ডুবোযান টাইটান কি আদৌ দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিল? যদি দুমড়ে-মুচড়ে গিয়ে থাকে, তা হলে কেনই বা এই ঘটনা ঘটল? সবই এখন তদন্তসাপেক্ষ।
গত ১৮ জুন অতলান্তিকের গভীরে অভিযান শুরু করেছিল টাইটান। অভিযান শুরুর পৌনে ২ ঘণ্টার মধ্যে সহযোগী জাহাজ ‘পোলার প্রিন্স’-এর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। জল্পনা শুরু হয়েছে, তা হলে কি মাঝপথেই বিপদগ্রস্ত হয়েছিল ডুবোযানটি?
২০০৯ সালে গভীর সমুদ্রে অভিযান শুরু করেছিল আমেরিকার ওশানগেট সংস্থা। এই সংস্থার তিনটি ডুবোযান আছে। যেগুলি অতলান্তিক, প্রশান্ত মহাসাগর এবং মেক্সিকো উপসাগরের গভীরে অভিযান চালায়। এখনও পর্যন্ত মোট ২০০টি অভিযান চালিয়েছে ওশানগেট সংস্থা।
অতলান্তিকের সাড়ে ১২ হাজার ফুট গভীরে ‘শায়িত’ টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখানোর জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে বানানো হয়েছিল ডুবোযান টাইটানকে। ২২ ফুটের এই ডুবোযানের ওজন ৯,৫২৫ কেজি। কার্বন ফাইবার এবং টাইটানিয়াম দিয়ে তৈরি এই ডুবোযান।
ওশানগেট এক্সপিডিশনস-এর তথ্য অনুযায়ী, টাইটান একসঙ্গে পাঁচ জন যাত্রীকে বহন করতে পারে। শুধু তাই নয়, সমুদ্রের ১৩,১২০ ফুট গভীর পর্যন্ত যাওয়ার ক্ষমতা রয়েছে এই ডুবোযানের। ঘটনাচক্রে, অতলান্তিকের সাড়ে ১২ হাজার ফুট গভীরে রয়েছে বিলাসবহুল জাহাজ টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ।
ওশানগেট-এর তথ্য অনুযায়ী, ইলেকট্রিক থ্রাস্টারের সাহায্যে ৩ নট বা সাড়ে ৩ মাইল (সাড়ে ৫) প্রতি ঘণ্টায় দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে টাইটান। এতে ছিল জোরালো এলইডি আলো, শব্দতরঙ্গ পদ্ধতি এবং জোরালো ক্যামেরা।
৯ ফুট চওড়া এই ডুবোযানে সওয়ারিদের জন্য খুবই অল্প জায়গা থাকে। দাঁড়ানোর বা হাঁটু মুড়ে বসার মতো জায়গাও থাকে না। সওয়ারিদের একে অপরের গা ঘেঁষে বসতে হয় ডুবোযানের ধাতব মেঝেতে। পা ছড়ানোর মতো জায়গাও নেই এই ডুবোযানে।
এই ডুবোযানে কোনও জানলা নেই। শুধু একটি ‘পোর্টহোল’ আছে। সেই ‘পোর্টহোল’ দিয়েই টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ চাক্ষুষ করার সুযোগ মেলে সওয়ারিদের। তা ছাড়া একটি শৌচাগার রয়েছে এই ডুবোযানে।
গভীর সমুদ্র অভিযানের জন্য টাইটানে ৯৬ ঘণ্টার মতো অক্সিজেন মজুত করা থাকে। সমুদ্র বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি এটি দুমড়ে-মুচড়ে না-ও যেত, তা হলেও সওয়ারিদের মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকত কারণ, টাইটানের হদিস মিলেছে অভিযান শুরুর চার দিন পর। ওই সময়ে ডুবোযানের অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যেত। আর এই অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ার কারণে মৃত্যু হতে পারত সওয়ারিদের।
টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখানোর জন্য টাইটানের প্রথম অভিযান শুরু হয় ২০২১ সালে। এর পর ২০২২ সালে আরও এক বার অভিযান চালায় ওশানগেট সংস্থা। বিবিসি-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে আমেরিকার আদালতে ওশানগেট দাবি করেছিল, টাইটানের ৫০ বার পরীক্ষামূলক অভিযান চালানো হয়েছে। সেই অভিযানের তালিকায় টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষও ছিল।
ওশানগেট আরও দাবি করেছিল যে, ২০২১ এবং ’২২ সালে মোট ৪৬ জন অভিযাত্রীকে সফলমূলক ভাবে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শন করিয়ে আনা হয়েছিল টাইটান ডুবোযানে। সংস্থাটি আরও দাবি করেছিল যে, আপৎকালীন পরিস্থিতিতে এই ডুবোযানটি ভেসে ওঠার জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তিরও ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও টাইটানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় ওশানগেটকে।
২০২২ সালে গভীর সমুদ্র অভিযানের সময় ডুবোযানের ব্যাটারিতে সমস্যা দেখা দেয়। তার পর সেটিকে জলের উপরে তুলে আনার ব্যবস্থা করা হয়। ২০১৮ সালে ওশানগেটের এক কর্মী ডেভিড লকরিজ ডুবোযানটির নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে সতর্ক করেছিলেন। এই সমস্যা নিয়ে মুখ খোলায় তাঁকে কাজ খোয়াতেও হয়।
টাইটানিক পরিদর্শনের জন্য ১০ ঘণ্টা গভীর সমুদ্র অভিযানের জন্য সওয়ারিপিছু ভাড়া নেওয়া হয় ২ লক্ষ ৫০ হাজার ডলার। ২০ মিনিট ধরে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখানো হয়।
আমেরিকার উপকূলরক্ষী বাহিনী জানিয়েছে, গত ১৮ জুন গ্রিনিচ সময় অনুযায়ী (জিএমটি) দুপুর ১২টা নাগাদ পাঁচ অভিযাত্রীকে নিয়ে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শনে অতলান্তিকের ১৩ হাজার ফুট গভীরে নেমেছিল টাইটান।
সমুদ্রের উপরে থাকা সহযোগী জাহাজ ‘পোলার প্রিন্স’কে প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর সিগন্যাল পাঠানোর কথা ছিল টাইটানের। কিন্তু দুপুর পৌনে ২টো নাগাদ টাইটানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে টাইটানের ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও টাইটান না ফেরায় আমেরিকার উপকূলরক্ষী বাহিনীর কাছে খবর পৌঁছয়।