নিজের কথা বলতে লজ্জা শরমের ধার ধারেন না। বরং হিংসুটেদের গায়ে ফোসকা ফেলেই সাফল্যের কথা ফলাও করে বলা তাঁর অভ্যাস। কম সমালোচনা সইতে হয়নি তার জন্য। তবু সমঝে দেওয়া যায়নি তাঁকে। দেবিতা শরফ নিজের নীতিতে সপাটে চলে তার পরও মাত্র ২৪ বছর বয়সে নিজে হাতে প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজের সংস্থা। বানিয়েছেন ১০০০ কোটি টাকার সাম্রাজ্য।
আইআইএম বা আইআইটির মতো সংস্থার প্রশিক্ষণ নেই। তবে দেবিতা বলেন, ব্যবসা বুঝতে ডিগ্রি লাগে না। ১৬ বছর বয়স থেকে নিয়মিত বাণিজ্য সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন দেবিতা। কখনও বাবার সঙ্গে, কখনও বা একাই।
মারওয়াড়ি কন্যা। দেবিতার কথায়, ব্যবসা তাঁর রক্তে। ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম। বাবা রাজকুমার শরাফ একটি কম্পিউটার প্রস্তুতকারী সংস্থা প্রতিষ্ঠাতা করেছিলেন। বড় দাদাও সেই সংস্থারই প্রধান। মা বিজয়রানি শরাফ অর্থনীতির অধ্যাপিকা।
বিজয়রানি জানিয়েছেন, তাঁর দুই সন্তানেরই ছোট থেকে ব্যবসায় ঝোঁক ছিল। তবে দেবিতা তাঁর কেরিয়ার শুরু করেন একটু কম বয়সেই। ১৯৯৮ সালে বাবার সংস্থায় যোগ দেন তিনি।
মুম্বইয়ে ১৯৮১ সালের ২৫ জুন জন্ম দেবিতার। ১৭ বছর বয়সে বাবার সংস্থায় পেশাদার জীবন শুরু হয় তাঁর। পাশাপাশি মুম্বইয়ের কুইন মেরি স্কুলে চলছিল পড়াশোনাও। এর পর তিনি অর্থনীতি এবং বাণিজ্য নিয়ে মুম্বইয়ের এইচ আর কলেজ অফ কমার্স অ্যান্ড ইকনমিকসেও ভর্তি হন।
এক সাক্ষাৎকারে দেবিতা বলেছেন, ‘‘অফিসের পরিবেশ দেখে তখন থেকেই আমি ভাবতাম, আমিও একদিন বাবার মতো একটা অফিস চালাবে।’’ তত দিনে অবশ্য বাবার সঙ্গে ব্যবসার কাজে বিদেশেও যেতে শুরু করেছেন তিনি।
বাবার সঙ্গে বাণিজ্য সম্মেলনে ক্যালিফোর্নিয়ায় সিলিকন ভ্যালিতে যেতেন তিনি। সেখানে তাঁর নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ হতে শুরু করে শিল্পপতি, উদ্যোগপতিদের সঙ্গে। সেই সময়েই ক্যালিফোর্নিয়ার একটি গবেষণাগার তৈরি ভারতীয়দের উচ্চ প্রযুক্তির পণ্য তৈরির গবেষণা শুরু করেন তিনি। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন নিজের সংস্থা। এই মুহূর্তে সেই সংস্থার বার্ষিক আয় ১০০০ কোটি টাকা।
এটি মূলত একটি আধুনিক টেলিভিশন প্রস্তুতকারী সংস্থা। ইতমধ্যেই গোটা দুনিয়ায় ৩০ লক্ষ টিভি বিক্রি করে ফেলেছে তারা। ভারতেরও বৃহত্তম টিভি প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। বিদেশে যে সমস্ত ভারতীয় সংস্থা টিভি বিক্রি করে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি তাদেরই।
২০২০ সালের একটি রিপোর্ট বলছে, ৪০ বছরের নীচে ভারতে নিজের চেষ্টায় নিজের ব্যবসাকে প্রতিষ্ঠা করা মহিলা শিল্পপতিদের মধ্যে দেবিতাই সবচেয়ে ধনী। তাঁর মোট সম্পত্তির পরিমাণ ১৮০০ কোটি টাকা।
২০১৯ সালে এক সংস্থার ‘সেরা ৫০ ক্ষমতাবান মহিলা শিল্পপতি’র তালিকায় নাম ছিল দেবিতার। ২০১৬ সালে ফোর্বস পত্রিকা তাঁকে ‘ভারতের মডেল সিইও’র সম্মান দেয়। সেই সম্মান এখনও জ্বলজ্বল করছে তাঁর টুইটারের পরিচয়ে।
এ ক্ষেত্রে মডেল বলতে ‘আদর্শ’ বোঝালেও দেবিতার ক্ষেত্রে তা আলাদা অর্থবাহী। কারণ তিনি নিজের তৈরি করা পণ্যের মডেলিংও করে থাকেন।
দেবিতা মনে করেন, এক জন অভিনেতা তাঁর তৈরি পণ্যটির ব্যাপারে যতখানি আবেগ অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে পারবেন, তার চেয়ে অনেক বেশি তিনি নিজে প্রকাশ করতে পারবেন।
এ ব্যাপারে দেবিতার আদর্শ বা রোল মডেল স্টিভ জোবস। অ্যাপল প্রতিষ্ঠাতা বরাবর নিজের তৈরি পণ্যের পরিচিতি এবং প্রচার নিজেই করে এসেছেন। দেবিতা অবশ্য পুরোদস্তুর মডেলিংই করেছেন তাঁর পণ্যের বিজ্ঞাপনের জন্য।
ফ্যাশনে বরাবরই আগ্রহী দেবিতা। বরাবরই সাজগোজ পছন্দ করেন তিনি। নিজের পণ্যের মডেলিং করতে গিয়েও নিঁখুতত্বে সামান্যতম খামতি রাখেননি তিনি। সেই অর্থে তিনি আক্ষরিক অর্থেও ‘মডেল’ সিইও।
তবে নিজের ফ্যাশন প্রীতি শুধু নিজের সংস্থার পণ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি দেবিতা। বহু ফ্যাশন ডিজাইনারের হয়ে র্যাম্পে হেঁটেছেন। ফ্যাশন এবং প্রসাধনীর পণ্যের প্রচারও করেছেন।
২০২১ সালে দেশে লকডাউন চলাকালীন দেবিতার সংস্থা নিজস্ব সুগন্ধি তৈরি করে। তবে ওই সুগন্ধি সবার জন্য নয়। প্রচারে দেবিতা জানিয়েছিলেন, এই সুগন্ধি বানানো হয়েছে ব্যবসার জগতের মহিলা বসদের জন্য।
গোটা বিশ্বে সেই সুগন্ধি বিক্রি করে যে আয় হয়েছিল, তার প্রায় পুরোটাই দেশে কোভিডের চিকিৎসায় দান করেছিলেন দেবিতা।
দেবিতা বরাবরই নারীবাদী। তা নিয়ে সরবও হয়েছেন বরাবর। তিনি মনে করেন, শিল্পের দুনিয়ায় আরও বেশি সংস্থার বস বা সিইও হওয়া উচিত মহিলাদেরই। তার মতে, বিশেষ করে ভারতে এমনটা করা গেলে অর্থনীতির এক অন্য স্তরে উত্তরণ হবে।
এ হেন দেবিতার অন্য একটি নামও আছে। ভারতীয় বাণিজ্য মহলে অনেকেই তাঁকে ডাকেন ‘ভারতের ইভাঙ্কা ট্রাম্প’ বলে।
আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসি়ডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বড় মেয়ে তথা আমেরিকার প্রাক্তন ফার্স্ট ডটার ইভাঙ্কার সঙ্গে চেহারায় বা চরিত্রে অবশ্য কোনও মিল নেই দেবিতার।
তবে দেবিতার কথায়, তিনি ট্রাম্পকে একজন ভাল বাবা মনে করেন। আর ‘ভারতের ইভাঙ্কা’ নামটি তাঁকে দিয়েছিলেন স্বয়ং ট্রাম্পই।
এমন দাবির জন্য অবশ্য দেবিতাকে কম কথা শুনতে হয়নি। টুইটারে তাঁর এমন পোস্টের জন্য নিন্দকেরা বলেছেন, আদেখলামির সীমা থাকা উচিত। দেবিতা যদিও তাঁর সমালোচকদের পাত্তা দেননি। তাঁদের সমালোচনা হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন।
ট্রাম্প যে বছর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হন, সে বছর ভারতের একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রথম পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন দেবিতা। বিজ্ঞাপনটি দিতে খরচ হয়েছিল ১ কোটি টাকা!
পাতাজোড়া ওই বিজ্ঞাপনে ছিল একটি ছবি। ট্রাম্পের সঙ্গে দেবিতার। দেবিতার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প অন্য হাতে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করে ‘থাম্বস আপ’ করছেন। বিজ্ঞাপনে ওই ছবির পাশে বড় বড় হরফে লেখা ছিল ‘অভিনন্দন মিস্টার প্রেসিডেন্ট’। এই বিজ্ঞাপনের জন্যও সমালোচিত হতে হয় দেবিতাকে।
প্রথমত সদ্য নির্বাচিত আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে নিজের ছবি দিয়ে প্রচার, তার উপর ছবির নীচে বড় হরফে নিজের বায়োডাটাও লিখে দিয়েছিলেন দেবিতা। সমালোচকেরা তাঁর বিরুদ্ধে আরও একবার তোলেন দেখানেপনার অভিযোগ।
পাল্টা দেবিতাও টুইট করে বুঝিয়ে দেন এই সব সমালোচনায় পাত্তা দিতে তাঁর বয়েই গিয়েছে। বরং আরও এক ধাপ এগিয়ে তাঁর সঙ্গে ট্রাম্পের সুসম্পর্কের খতিয়ান দিয়েছিলেন তিনি। যা দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে গিয়েছিলেন সমালোচকেরা।
টিভিতে নেটফ্লিক্স এবং ইউটিউব দেখার পরিকল্পনা এবং রিমোটে তার জন্য আলাদা বোতাম থাকা ফোরকে টেলিভিশন ২০১৬ সালে এনেছিল দেবিতার টিভি সংস্থা। সেই সময় ভারতের এই তরুণী শিল্পপতি বলেছিলেন, ‘‘আমি যে কোনও পণ্য তৈরির করার সময় নিজেকে গ্রাহকের জায়গায় বসিয়ে দেখি। আমি যদি কারও সঙ্গে ব্যবসা করতে চাই, আমি তাঁর কাছে পৌঁছে যাব। এ ব্যাপারে এক বারও দ্বিধা করব না। ব্যবসা করতে এলে অকারণ আত্মসম্মানবোধ সরিয়ে রাখতে হয়।’’
নিজের সংস্থার বস হিসাবেও গর্ব করতে ভালবাসেন দেবিতা। বাবার সংস্থায় কর্মরত তরুণী দেবিতা নাকি এক বার বলেছিলেন, ‘‘বসের মেয়ে হওয়ার জন্য আমি ক্ষমা চাইতে পারব না।’’
তবে এ সবের বাইরেও এক অন্য দেবিতা রয়েছেন। ওড়িশি নাচের একজন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নর্তকী এই ‘মডেল সিইও’। নিজেকে ফ্যাশনিস্তা বলতেও পছন্দ করেন। ডিজাইনার পোশাক পরতে পছন্দ করেন। ইনস্টাগ্রামে নিজের সাজগোজের ছবিও দেন। সেখানে প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ অনুরাগী আছে তাঁর।
বুদ্ধিমত্তায় সাধারণের থেকে নাকি অনেক এগিয়ে। ইন্টারন্যাশনাল হাই আইকিউ মেনেসা সোসাইটির সদস্য দেবিতা। আবার স্বাস্থ্য সম্পর্কেও বেশ সচেতন। নিজেকে ফিট রাখতে নিয়মিত যোগাসন করেন। প্রতি দিন রাতে জিম এবং প্রতি রবিবার নাচের ক্লাসে যাওয়ার রুটিন কোনও দিন বদলায় না তাঁর। এখন ৪২-এর কোঠায় পা রেখেছেন। বিয়ে করেননি। আপাতত নিয়মানুবর্তীতার সঙ্গে প্রিয় বন্ধুত্ব পাতিয়েছেন এই ভারতীয় কন্যা।