চার বছর পর হোয়াইট হাউসে ফেরা নিশ্চিত। ফ্লরিডার ওয়েস্ট পাম বিচে জয়সূচক ভাষণ দেওয়ার সময় গড়গড়িয়ে যে কথাগুলি ট্রাম্প বললেন তার নির্যাস হল, “আমাদের নতুন তারকার জন্ম হয়েছে। তিনি ইলন।’’ কারও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, এই তারকা ইলন আসলে আমেরিকার ধনকুবের তথা বেসরকারি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘স্পেস এক্স’-এর মালিক ইলন মাস্ক।
বুধবার জয় প্রায় নিশ্চিত করার পর ভারতীয় সময় দুপুর ১টা নাগাদ পরিবার, বন্ধুবান্ধব, সমর্থক, প্রচার টিমের সদস্যদের ধন্যবাদ জানাচ্ছিলেন ট্রাম্প। ঠিক তখনই দর্শকদের একাংশ চিৎকার শুরু করেন। টেসলার কর্ণধার ইলনের নাম নিয়ে চেঁচাতে শুরু করেন তাঁরা।
দর্শকদের নাড়ি বুঝে ট্রাম্পও প্রশংসা শুরু করেন ইলনের। ইলনকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়ে জানান, এক নতুন তারকার জন্ম হয়েছে এবং সেই তারকার নাম ইলন মাস্ক।
আমেরিকার ভাবী প্রেসিডেন্ট যে ইলনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবেন, তা বলাই বাহুল্য। আমেরিকায় ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিন্টনের নীতিকে সমর্থন করেছিলেন ইলন। মন্তব্য করেছিলেন, ঠিক প্রেসিডেন্ট-সুলভ নন ট্রাম্প। আর আট বছর পর সেই সমীকরণ বদলেছে। ট্রাম্পের প্রচারে দ্বিতীয় বৃহত্তম অনুদানের জোগাড় করেছেন ইলনই।
এ বারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রচার পর্বের শুরু থেকেই রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্পের সমর্থন গলা ফাটাতে দেখা গিয়েছে ধনকুবেরকে। হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন হলে তিনি প্রশাসনিক দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত বলেও ইলন জানিয়েছিলেন।
ট্রাম্পের তারকা-প্রচারকও ছিলেন মাস্ক। ট্রাম্প জানিয়েছেন, ফিলডেলফিয়ায় টানা দু’সপ্তাহ তাঁর হয়ে প্রচারকাজ সেরেছিলেন মাস্ক। বিভিন্ন সাক্ষাৎকার এবং পডকাস্টেও ট্রাম্পের সমর্থনে কথা বলতে শোনা গিয়েছে সমাজমাধ্যম এক্সের কর্ণধারকে। উল্টো দিকে বার বার মাস্ক এবং তাঁর বিভিন্ন সংস্থার প্রশংসা করেছেন ট্রাম্পও।
উল্লেখ্য, ইলেক্টোরাল ভোটে ট্রাম্পের জয় যখন স্পষ্ট হতে শুরু করেছে, তখনই নিজের এক্স প্ল্যাটফর্মে ট্রাম্পের উদ্দেশে মাস্ক লেখেন, ‘‘আমেরিকার মানুষ পরিবর্তনের পক্ষে স্পষ্ট রায় দিয়েছেন।’’
তবে বন্ধুর জেতায় শুধুই কি মানসিক শান্তি হয়েছে ইলনের? না কি ট্রাম্পের হোয়াইট হাউস ফেরা পাকা হতে অন্য লাভও হয়েছে বা হতে পারে টেসলা কর্তার?
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই কিন্তু মনে করছেন, ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়ায় অনেক লাভ ইলনের।
অনেকে এ-ও মনে করছেন, অনেক অঙ্ক কষে, অনেক আটঘাট বেধে তবেই ট্রাম্পের সমর্থনে নেমেছিলেন মাস্ক। উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়ের পথ পরিষ্কার হওয়ার পর থেকেই টেসলার শেয়ার দর ১৪ শতাংশ বেড়েছে।
সংবাদমাধ্যম ‘এনবিসি নিউজ়’ অনুযায়ীও প্রেসিডেন্ট হিসাবে ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে ফেরার পর উল্লেখযোগ্য ভাবে লাভের মুখ দেখতে পারে ট্রাম্পের মালিকানাধীন বিভিন্ন সংস্থা।
দ্বিতীয় ট্রাম্প জমানায় প্রশাসনিক দিক থেকেও ইলন প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করতে পারেন বলে মনে করছেন অনেকে।
ট্রাম্পের অন্যতম মুখ্য প্রচার উপদেষ্টা ব্রায়ান হিউজ উল্লেখ করেছেন যে, সরকারকে আরও দক্ষ করে তুলতে এবং করের টাকা আরও ভাল ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইলনের নেতৃত্বে একটি কমিটি তৈরির পরিকল্পনা করছেন ট্রাম্প।
মাস্কের প্রশংসা করে ব্রায়ান তাঁকে ‘একজন প্রতিভাবান উদ্ভাবক’ বলেও অভিহিত করেছেন এবং এ-ও উল্লেখ করেছেন যে, ‘‘সৃজনশীল, আধুনিক এবং দক্ষ সিস্টেম তৈরি করে আক্ষরিক অর্থে ইতিহাস তৈরি করে ফেলেছেন মাস্ক।’’
হিউজ আরও যোগ করেছেন যে, ট্রাম্পের বিশ্বাস, ফেডারেল সরকারের কার্যকারিতা উন্নত করতে সব রকম সহায়তা করতে পারেন মাস্ক।
অন্য দিকে বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, ট্রাম্পের কম কর নীতির কারণেও বিশেষ সুবিধা মিলতে পারে মাস্কের সংস্থাগুলিকে। প্রচারের শুরু থেকেই বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এবং ধনীদের জন্য কম কর বজায় রাখার বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন ট্রাম্প। প্রথম ট্রাম্প জমানাতেও কর্পোরেট করের হার ৩৫ শতংশ থেকে কমিয়ে ২১ শতাংশ করে দিয়েছিলেন ট্রাম্প।
এ বারের নির্বাচনী প্রচারেও বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন ট্রাম্প। কর্পোরেট কর কমানোর ইচ্ছাও প্রকাশ করেছিলেন। আর এখন ট্রাম্প যদি তা কার্যকর করেন তা হলে অনেক লাভের মুখ দেখবেন ইলনের মতো ধনকুবেররা।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মাস্কের বিভিন্ন সংস্থা, বিশেষ করে স্পেসএক্সের মতো সংস্থার উপর সরকারের নিয়ন্ত্রক চাপ এবং নজরদারি কমতে পারে বলেও মনে করছেন অনেকে।
স্পেসএক্স ইতিমধ্যেই শত শত কোটি টাকার যে সরকারি চুক্তিগুলি প্রতিরক্ষা বিভাগ এবং মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সঙ্গে করেছে, তা আরও বেশ কয়েক বছর নিশ্চিন্তে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
স্পেসএক্স একমাত্র সংস্থা, যা বর্তমানে ‘ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন’-এ মহাকাশচারীদের নিয়ে যাতায়াত করতে পারে। ট্রাম্প জমানায় সেই চুক্তিও বজায় থাকতে পারে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
গনজাগা ইউনিভার্সিটির আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাঞ্জেলা অ্যানিরোস জানিয়েছেন, দ্বিতীয় ট্রাম্পের অনেক নীতিই মাস্কের ব্যবসায়িক উদ্যোগকে উপকৃত করবে। আমেরিকার তদন্ত সংস্থাও মাস্কের সংস্থাগুলি থেকে আপাতত তাদের নজর ঘুরিয়ে রাখতে পারে।