রতন টাটার মৃত্যুর পরেই তাঁর সম্ভাব্য উত্তরসূরি বেছে নেওয়ার জল্পনা শুরু হয়েছে নানা মহলে। টাটা গোষ্ঠীর পরবর্তী উত্তরসূরি কাকে নির্বাচন করা হবে সেই দিকেই তাকিয়ে গোটা দেশ।
৯ অক্টোবর শিল্পপতি রতন টাটা প্রয়াত হয়েছেন। বয়সজনিত সমস্যা নিয়ে মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান এমিরেটাস। বুধবার রাতে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর।
নিঃসন্তান রতন টাটার এই সুবিশাল সাম্রাজ্যের দায়িত্ব কে কাঁধে নেবেন? কে এগিয়ে নিয়ে যাবেন টাটা গোষ্ঠীকে?
টাটা গোষ্ঠীর উত্তরসূরি হিসাবে যাঁদের নাম সম্ভাব্য তালিকায় উঠে এসেছে তাঁর মধ্যে অন্যতম নটরাজন চন্দ্রশেখরন। সূত্র বলছে, টাটা গোষ্ঠীর পরিচালনভার তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে চন্দ্রশেখরনের পাল্লাই ভারী।
কিন্তু কে এই চন্দ্রশেখরন? কী ভাবেই বা উত্থান তাঁর? প্রথমেই জেনে রাখা দরকার চন্দ্রশেখরন টাটা গোষ্ঠীর প্রথম সর্বোচ্চ পদাধিকারী, যিনি পার্সি নন। চন্দ্রই প্রথম ব্যক্তি যিনি পার্সি সম্প্রদায়ভুক্ত না হলেও টাটা গোষ্ঠীর সর্বোচ্চ পদে বসেছেন। সে সময় একটি সার্চ কমিটির সুপারিশের মাধ্যমে নিয়োগ করা হয়েছিল চন্দ্রকে।
টাটা সন্সের চেয়ারম্যান মনোনীত হওয়ার আগে থেকেই শিল্পপতি রতন টাটার ঘনিষ্ঠ বৃত্তের একজন হিসাবে পরিচিত চন্দ্রশেখরন। চন্দ্রশেখরনের উপর অগাধ আস্থা ছিল রতনের।
২০১৬ সালের ৪ অক্টোবর সাইরাস মিস্ত্রিকে সরিয়ে দেওয়ার পরে টাটা সন্সের অন্তর্বর্তী চেয়ারম্যান হিসাবে ফেরেন রতন টাটা। উত্তরাধিকারীর খোঁজে গড়া হয় কমিটি। চন্দ্রের নাম শোনা যায় তখন থেকেই।
২০১৭ সালে নতুন চেয়ারম্যানের নাম ঘোষণা করে টাটা গোষ্ঠী। টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস (টিসিএস)-এর সিইও নটরাজন চন্দ্রশেখরনকে টাটা সন্সের পরবর্তী চেয়ারম্যান হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল।
বর্তমানে দেশের তথা বিশ্বের অন্যতম শিল্পগোষ্ঠীর চেয়ারম্যান হলেও চন্দ্রশেখরনের ছোটবেলা কেটেছিল অর্থাভাবে। ১৯৬৩ সালে তামিলনাড়ুর মোহানুর গ্রামে চন্দ্রশেখরনের জন্ম। কৃষক পরিবারের সন্তান চন্দ্রশেখরনের প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন গ্রামেরই একটি সরকারি স্কুল থেকে।
কম্পিউটারের প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখে তাঁকে ‘কোয়ম্বত্তূর ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি’তে ভর্তি করানো হয়। সেখানে ফলিত বিজ্ঞান (অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স) নিয়ে পড়াশোনা করে স্নাতক হন তিনি। কম্পিউটার নিয়ে আরও পড়াশোনা করার ইচ্ছা থেকে তিরুচিরাপল্লীর একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ‘কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনস’ নিয়ে ভর্তি হন চন্দ্রশেখরন।
১৯৮৭ সালে কর্মজীবন শুরু করেন চন্দ্রশেখরন। টিসিএসে ইন্টার্ন হিসাবে যোগ দেন তিনি। এর পর থেকেই টাটা গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ক্রমেই দৃ়ঢ় হতে থাকে। দু’দশকের মধ্যেই সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উত্থান হতে থাকে নটরাজনের।
চন্দ্রকে কাছ থেকে চেনা অনেকে বলেন, তিনি আদ্যন্ত নেতা। ম্যানেজমেন্টের ডিগ্রি তাঁর নেই। কিন্তু সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলে নেতৃত্ব দেওয়ায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার।
চন্দ্রের দূরদর্শিতার প্রমাণ মিলেছিল অচিরেই। টাটা গোষ্ঠীর সর্বেসর্বা হিসাবে তাঁর আমলেই গোষ্ঠীর মোট মুনাফা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়। ২০১৭ সালে গোষ্ঠীর মোট মুনাফা ছিল ৩৬,৭২৮ কোটি টাকা। তবে ২০২২ সালে তা দাঁড়িয়েছিল ৬৪,২৬৭ কোটিতে।
টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান হিসাবে টাইটানস, টাটা স্টিল, টাটা মোটরস, টাটা পাওয়ার এবং টিসিএস-সহ অনেক সংস্থার দায়িত্বে রয়েছেন চন্দ্রশেখরন।
শিক্ষানবিশের চাকরি থেকে টাটা গোষ্ঠীর শীর্ষকর্তা হয়ে ওঠা চন্দ্রের আয় কত? সংবাদমাধ্যমের দাবি, চেয়ারম্যান হিসাবে ২০২১-২২ অর্থবর্ষে চন্দ্রের বেতন ছিল ১০৯ কোটি টাকা। দিনে তাঁর আয় ৫৩ লক্ষ।
২০২০ সালে একটি বিলাসবহুল আবাসন কিনে আবার শিরোনামে উঠে এলেছিলেন চন্দ্র। মুম্বইয়ের পেডার রোডে ওই ডুপ্লে-র জন্য তিনি ৯৮ কোটি খরচ করেছিলেন। ৬,০০০ বর্গফুটের ওই ফ্ল্যাটের জন্য নাকি প্রতি মাসে ২০ লক্ষ টাকা খরচ করতেন চন্দ্র। শেষমেশ সেটি কিনে ফেলেন তিনি।
কৃষকের সন্তান হলেও চাষবাসে মন ছিল না। বরং আগ্রহ ছিল কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে। তা নিয়ে উচ্চশিক্ষার পর টাটা গোষ্ঠীতে শিক্ষানবিশের কাজ জুটেছিল। আশির দশকে সেই চাকরির হাত ধরেই কর্মজীবনে সাফল্যের সূত্রপাত নটরাজন চন্দ্রশেখরনের।
সে দিনের সেই কৃষকপুত্রের হাতেই কি তবে আজ টাটা গোষ্ঠীর সুবিশাল সাম্রাজ্যের ভার ন্যস্ত হতে চলেছে? তামিলনাড়ুর অখ্যাত গ্রাম থেকে যে ম্যারাথন দৌড় শুরু হয়েছিল তার শেষ কি এ বার বম্বে হাউসই?