কখনও ভারতীয় শিল্পপতি গৌতম আদানির সংস্থা। কখনও আবার বৈদ্যুতিক ট্রাক প্রস্তুতকারী সংস্থা নিকোলা কর্পোরেশন। একের পর এক কর্পোরেট সংস্থার বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও কারচুপির অভিযোগ এনে সারা দুনিয়ায় রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিল হিন্ডেনবুর্গ রিসার্চ। এ হেন তোলপাড় ফেলে দেওয়া আমেরিকান শর্ট সেলার সংস্থাটি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে খবর প্রকাশ্যে এসেছে।
চলতি বছরের (পড়ুন ২০২৫) ১৫ জানুয়ারি, হিন্ডেনবুর্গ রিসার্চের দফতরে তালা ঝোলানোর কথা ঘোষণা করেন এর প্রতিষ্ঠাতা নাথান অ্যান্ডারসন স্বয়ং। সংস্থার ওয়েবসাইটে তিনি লিখেছেন, ‘‘হাতে জমে থাকা কাজ শেষ করে সংস্থা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সেই দিনটা এসে গিয়েছে। এ বার তাই হিন্ডেনবুর্গ রিসার্চ ভেঙে দিচ্ছি।’’
নাথান জানিয়েছেন, অল্প সময়ের জন্য হলেও হিন্ডেনবুর্গ রিসার্চে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন তিনি। সংস্থা বন্ধ করার নেপথ্যে কারও হুমকি-হুঁশিয়ারি বা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যার কোনও যোগ নেই বলে স্পষ্ট করেছেন শর্ট সেলারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। পাশাপাশি, জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনার ইঙ্গিত দিয়েছেন অ্যান্ডারসন।
২০১৭ সালে ‘হিন্ডেনবুর্গ রিসার্চ’ প্রতিষ্ঠা করেন নাথান। এটি ছিল একটি ফরেন্সিক আর্থিক গবেষণা সংস্থা, যা বিভিন্ন কোম্পানির ‘ইক্যুইটি’, ‘ক্রেডিট’ এবং ‘ডেরিভেটিভস’ বিশ্লেষণ করত। হিন্ডেনবুর্গের ওয়েবসাইটে বলা আছে, অর্থনীতিতে ‘মানবসৃষ্ট বিপর্যয়’ আটকাতে বিভিন্ন সংস্থার দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এবং গোপনে চলা লেনদেনগুলির উপর নজরদারি চালায় তারা।
১৯৩৭ সালের ৬ মে নিউ জার্সিতে উড়ে যাওয়ার পথে মাঝ আকাশে আগুন লেগে ধ্বংস হয় ‘হিন্ডেনবুর্গ এয়ারশিপ’। বিলাসবহুল সেই জার্মান উড়োজাহাজ মাটিতে আছড়ে পড়ায় যাত্রী এবং কর্মী-সহ প্রাণ হারান ৩৬ জন। সেই বিমানের নামেই সংস্থার নামকরণ করেন নাথান। নিজেদের সংস্থার খরচও নিজেরাই চালাত হিন্ডেনবুর্গ। নজরদারির জন্য কারও থেকে টাকা নেওয়া হত না বলে ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়েছিল।
হিন্ডেনবুর্গের প্রতিষ্ঠাতা নাথান ‘ইউনিভার্সিটি অফ কানেকটিকাট’ থেকে আন্তর্জাতিক ব্যবসা (ইন্টারন্যাশনাল বিজ়নেস) নিয়ে স্নাতক হন। এর পর তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ‘ফ্যাক্টসেট রিসার্চ সিস্টেমস ইনকর্পোরেটেড’-এর আর্থিক দফতরে (ফিনান্স) কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। সেখানে নিজের সংস্থার সঙ্গে অন্য বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা সংস্থাগুলির মেলবন্ধন ঘটানোর কাজ করতেন ম্যানহাটনের একটি ছোট অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা নাথান।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইজ়রায়েলে বেশ কিছু দিন অ্যাম্বুল্যান্স চালকের কাজ করেন অ্যান্ডারসন। সমাজমাধ্যম ‘লিঙ্কডইন’-এ নাথান লিখেছেন, তিনি এমন এক জন মানুষ যিনি অতিরিক্ত চাপের মধ্যেও সঠিক চিন্তাভাবনা এবং সঠিক কাজ করতে সক্ষম।
নাথানের হাতে গড়া সংস্থা কোনও কোম্পানির সম্ভাব্য আর্থিক কেলেঙ্কারিগুলি খুঁজে বার করার পর তা নিয়ে ‘হিন্ডেনবুর্গ রিসার্চ রিপোর্ট’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করত। ২০২২ সালে শিল্পপতি গৌতম আদানি এবং তাঁর সংস্থাকে নিয়ে বিস্ফোরক রিপোর্ট প্রকাশ করেন তাঁরা। এর পরই ভারত জুড়ে হইচই পড়ে যায়।
হিন্ডেনবুর্গ রিসার্টের রিপোর্টে দাবি করা হয়, আদানি গোষ্ঠী কারচুপি করে নিজেদের সংস্থার শেয়ারের দর বাড়িয়েছে। তাঁদের স্টকের হিসাবে যথেষ্ট গরমিল রয়েছে। আমদানির খরচ বেশি দেখিয়ে নথি তৈরি এবং ঘুরপথে নিজেদের সংস্থার শেয়ারই কিনে নিয়ে কৃত্রিম ভাবে দাম বাড়ানোর মতো মারাত্মক অভিযোগ তোলে নাথানের সংস্থা।
আমেরিকার শর্ট সেলার সংস্থাটির তোলা অভিযোগ সঙ্গে সঙ্গে অস্বীকার করে আদানি গোষ্ঠী। কিন্তু তার পরও আর্থিক বিপর্যয় আটকাতে পারেননি গুজরাতের এই শিল্পপতি। ঘরোয়া বাজারে হু হু করে পড়ে যায় তাঁর সংস্থাগুলির শেয়ারের দর। ফলে ভারত তথা এশিয়ার ধনকুবের গৌতম আদানির সম্পত্তির পরিমাণ এক ধাক্কায় প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল।
আদানিদের আগেও ছোট-বড় অনেক সংস্থা নাথান এবং তাঁর সংস্থার ‘নেকনজরে’ পড়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত নিকোলা গোষ্ঠীর ‘কেলেঙ্কারি’। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে বৈদ্যুতিক ট্রাক প্রস্তুতকারক নিকোলা কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ আনে হিন্ডেনবুর্গ রিসার্চ।
হিন্ডেনবুর্গের রিসার্চ রিপোর্টে দাবি করা হয় যে, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের মিথ্যা কথা বলেছে নিকোলা। ‘নিকোলা’ সেই সময় ইলন মাস্কের স্বয়ংক্রিয় এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত বৈদ্যুতিক গাড়ির সংস্থা ‘টেসলা’র সঙ্গে টক্কর দেওয়ার চেষ্টা করছিল।
ওই সময়ে বাজারে এমন গুজবও রটেছিল যে, প্রযুক্তিতে ‘টেসলা’কে সহজেই টেক্কা দেবে ‘নিকোলা’। ‘নিকোলা’র পোস্ট করা গাড়ির ভিডিয়ো দেখে মানুষের মধ্যে এই ধারণা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু হিন্ডেনবুর্গ খুঁজে বার করে যে, ওই ভিডিয়োগুলি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে তৈরি করা হয়েছিল এবং ভুয়ো।
হিন্ডেনবুর্গের রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর ‘নিকোলা’র প্রতিষ্ঠাতা ট্রেভর মিল্টনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছিল। গত বছর বিনিয়োগকারীদের মিথ্যা বলার এবং জালিয়াতির অভিযোগে ট্রেভরকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। শাস্তি হিসাবে বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি টাকা ফেরত দিতে হয় তাঁকে।
নিকোলার বাজারমূল্যও ৩৪০০ কোটি ডলার থেকে কমে ১৩৪ কোটি ডলারে নেমে এসেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ সংস্থাগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে শুরু করে হিন্ডেনবুর্গ এখনও পর্যন্ত অন্তত ১৬টি সংস্থার আর্থিক কারচুপির রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।
কিছু দিন আগে ভারতের শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা সেবির (সিকিউরিটিজ় অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া) প্রধান মাধবী পুরী বুচ এবং তাঁর স্বামীকে নিশানা করে হিন্ডেনবুর্গ রিসার্চ। যদিও একে ‘চরিত্র হননের চেষ্টা’ বলে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেন তিনি।
একটা সময়ে এক সাক্ষাৎকারে অ্যান্ডারসন জানিয়েছিলেন যে, তিনি হ্যারি মার্কোপোলোসকে দেখে অনুপ্রাণিত। হ্যারি আমেরিকার কুখ্যাত জালিয়াত বার্নি ম্যাডফের কুকীর্তি প্রকাশ্যে এনেছিলেন।
নাথান ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন না। প্রভাবশালীদের সঙ্গে ওঠাবসা বা বিপুল অর্থের জোগান ছিল না তাঁর। ফলে তাবড় শক্তিশালী ব্যক্তিদের আর্থিক দুর্নীতির পর্দাফাঁস করতে গিয়ে বিস্তর ঝামেলা পোহাতে হয়েছে তাঁকে। এক বার সদ্যোজাত সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ছাড়ার উপক্রম হয়েছিল অ্যান্ডারসনের। কিন্তু তখনও দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এখন হঠাৎ করে তিনি হিন্ডেনবুর্গ রিসার্চ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় প্রশ্ন উঠছে।