পশ্চিম এশিয়ায় ইজ়রায়েল-হামাসের লড়াই। অন্য দিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। তবে অনেকেই জানেন না, গত বছর দেড়েক ধরে রক্তাক্ত আফ্রিকার একটি দেশও। কথা হচ্ছে সুদানের। গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত সুদান।
বছর দেড়েক ধরে সুদানে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ চলছে সে দেশের সেনা ‘সুদানিজ় আর্মড ফোর্সেস’ (এসএএফ) এবং আধাসেনা ‘র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স’ (আরএসএফ)-এর মধ্যে।
উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার এই দেশটিতে দেড় বছরে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। যুদ্ধের বিষবাষ্প ছেয়ে গিয়েছে গোটা দেশে। সেনা এবং আধাসেনার যে বিরোধ ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে, তা এখনও ধারাবাহিক, ক্রমবর্ধমানও।
এই যুদ্ধ দে়ড় বছরের মধ্যে কম করে দেড় লক্ষ জীবন কেড়ে নিয়েছে। গৃহযুদ্ধের কারণে দেশছাড়া কম করে দেড় কোটি মানুষ। যুদ্ধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসাবে তৈরি হয়েছে মানবিক সঙ্কট।
চরম আবহাওয়ার কারণে সুদান প্রথম থেকেই সমস্যায়। তার পর যুদ্ধের কারণে দেশ সামাজিক, রাজনৈতিক সঙ্কটের সম্মুখীন। চড়া হারে খাবারের দাম বৃদ্ধিতে সমান্তরাল ভাবে বাড়ছে দারিদ্র, ক্ষুধা। উপায় না পেয়েই ভিটে ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন সুদানবাসী।
তবে সুদানের গৃহযুদ্ধে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মহিলারা। সুদানে মহিলাদের উপর সেনা-আধাসেনার নির্যাতনের ঘটনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিনিয়ত ধর্ষণের খবর উঠে আসছে।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আধাসেনার সদস্যদের শারীরিক নির্যাতন এবং ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচতে আত্মহত্যা করছেন অনেক মহিলা। সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন গেজিরার মহিলারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গেজিরার এক মহিলা সমাজকর্মী জানিয়েছেন, সুদানের অনেক মহিলা ধর্ষিতা হওয়ার পর এবং ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচতে আত্মহত্যা করছেন। আধাসেনার হাতে স্বামী খুন হওয়ার পরেও অনেকে আত্মহত্যা করেছেন বলে সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে জানিয়েছেন তিনি। তবে শুধু আধাসেনা নয়, সেনার বিরুদ্ধেও মহিলাদের উপর নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে।
বাধ্য হয়েও নাকি সম্ভ্রম খোয়াতে হচ্ছে অনেককে। সে দেশে খাদ্যসঙ্কট এমনই চরমে উঠেছে যে, এখন একদানা অন্ন পেতে মহিলাদের খোয়াতে হচ্ছে সম্ভ্রম।
বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে সেই উদ্বেগের কথা আগেই প্রকাশ্যে এসেছে। ‘খাবার পেতে হলে আমাদের সঙ্গে সঙ্গম করতে হবে’— হাড়হিম করা এই কথাই নাকি মহিলাদের বলছে সেনা-আধাসেনা।
সুদান থেকে পালিয়ে আসা অন্তত দু’ডজন মহিলা জানিয়েছেন, সেখানে একমাত্র সেনার সঙ্গে সঙ্গম করেই খাবার পাওয়া সম্ভব।
সুদানে গণহত্যা, মহিলাদের উপর নির্যাতন-সহ একাধিক নৃশংস অপরাধের জন্য সুদানের আধাসেনার দিকে আঙুল তুলেছিল রাষ্ট্রপুঞ্জ। যদিও আরএসএফ সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
সুদানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ দারফুর। এই প্রদেশ এবং এখানকার বাসিন্দাদের উপর হওয়া অত্যাচারের অভিযোগ থেকেই যাবতীয় গন্ডগোলের সূত্রপাত।
সুদানের বর্তমান গৃহযুদ্ধে প্রতিপক্ষ সে দেশের সশস্ত্র বাহিনীরই দুই জেনারেল— সেনাপ্রধান আবদেল আল ফতা আল বুরহান ও জেনারেল মহম্মদ হামদান দাগালো।
প্রথম জন সুদানের সেনাপ্রধান এবং ২০১৯ থেকে দেশের সর্বোচ্চ শাসনব্যবস্থার জন্য ভারপ্রাপ্ত কাউন্সিলের প্রধান। দ্বিতীয় জন দেশের আধাসামরিক বাহিনী আরএসএফের প্রধান তথা কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য। দু’জন জেনারেলের বিরুদ্ধেই মানবাধিকার ভঙ্গ, লুটতরাজ, নৃশংসতা ও ধর্ষণে মদতের অভিযোগ রয়েছে।
গত কয়েক দশকে সুদানে সামরিক বাহিনীর গৃহযুদ্ধের গণহত্যায় এই দুই জেনারেলের ‘বড়’ ভূমিকা ছিল। স্বৈরতন্ত্রী শাসক ওমর আল বশির ৩০ বছর ক্ষমতাসীন থেকে শেষ পর্যন্ত ২০১৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের জেরে ক্ষমতা থেকে অপসারিত হন।
তার পর প্রভাবশালী সামরিক গোষ্ঠী এবং অসামরিক নেতারা মিলে একটি পরিচালন পর্ষদ (কাউন্সিল) গঠন করে নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির ব্যবস্থা করেন। ঠিক হয়েছিল, কয়েক বছরের মধ্যেই পুরোপুরি অসামরিক এক সরকারের হাতে দেশের ক্ষমতা তুলে দেবে।
কিন্তু ২০২১-এর অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী আবদুল্লা হামদকের নেতৃত্বাধীন সেই অন্তর্বর্তী সরকারকেও উৎখাত করেন সেনাপ্রধান বুরহান। এর পর তিনি ২০২৩ সালে নির্বাচন ঘোষণা করেন।
কিন্তু তার আগে জেনারেল বুরহান সুদানের সেনাবাহিনী এবং আরএসএফকে এক ছাতার তলায় আনতে উদ্যোগী হতেই দাগালোর সঙ্গে তাঁর বিবাদ শুরু হয়। এপ্রিল মাসের মধ্যপর্বে যা গড়ায় রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধে।