো সাগর আদানিরও। বাকি ছয় অভিযুক্তের মধ্যে রয়েছেন ‘আদানি গ্রিন এনার্জি লিমিটেড’-এর সিইও বিনীত জৈন, রঞ্জিত গুপ্ত, রূপেশ আগরওয়াল, অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সের নাগরিক সিরিল ক্যাবানেস, সৌরভ আগরওয়াল এবং দীপক মলহোত্র।
নিউ ইয়র্কের ইস্টার্ন ডিস্ট্রিক্টের ইউএস অ্যাটর্নি অফিস থেকে জারি করা একটি বিজ্ঞপ্তিতে সেই অভিযোগের কথা বলা হয়েছে। আর তার পরেই বিতর্ক শুরু হয়েছে।
তবে প্রশ্ন উঠছে, ভারতে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ উঠলেও তাতে কেন নাক গলাচ্ছে আমেরিকা? উল্লেখ্য, আমেরিকার আইন অনুযায়ী, আমেরিকার বাজারের সঙ্গে যুক্ত বা আমেরিকায় বিনিয়োগকারী কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা চালাতে পারে সে দেশের প্রশাসন। সে তিনি যে দেশেরই নাগরিক হন না কেন!
আমেরিকার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, আদানি, তাঁর ভাগ্নে সাগর এবং অন্যেরা ২০ বছরে ২০০ কোটি ডলার লাভের আশায় ওই প্রকল্প ‘হাতাতে’ চেয়েছিলেন এবং সেই জন্যই রাজি হয়েছিলেন ২২৩৭ কোটি টাকারও বেশি ঘুষ দিতে।
আমেরিকা জানিয়েছে, রঞ্জিত গুপ্ত এবং রূপেশ আগরওয়াল ‘আজ়ুরে পাওয়ার’ নামে সংস্থার সিইও এবং পরামর্শদাতা। আমেরিকার সরকারি আইনজীবীরা জানিয়েছেন, ‘ইন্ডিয়ান এনার্জি কোম্পানি’ এবং ‘আজ়ুরে পাওয়ার’ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ‘সোলার এনার্জি কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া’ (এসইসিআই)-কে ১২ গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ সরবরাহ করার চুক্তি পেয়েছিল।
তবে, এসইসিআই নাকি ভারতে সৌরবিদ্যুৎ কেনার জন্য ক্রেতা খুঁজে পায়নি। ক্রেতা না থাকলে চুক্তিটিও বন্ধ করা ছাড়া আর উপায় ছিল না। উভয় সংস্থা প্রত্যাশিত লাভ হারাতে চলেছিল।
আমেরিকার আইনজীবীরা জানিয়েছেন, এর পরেই আদানি গোষ্ঠী এবং আজ়ুরে পাওয়ার ভারতের সরকারি কর্তাদের ঘুষ দেওয়ার পরিকল্পনা করে। বিনিময়ে সরকারি আধিকারিকেরা রাজ্য বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলিকে এসইসিআই-এর সঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহ চুক্তি করতে রাজি করাবেন। সরকারি আধিকারিকেরা ঘুষ পাবেন ২২৩৭ কোটি, যার একটি বড় অংশ অন্ধ্রপ্রদেশের কর্মকর্তাদের কাছে যাবে।
এর পরে কয়েকটি রাজ্য বিদ্যুৎ সংস্থা, ‘ইন্ডিয়ান এনার্জি কোম্পানি’ এবং ‘আজ়ুরে পাওয়ার’-এর কাছ থেকে সৌরবিদ্যুৎ কেনার জন্য এসইসিআই-এর সঙ্গে একটি চুক্তি করে। তবে আজ়ুরে পাওয়ারের নেতৃত্বে বদল আসায় সেই চুক্তি সাময়িক ভাবে থমকে যায়। ঘুষ কী ভাবে দেওয়া যায় তা নির্ধারণের জন্য নাকি একের পর এক বৈঠক হয়।
আমেরিকার তরফে আরও অভিযোগ, আদানি এবং আদানি গ্রিন এনার্জি লিমিটেডের সিইও বিনীত জৈন তাঁদের দুর্নীতি লুকিয়ে রাখতে ঋণদাতা এবং বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৩০০ কোটি ডলারের বেশি ঋণ এবং বন্ড সংগ্রহ করেছিলেন।
একটি অভিযোগ অনুযায়ী, ঘুষের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য ট্র্যাক করার জন্য নিজের ফোন ব্যবহার করেছিলেন সাগর। কয়েক জন ষড়যন্ত্রকারী নিজেদের বাঁচাতে ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। গৌতম আদানিকে নাকি উল্লেখ করা হত ‘নিউমেরো উনো (ইতালীয় ভাষায় এক নম্বর)’ এবং ‘দ্য বিগ ম্যান’ নামে।
গৌতম, সাগর এবং বিনীতের বিরুদ্ধে ‘সিকিউরিটিজ় ফ্রড’, ‘সিকিউরিটিজ় ফ্রড কনস্পিরেসি’ এবং ‘ওয়্যার ফ্রড কনস্পিরেসি’র অভিযোগ আনা হয়েছে। আমেরিকার ‘সিকিউরিটিজ় অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন’-এর দেওয়ানি মামলাতেও আদানিদের অভিযুক্ত করা হয়েছে বলে খবর।
নিউ ইয়র্কের ইস্টার্ন ডিস্ট্রিক্টের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে বলা হয়েছে, ‘‘গৌতম আদানি, সাগর আদানি এবং বিনীত জৈনের বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি ফৌজদারি মামলা দায়ের হয়েছে। আমেরিকার লগ্নিকারীদের থেকে কোটি কোটি ডলার তোলার জন্য জালিয়াতি করেছেন তাঁরা। তাঁদের সংস্থার তরফে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও বিভ্রান্তিকর বিবৃতি দেওয়া হয়েছে।’’
গৌতম, সাগর এবং বিনীত ছাড়া অন্য পাঁচ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আমেরিকার ঘুষ-বিরোধী আইন, ‘ফরেন করাপ্ট প্র্যাকটিস অ্যাক্ট’ লঙ্ঘন করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে এবং চার জনের বিরুদ্ধে বিচারে বাধা দিতে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগও আনা হয়েছে।
আদানি গ্রিন এনার্জির তিন বোর্ড সদস্য ছাড়াও পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির প্রাক্তন পদস্থ কর্তা রঞ্জিত এবং রূপেশের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়েছে। এই দু’জন আমেরিকার স্টক মার্কেটে লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রাথমিক ভাবে এই দু’জনই ঘুষ দিতে রাজি হয়েছিলেন বলে অভিযোগ।
এ ছাড়াও অভিযুক্তদের তালিকায় নাম রয়েছে অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সের নাগরিক সিরিল ক্যাবানেস, সৌরভ আগরওয়াল এবং দীপক মলহোত্রের। শেষের দু’জনেই কানাডার প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বলে জানা গিয়েছে।
নিউ ইয়র্কের জেলা আদালতের অ্যাটর্নি ব্রেন পিস বলেছেন, ‘‘অভিযুক্তেরা কোটি কোটি ডলারের চুক্তিকে সুরক্ষিত করার জন্য ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের ঘুষের প্রস্তাব দেন। আমেরিকা থেকে মূলধন সংগ্রহের নামে আদানি গ্রিন এনার্জির বোর্ড সদস্যেরা মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন।’’
ব্রুকলিনে পিসের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, অভিযুক্তদের কাউকেই হেফাজতে নেওয়া হয়নি। তবে গৌতম আদানি ভারতে রয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমেরিকার এক জন বিচারক গৌতম এবং সাগরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। আইনজীবীরা সেই পরোয়ানাগুলি বিদেশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলিকে হস্তান্তর করার পরিকল্পনা করেছেন বলেও খবর।
উল্লেখ্য, গত সপ্তাহেই এক্সে পোস্ট করে গৌতম জানিয়েছিলেন আমেরিকার শক্তি সুরক্ষা এবং অবকাঠামো প্রকল্পে ১০০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছেন তিনি। এতে আমেরিকায় ১৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলেও তিনি জানিয়েছিলেন।
আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জয়ের অভিনন্দন জানানোর সময় সেই বিনিয়োগ ঘোষণা করেছিলেন আদানি। আর সেই আমেরিকাই এ বার ঘুষকাণ্ডে অভিযোগের আঙুল তুলল ভারতীয় শিল্পপতির বিরুদ্ধে।
অভিযোগ নিয়ে মুখ খোলে আদানি গোষ্ঠী। এক্সে বিবৃতি জারি করে সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে, সব অভিযোগ ভিত্তিহীন।
উল্লেখ্য, ভারতীয় শিল্পপতি গৌতমের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা গুজরাতে। ১৬ বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেন তিনি। ১৯৮৮ সালে আদানি গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠা করেন তিনি এবং একের পর এক ব্যবসা ফেঁদে বসেন। ব্যবসায়িক পত্রিকা ফোর্বস অনুযায়ী, ৬২ বছর বয়সি আদানি ৬৯৮০ কোটি ডলারের মালিক এবং বিশ্বের ২২তম ধনী ব্যক্তি।
এই প্রথম নয়, এর আগেও জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে আদানিদের বিরুদ্ধে। ২০২২ সালে প্রকাশিত হয় হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট। সেই রিপোর্টে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শেয়ারদরে কারচুপির অভিযোগ ওঠে। ধস নামে শিল্পপতি গৌতম আদানির বিভিন্ন সংস্থার শেয়ারদরে। অনেকে বলতে শুরু করেন, আদানির সাম্রাজ্যের ইতি ঘটল।
সেই সময় রাতারাতি এই গোষ্ঠীর বাজারদর পড়ে যায়। অর্থাৎ, যে সংস্থার বাজারদর ছিল ১৯ লক্ষ কোটি টাকা, তা প্রায় ৭ লক্ষ কোটি টাকা হারিয়ে সাড়ে ১২ লক্ষ কোটি টাকায় এসে পৌঁছয়। এক বছর পর পরিস্থিতি কিন্তু অনেকটাই সামলে নিয়েছিলেন আদানিরা। ফিরছিলেন স্বমহিমায়। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই আবার অভিযোগের আঙুল উঠল গৌতমের বিরুদ্ধে।