ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪৫ হাজার ফুট উপরে বজ্রগর্ভ মেঘের ধাক্কা খেয়েছিলেন। স্বাভাবিক নিয়মে অনিবার্য ছিল মৃত্যু। তবে ৪০ মিনিট ধরে লড়াই চালিয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন আমেরিকার এক সেনাকর্তা।
কী ভাবে নিশ্চিত মৃত্যুকে ধোঁকা দিয়েছিলেন তিনি? তার বিবরণ দিয়ে একটি বই লিখেছিলেন লেফ্টেন্যান্ট কর্নেল উইলিয়াম হেনরি র্যানকিন।
‘দ্য ম্যান হু রোড দ্য থান্ডার’— নামে বইটিতে র্যানকিনের সেই অভিজ্ঞতার সবিস্তার বর্ণনা পাওয়া যায়। গত শতকের ষাটের দশকের গোড়ায় বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। সংবাদমাধ্যমের দাবি, র্যানকিন-সহ বিশ্বে মোটে দু’জন এ হেন কীর্তির সাক্ষী।
জার্মানির প্যারাগ্লাইডার ইওয়া উইসনিরস্কা-ও নাকি বজ্রগর্ভ মেঘের কাছে হার মানেননি। তবে সে অন্য কাহিনি। আপাতত র্যানকিনের অভিজ্ঞতা শোনা যাক।
র্যানকিন ছিলেন আমেরিকার মেরিন কর্পস-এর যুদ্ধবিমানচালক। বজ্রগর্ভ মেঘের ধাক্কা খাওয়ার আগে তাঁর ঝুলিতে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং কোরীয় যুদ্ধে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা।
১৯৫৯ সালের ২৬ জুলাই র্যানকিনের জীবনে সেই অভূতপূর্ব সন্ধ্যা নেমেছিল। সে দিন এফ-৮ ক্রুসেডার নামে একটি যুদ্ধবিমান নিয়ে ম্যাসাচুসেট্সের দক্ষিণ ওয়েমাউথের বিউফোর্ট এলাকার নৌসেনা ঘাঁটি থেকে রওনা দিয়েছিলেন তিনি। অন্য একটি ক্রুসেডার যুদ্ধবিমানে ছিলেন তাঁর সঙ্গী তথা উইংম্যান লেফ্টেন্যান্ট হার্বার্ট নোলান।
জুলাইয়ের সেই সন্ধ্যায় ক্যারোলাইনার উপকূলবর্তী এলাকা দিয়ে উড়ছিলেন র্যানকিন। নোলান তাঁর পিছু ধাওয়া করেছিলেন। নিজের বইয়ে র্যানকিন জানিয়েছেন, উড়ানের সময় আবহাওয়া মনোরম থাকলেও ধীরে ধীরে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হতে শুরু করে।
শীঘ্রই যে ঝড় আসছে, তা বেশ বুঝতে পারছিলেন র্যানকিন। সে সময় মাটি ছোঁয়া প্রায় আধ ঘণ্টা বাকি। আচমকাই সজোরে যুদ্ধবিমানের পিছনে একটা ধাক্কা। সঙ্গে বিমানের ইঞ্জিনের গুরুগম্ভীর আওয়াজ। এর পর একের পর এক ধাক্কায় কেঁপে উঠেছিল বিমানটি।
বজ্রগর্ভ মেঘের কবল এড়াতে ৪৫ হাজার ফুট উঁচুতে ওড়া বিমানটিকে আরও উঁচুতে নিয়ে যান র্যানকিন। তত ক্ষণে চালকের আসনে থাকা র্যানকিনের সামনের ইন্সুমেন্টস প্যানেলে তখন নানা সতর্কীকরণ আলো জ্বলতে শুরু করেছে। তারই মধ্যে একটিতে লেখা ফুটে উঠল, ‘ফায়ার’। র্যানকিনের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে বিমানের ইঞ্জিন অত্যন্ত গরম হয়ে উঠেছে। যে কোনও সময় তাতে আগুন ধরে যেতে পারে। হয়তো বা ইতিমধ্যেই আগুন লেগে গিয়েছে বিমানটিতে।
বিপদ বুঝে ইঞ্জিনের উপর চাপ কমাতে সেখানকার বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেন র্যানকিন। এর পর রেডিয়োতে নোলানকে জানিয়ে দেন, জীবন বাঁচাতে হয়তো নিজেকে বিমানের বাইরে নিয়ে যেতে হবে।
রে়ডিয়োতে যুদ্ধবিমানটির অবস্থা জানানোর সময় সেটি ৪৭ হাজার ফুট উঁচুতে উড়ছিল। সেখান থেকে বাইরে ঝাঁপ দেওয়ার অর্থ তো মৃত্যুর মুখে নিজেকে ঠেলে দেওয়া। তবে র্যানকিনের কাছে আর কোনও উপায় ছিল না। বাইরে তখন বরফঠান্ডা তাপমাত্রা। উড়ানের সময় গ্রীষ্মকালের ফ্লাইং স্যুট পরেই বিমানে উঠেছিলেন র্যানকিন।
নিজের বইয়ে র্যানকিন লিখেছেন, ‘‘ইজেকশন সিটে যে আগুন লেগে গিয়েছে, বুঝতে পেরেছিলাম। একই সঙ্গে আগুন ধরার আওয়াজও শুনতে পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন, একটি বিশালাকার হাতি আমায় লাথি মেরেছে। একই সঙ্গে বিকট শব্দে নাক ডাকছে সেটি। তবে এই ভেবে স্বস্তি পেয়েছিলাম যে ইজেকশন সিটটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না।’’
ইঞ্জিনের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দিলেও বিমানটি আরও উঁচুতে ভাসতে শুরু করেছিল। ফলে ইজেকশন সিটের মাধ্যমে বিমানের বাইরে বার হওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না র্যানকিনের। বিমানটির গতি হারানোর অপেক্ষায় ছিলেন তিনি।
বিমানের বাইরে বার হওয়ামাত্র ঠান্ডার কনকনানি হাজারো তিরের মতো বিঁধতে শুরু করেছিল র্যানকিনকে। সে সময় তাপমাত্রা ছিল হিমাঙ্কের থেকে ৭০ ডিগ্রি নীচে। র্যানকিন জানিয়েছেন, বরফজমাট ঠান্ডার ছোঁয়া লাগতেই শরীরের সমস্ত অংশ ফুলতে শুরু করে। কাঁধ, মুখ, কব্জি থেকে গোটা হাত বেয়ে গোড়ালি— ঠান্ডার কামড়ে ফুলছিল সবই। প্রবল ঠান্ডার সংস্পর্শে আসামাত্রই যেন আগুনে গরমে জ্বলতে শুরু করেছে তাঁর গোটা শরীর।
বায়ুর অত্যধিক চাপে র্যানকিনের নাক-চোখ, কান-মুখ দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করেছিল। র্যানকিন লিখেছেন, ‘‘মনে হচ্ছিল যেন কোটর থেকে চোখ দুটো কেউ উপড়ে নিয়ে যাবে। মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছিল, দু’কান ফেটে আসছিল। গোটা শরীর জুড়ে খিঁচুনি শুরু হয়েছিল।’’
র্যানকিন জানিয়েছেন, অত্যধিক বায়ুর চাপে তাঁর পেট এতটাই ফুলে গিয়েছিল যে মনে হচ্ছিল, তিনি অন্তঃসত্ত্বা। এমন দুঃসহ যন্ত্রণা কখনও অনুভব করেননি। র্যানকিনের কথায়, ‘‘বেঁচে ফিরতে যে পারব না, তা নিয়ে নিশ্চিত ছিলাম আমি।’’
তবে আশ্চর্যজনক ভাবে বেঁচে ফিরেছিলেন র্যানকিন। বিমানের বাইরে বেরিয়ে বজ্রগর্ভ মেঘের মধ্যে পড়েছিলেন। ঘুরপাক খেতে খেতে নীচে পড়তে শুরুও করেন। তার মধ্যেই কোনও ভাবে অক্সিজেনের নলটি নিজের মুখে গুঁজে দিয়েছিলেন। এ ভাবে যেন মৃত্যুর কাছ থেকে কিছুটা সময় কিনে নিয়েছিলেন র্যানকিন। শূন্যে থাকার সময় প্রায় ১০ হাজার ফুট উপরে থাকার সময় স্বয়ংক্রিয় ভাবে প্যারাশুট খুলে যায়।
ঘন মেঘের মধ্যে দিয়ে নীচে নামার সময় ঘড়ির দিকে এক বার চোখ পড়েছিল র্যানকিনের। প্রায় পাঁচ মিনিট কেটে গিয়েছে। এক সময় অক্সিজেনও ফুরিয়ে যায়। তবে সে সময় বায়ুর ঘনত্ব যে মাত্রায় ছিল, তাতে সাধারণ ভাবে শ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছিল না।
এ ভাবেই প্রায় ১০ মিনিট কেটে গিয়েছিল। আচমকা দমকা হাওয়ায় তাকে ঘন মেঘের ভিতরে ঠেলে দিয়েছিল। হাওয়ার বেগে ওঠানামা করছিলেন র্যানকিন। তিনি লিখেছেন, ‘‘নীচে পড়তে পড়তে দেখেছিলাম, আমার আশপাশে হাওয়ার সমুদ্রের রক্তচক্ষু। সবই টগবগ করে ফুটছে। কোথাও গাঢ় কালো, কোথাও বা ধূসর অথবা ধবধবে সাদা।’’
ঘূর্ণি হাওয়ার মধ্যে এক সময় শিলাবৃষ্টি শুরু হয়েছিল। র্যানকিনের মনে হয়েছিল, যেন তিনি সুইমিং পুলের মধ্যে রয়েছেন। তবে তাতে প্রতি বারই ডুবে যাচ্ছিলেন তিনি। তাই বার বার দমবন্ধ করতে হচ্ছিল।
অবশেষে বৃষ্টির দাপট কমতে থাকে। এক সময় র্যানকিন দেখেন, মাটি থেকে প্রায় ২০০-৩০০ ফুট উপরে রয়েছেন তিনি। প্যারাশুটে জড়িয়ে কোনও মতে মাটিতে নামলেও গোড়ায় র্যানকিনের উদ্ধারে এগিয়ে আসেননি কেউ।
রক্তাক্ত, হাড়ভাঙা, বমিতে মাখামাখি হয়ে মাটিতে নেমে র্যানকিন দেখেন, ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিট। অর্থাৎ ৪০ মিনিট ধরে দানবিক মেঘের গুঁতো খেয়েছেন তিনি। কোনও মতে রাস্তা খুঁজে পেলেও তত ক্ষণে প্রায় এক ডজন গাড়ি তাঁর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। তবে কেউ তাঁকে লিফ্ট দিতে রাজি হয়নি।
শেষমেশ র্যানকিনকে উদ্ধার করে একটি দোকানে নিয়ে যান এক গাড়িমালিক। সেখান থেকেই ফোন করে ডাকা হয় অ্যাম্বুল্যান্স। নর্থ ক্যারোলাইনার একটি হাসপাতালে দীর্ঘ দিন তাঁর চিকিৎসা চলেছিল। বরফের ক্ষতের মতো হাতে, মুখে, গোটা শরীরে ক্ষত হয়ে গিয়েছিল তাঁর। বেশ কয়েক সপ্তাহ পর সুস্থ হয়ে ফের কাজে যোগ দেন র্যানকিন।