রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছে সুদানে। উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার এই দেশটিতে গত কয়েক দিনে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। যুদ্ধের বিষবাষ্প ছেয়ে গিয়েছে গোটা দেশে।
পরিসংখ্যান বলছে, সুদানের যুদ্ধে তিন সপ্তাহে ৬০০-র বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সেই দেশে কর্মরত শয়ে শয়ে ভারতীয় যুদ্ধের আবহে প্রাণের দায়ে দেশে ফিরে এসেছেন।
সুদানের চলতি গৃহযুদ্ধে মূল প্রতিপক্ষ সে দেশের সশস্ত্র বাহিনীরই দুই জেনারেল— সেনাপ্রধান আবদেল আল ফতা আল বুরহান ও জেনারেল মহম্মদ হামদান দাগালো। ফলে এই যুদ্ধ আদ্যোপান্ত সুদানের অভ্যন্তরীণ।
কিন্তু সুদানের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ থামাতে তৎপর হয়ে উঠেছে সৌদি আরব। পশ্চিম এশিয়ার এই দেশের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। যুদ্ধ থামাতে নানা ভাবে চেষ্টা করছে সৌদি সরকার।
সুদানের যুদ্ধ থামাতে আফ্রিকান ইউনিয়নও সচেষ্ট হয়েছে। পূর্ব এবং হর্ন অফ আফ্রিকার আঞ্চলিক জোট ইগাড প্রথম থেকেই শান্তির পক্ষে কথা বলছে। কিন্তু যুদ্ধ মীমাংসায় সবচেয়ে সক্রিয় সৌদি।
কিন্তু কেন? সুদানের গৃহযুদ্ধ নিয়ে সৌদির এত আগ্রহ কিসের? শুধুই কি মানবতার খাতিরে যুদ্ধ থামাতে তারা উঠেপড়ে লেগেছে? না কি এর নেপথ্যে সৌদির অন্য কোনও স্বার্থ জড়িয়ে আছে?
বিবিসি-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুদানের রাজনীতির সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরেই জড়িত পশ্চিম এশিয়া। আরব দেশগুলি সুদানের রাজনীতি এবং অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। এ ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য অবশ্যই সৌদি।
ইতিহাস বলছে, সুদানের রাজনৈতিক, সামাজিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে। তারা মনে করে, সুদানের নিরাপত্তা, রাজনৈতিক শ্রীবৃদ্ধির দায়িত্ব আসলে তাদেরই।
বিবিসি-র প্রতিবেদনে দাবি, সৌদি চায় না সুদানে কোনও ইসলামপন্থী সরকার গঠিত হোক। তা যদি হয়, তবে সেই নতুন সুদান সৌদি বা পশ্চিম এশিয়ার অন্য আরব দেশগুলির পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে।
সুদানে দীর্ঘ ৩০ বছর ক্ষমতাসীন ছিলেন স্বৈরতান্ত্রিক শাসক ওমর আল বশির। ২০১৯ সালে প্রবল গণবিক্ষোভ এবং গণঅভ্যুত্থানে তাঁর পতন হয়। তার পর থেকে সুদানে কোনও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।
প্রভাবশালী সামরিক গোষ্ঠীর নেতারা, এবং অসামরিক নেতারা মিলে একটি পরিচালন পর্ষদ (কাউন্সিল) গঠন করে নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির ব্যবস্থা করেন সুদানে। পরে অসামরিক এক সরকারের হাতে দেশের ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু ২০২১-এর অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী আবদুল্লা হামদকের নেতৃত্বাধীন সেই অন্তর্বর্তী সরকারকেও উৎখাত করে সেনাবাহিনী।
সেনাপ্রধান বুরহান ২০২৩ সালে দেশে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তার আগে সেনা এবং আধা সেনার মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। যা গৃহযুদ্ধের রূপ নিয়েছে।
পর্যবেক্ষকদের বক্তব্য, সৌদির মদতেই সুদানে নির্বাচন বন্ধ রাখা হয়েছিল। বুরহানের নির্বাচনের ঘোষণাকে তাই সৌদি বা সংযুক্ত আরব আমিরশাহি ভাল চোখে দেখেনি।
সুদানের গৃহযুদ্ধে জেনারেল দাগালোর বাহিনীকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে বুরহানের বাহিনী। যা সৌদির চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধে দাগালো যদি হেরে যান, তবে বুরহানের কথা অনুযায়ী নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে ইসলামপন্থী সরকার গঠিত হতে পারে।
সুদানে নির্বাচন হলে ইসলামপন্থীরাই জিতবেন, তা এক প্রকার নিশ্চিত। তাই পশ্চিম এশিয়া থেকে আফ্রিকার যুদ্ধ থামাতে উঠেপড়ে লেগেছে সৌদি আরব। তার মধ্যস্থতায় যুদ্ধ থামাতে জেড্ডায় আলোচনা শুরু করেছে দুই প্রতিপক্ষ।
লোহিত সাগরের উপকূলবর্তী এলাকায় বিভিন্ন বাণিজ্যে ঢালাও বিনিয়োগ রয়েছে সৌদির। তাদের আশঙ্কা, সুদানের গৃহযুদ্ধের রেশ অন্যত্র ছড়িয়ে পড়লে সৌদির অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরও কঠিন হয়ে পড়বে।
সুদানকে শান্ত রেখে তাই লোহিত সাগর সংলগ্ন এলাকায় নিজের আধিপত্য কায়েম রাখতে চাইছে সৌদি। তা ছাড়া, সুদানে তাদের কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। ইসলামপন্থী সরকার সেখানে গড়ে উঠলে অর্থনৈতিক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
সৌদির মধ্যস্থতায় কি কাজ হবে? সুদানে সংঘর্ষরত দুই সেনাগোষ্ঠী কি আদৌ ক্ষমতার লড়াইয়ে পিছু হঠতে চাইবে? এমনই অনেক প্রশ্ন বর্তমানে ঘুরে বেড়াচ্ছে লোহিত সাগরের আকাশে।
পর্যবেক্ষকেরা জানাচ্ছেন, বুরহান কিংবা দাগালো, উভয়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তাঁরা সৌদির মধ্যস্থতায় বৈঠকে হাজির থাকলেও নিজ নিজ স্বার্থ কায়েমের চেষ্টাই করবেন।
সংযুক্ত আরব আমিরশাহির ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। অনেকে মনে করছেন, তারাও এই গৃহযুদ্ধে গোপনে মদত দিয়ে চলেছে। ফলে সুদানের ভবিষ্যৎ কোন খাতে বইবে, সে দিকে নজর রেখেছে গোটা বিশ্ব।