সম্প্রতি ‘কালা পানি’ নামের ওয়েব সিরিজ়টি দর্শক মহলে আলোড়ন ফেলেছে। ২০২৭ সালে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে এক মহামারির উদ্ভব এবং তা থেকে জন্মানো উদ্বেগ ও ঘাত-প্রতিঘাত মনে পড়াচ্ছে কোভিড-কালের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। এরই পাশাপাশি, সেই সিরিজ়ে বার বার দেখানো হয়েছে একটি বিশেষ চিহ্ন। এমনকি, এই চিহ্নটি সিরিজ়ের পোস্টার ও টাইটেল কার্ডেও প্রদর্শিত। তিনটি সর্পিল কুণ্ডলীর চক্র নিয়ে তৈরি এই চিহ্ন কি কল্পিত, না কি তার বাস্তব ভিত্তি রয়েছে?
‘কালা পানি’-তে বার বার উঠে আসা ওই চিহ্নকে ‘ওরাকা’ নামের এক কাল্পনিক জনজাতির নিজস্ব এবং পবিত্র প্রতীক বলে তুলে ধরা হয়েছে। ওরাকারা এক শান্তিপ্রিয় জনজাতি এবং তারা আধুনিক প্রযুক্তি থেকে বেশ দূরেই থাকতে চায়। এই তিন সর্পিল চক্র তাদের অভিজ্ঞান এবং এই চিহ্নটির মাধ্যমেই তাদের পূর্বপুরুষদের অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা যুগ পরম্পরায় তারা বহন করে চলে।
ওরাকা জনজাতি কল্পিত হলেও আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বাসরত বেশ কিছু জনজাতির সঙ্গে তাদের মিল রয়েছে। সব থেকে বড় কথা, তারা প্রকৃতির সঙ্গে এতটাই ওতপ্রোত ভাবে জড়িত যে, কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আভাস তারা সর্বাগ্রে টের পায়। ২০০৪ সালের সুনামির আগেই তারা পার্বত্য অঞ্চলে চলে গিয়েছিল এবং বিপর্যয়ে তাদের কোনও ক্ষতিই প্রায় হয়নি বলে সিরিজ়ে দেখানো হয়েছে।
সিরিজ়ের কাহিনি অনুসারে ওরাকাদের এই তৎপরতার নেপথ্যে রয়েছে তাদের পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া কিছু সূত্র, যা তাদের যে কোনও বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে। এই সূত্রগুলির প্রতীক হল সেই তিনটি সর্পিল চক্রাকার চিহ্ন। ওরাকারা কল্পিত হলেও এই চিহ্ন কিন্তু কল্পিত নয়। এক সুবিশাল ইতিহাস বহন করে চলেছে এই চিহ্ন।
চিহ্নতত্ত্ববিদেরা জানান, এই চিহ্নটির নাম ‘ট্রিস্কেলিয়ন’ বা ‘ট্রাইস্কেলিয়ন’। এটি অতি প্রাচীন একটি প্রতীক। এর জন্ম ঠিক কবে, তা নিশ্চিত ভাবে বলা না গেলেও, এটি যে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে এবং হয়ে চলেছে, তার বিস্তর সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে।
বিশ্বের সব থেকে পুরনো ট্রিস্কেলিয়নটির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে ইউরোপে। আয়ারল্যান্ডের নিউগ্রাঞ্জ নামের এক প্রস্তরযুগীয় সৌধক্ষেত্রে একটি পাথরের গায়ে আঁকা রয়েছে এই ট্রিস্কেলিয়নটি। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, এটি ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ খোদাই করা হয়েছিল। প্রায় একই সময়ে গ্রিসের মাইসেনীয় যুগের (ব্রোঞ্জ যুগের শেষার্ধ) কিছু মৃৎপাত্রের গায়েও এই চিহ্ন অঙ্কিত হয়েছিল। আয়ারল্যান্ডের সংস্কৃতিতে ট্রিস্কেলিয়নের বিশেষ ভূমিকা অবশ্য পরবর্তী কালেও থেকে যায়।
গ্রিসের ধ্রুপদী যুগেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ট্রিস্কেলিয়ন অঙ্কিত হতে থাকে। সিসিলির রৌপ্যমুদ্রায় ট্রিস্কেলিয়নের ভিন্নতর এক রূপ দেখা যায়। সেখানে একটি বৃত্তকে ঘিরে মানুষের তিনটি পা ট্রিস্কেলিয়ন হিসেবে উ়ৎকীর্ণ থাকত।
প্রাচীন গ্রিসে অনেক সময় তিন মাথাওয়ালা দেবী হেকাটের প্রতীক হিসাবে ট্রিস্কেলিয়নের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। হেকাটের মূর্তি থেকে জানা যায়, তিনি ছিলেন তিন দেহ সম্বলিতা। তাঁকে পরিবর্তনের দেবী বলে মনে করা হত। সেই সঙ্গে তিনি ছিলেন বিষাক্ত গাছ-গাছড়া, মৃতের সমাধি, প্রেত এবং জাদুবিদ্যার সঙ্গে জড়িত। প্রাচীন আথেন্সে হেকাটেকে আকাশ, ভূমি এবং সমু্দ্র— এই তিনটি ভুবনের রক্ষয়িত্রী মনে করা হত। সহজ দৃষ্টিতে দেখলে, ট্রিস্কেলিয়নের তিনটি সর্পিল চক্র এই তিন ভুবনের প্রতীকেও হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। গ্রিসের বাইরে মিশর ও অন্যত্রও হেকাটে পূজিতা হতেন।
প্রাচীন রোমেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ট্রিস্কেলিয়নের ব্যবহার দেখা যায়। এবং অবশ্যই তার ব্যঞ্জনাও বিভিন্ন মহিমায় বর্ণিত হতে শুরু করে।
এখন প্রশ্ন হল, এই চিহ্নের অর্থ কী? গ্রিক শব্দ ‘ট্রিস্কেলেস’-এর অর্থ ‘তিনটি পা’। কিন্তু নৃতাত্ত্বিকদের মতে, এই চিহ্নের উৎস কেল্টিক জগতে বা আয়ারল্যান্ডে। বিশ্বের অন্য জায়গার মতোই আয়ারল্যান্ডের অতি প্রাচীন সভ্যতা ছিল প্রকৃতি তথা মাতৃকা উপাসক। এই ত্রিচক্র মাতৃকা তথা প্রকৃতি উপাসনার সঙ্গে জড়িত। কেল্টিক জগতে কর্ম, প্রগতি এবং সংগ্রামের মতো বিষয়কে এই চিহ্ন দ্বারা ব্যক্ত করা হত, এমন কথাও অনেক বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন।
নৃতত্ত্ববিদদের একাংশ মনে করেন, আয়ারল্যান্ডে এই চিহ্নের সব থেকে পুরনো নমুনা পাওয়া গেলেও, বিশ্বের প্রায় সব প্রাচীন সংস্কৃতিতেই এ ধরনের প্রতীক ব্যবহৃত হত। কোথাও এটিকে ত্রিশক্তি হিসাবেও দেখা হত। মধ্যযুগীয় ইউরোপের খ্রিস্টীয় সংস্কৃতিতে এটিকে ফাদার, সন এবং হোলি স্পিরিটের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করা হতে থাকে।
ট্রিস্কেলিয়ন সম্পর্কে আর একটি মত হল, এটি তিনটি আর্কিমেডিয়ান সার্কলের সমাহার। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের গ্রিক গণিতবিদ আর্কিমিডিস বৃত্তাকার সর্পিল রেখার এক বিশেষ গতিসূত্র প্রদর্শন করেন যা পদার্থবিদ্যা থেকে মনোবিজ্ঞান— বহু ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হতে পারে। আজও পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে আর্কিমিডিসের এই ভাবনা ব্যবহৃত হয়।
ট্রিস্কেলিয়নে ব্যবহৃত সর্পিলাকার রেখাগুলি মহাবিশ্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে জানায় আধুনিক বিজ্ঞান। সর্পিলাকার ছায়াপথের গতি ও প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে আর্কিমেডিয়ান স্পাইরালের গাণিতিক সূত্র প্রয়োগ করা হয়।
এখন প্রশ্ন, ট্রিস্কেলিয়ন কেন ব্যবহৃত হল ‘কালা পানি’ সিরিজ়ে? সিরিজ়টির মুখ্য উপজীব্য, প্রগতির নামে প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ কোন মারাত্মক বিপদকে নিয়ে আসতে পারে তার স্বরূপ তুলে ধরা। ট্রিস্কেলিয়ন এখানে ত্রিকাল, ত্রিলোক এবং আকাশ-মাটি-জলের মতো প্রাকৃতিক বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব করছে।
এই সিরিজ়ে ওরাকা নামে যে কল্পিত জনজাতিকে দেখানো হয়েছে, ট্রিস্কেলিয়ন তাদেরই সম্প্রদায়েরই পবিত্র প্রতীক। ওরাকারা প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় ভাবে সংশ্লিষ্ট। তাদের মধ্যে রয়েছে সেই ‘আদিম জ্ঞান’, যা থেকে তথাকথিত প্রগতি সভ্যতাকে বঞ্চিত করেছে। নাগরিক সংস্কৃতির চাপে ‘জনজাতি’ তকমা দিয়ে ওরাকাদের মতো শতসহস্র মানবগোষ্ঠীকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু, প্রাকৃতিক দুঃসময়ে এরা যে আশ্চর্য ভাবে নিজেদের বাঁচাতে জানে, তা প্রগতির ব্যাকরণ বুঝেও না বোঝার ভান করে। ট্রিস্কেলিয়ন এখানে সেই আদিম জ্ঞানের প্রতীক।
সিরিজ়ে দেখানো হয়েছে, ওরাকাদের সেই মহামারি স্পর্শ করতে পারেনি। কারণ, জিনগত ভাবে এই মহামারি প্রতিরোধের ক্ষমতা তাদের মধ্যে ছিল। তা ছাড়া তারা জানত, এক বিশেষ গুল্মে রয়েছে এই অজানা অসুখ থেকে নিরাময়ের উপায়। প্রকৃতিগত ভাবে ‘আন্দামানিয়া একিন্যাসিয়া’ নামের সেই কাল্পনিক গুল্মের আকৃতিও ট্রিস্কেলিয়নের মতোই। মহাপ্রকৃতির প্রতীক হয়ে এখানে দেখা দেয় ট্রিস্কেলিয়ন।
তার উপরে এই সিরিজ়ে দেখানো হয়েছে প্রগতির গতিসূত্রের সঙ্গে সেঁটে থাকা লোভ, মোহ, ঘৃণা ও ক্ষমতালিপ্সাকে। দেখানো হয়েছে, তারাও বার বার আবর্তিত হয়, সে আবর্তনও সর্পিলাকার। অনন্ত। ট্রিস্কেলিয়ন যেন সেই সর্পিল লিপ্সার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভিন্ন জগতের প্রবেশদ্বার।
কালা পানি’-তে ট্রিস্কেলিয়নের এই ব্যবহার নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন, কোথায় আয়ারল্যান্ড বা ইউরোপ, আর কোথায় বঙ্গোপসাগরের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ! আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের আদি বাসিন্দারা অনেকেই প্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতি বহন করে চলেছেন। ফলে, সেই ‘প্রাচীন জ্ঞান’ তাঁদের মধ্যে এখনও চর্চিত ও প্রজন্ম পরম্পরায় প্রবাহিত। এই প্রাচীন জ্ঞানকেই ‘কালা পানি’ সিরিজ়ে সম্ভবত ট্রিস্কেলিয়নের প্রতীকে ব্যক্ত করা হয়েছে। এখানে উপস্থিত কাল্পনিক জনজাতি ওরাকারা যেন বিশ্বের সমস্ত জনজাতির প্রতিনিধিত্ব করছে। ট্রিস্কেলিয়ন এখানে আর বিশেষ কোনও অঞ্চলে আবদ্ধ নেই। তা সকলের।