সোমবার এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী রইল সারা বিশ্ব। অযোধ্যার রামমন্দিরে রামলালার ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। রামলালার মূর্তির প্রথম দর্শনে মুগ্ধ হয়ে যান সকলে। কী দিয়ে তৈরি এই মূর্তি? সেই শিলার বিশেষ বৈশিষ্ট্যই বা কী?
রামলালার মূর্তির উচ্চতা ৫১ ইঞ্চি। প্রায় ২০০ কিলোগ্রাম ওজন এই মূর্তির। শ্রীরাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টের তরফে জানানো হয়েছে যে, প্রায় ৩০০ কোটি বছরের পুরনো কষ্টিপাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই মূর্তি।
কর্নাটকের মাইসুরু জেলায় পাওয়া যায় কষ্টিপাথর। এই শিলার রং কুচকুচে কালো। কৃষ্ণের গায়ের রঙের সঙ্গে মিল থাকায় এই শিলার নাম কষ্টিপাথর রাখা হয়েছে।
কষ্টিপাথরের মূল উপাদান ক্যালসাইট। ক্যালসিয়াম কার্বনেটের সবচেয়ে স্থায়ী রূপ (পলিমর্ফ) এটি। কষ্টিপাথর দিয়ে মূর্তি তৈরি করতে পছন্দ করেন ভাস্কররাও।
প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, খননের সময় যে কষ্টিপাথর উঠে আসে তা সাধারণত নরম প্রকৃতির হয়। তবে খোলামেলা পরিবেশে দীর্ঘ দিন থাকলে সেই শিলা ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে যায়। তার পর তা দিয়ে মূর্তি গড়তে গেলে অসুবিধা হয়।
বাইরের পরিবেশে কষ্টিপাথর রেখে দিলে তা দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে কঠিন হয়ে যায়। কঠিন হয়ে যাওয়ার আগেই সাধারণত শিলার উপর খোদাইয়ের কাজ সম্পূর্ণ করে ফেলেন ভাস্করেরা।
রামমন্দিরের গর্ভগৃহে রামলালার যে মূর্তিটি স্থাপন করা হয়েছে তা তৈরি করেছেন কর্নাটকের ভাস্কর অরুণ যোগীরাজ। ছ’মাস ধরে কষ্টিপাথর দিয়ে রামলালার মূর্তিটি খোদাই করেছেন তিনি।
শুধু রামলালার মূর্তিই নয়, কেদারনাথের ১২ ফুট লম্বা আদি শঙ্করাচার্যের মূর্তি এবং ইন্ডিয়া গেটের কাছে অমর জওয়ান জ্যোতির পিছনে ৩০ ফুট লম্বা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মূর্তিও গড়েছেন অরুণ।
কর্নাটকের মাইসুরু জেলায় মূলত এইচডি কোটে শহর এবং কর্নাটকের কারকালায় প্রচুর পরিমাণে কষ্টিপাথর পাওয়া যায়। প্রত্নতত্ত্ববিদদের দাবি, কষ্টিপাথরের স্থায়িত্ব দীর্ঘ। বছরের পর বছর পড়ে থাকলেও এই শিলার কোনও ক্ষয় হয় না।
আবহাওয়ার পরিবর্তন হলেও কষ্টিপাথরের কোনও পরিবর্তন হয় না। এমনকি উপক্রান্তীয় অঞ্চলে এই শিলাটি রেখে দিলে তা হাজার বছরেরও বেশি সময় অক্ষত অবস্থায় থাকতে পারে।
দক্ষিণ ভারতের অধিকাংশ মন্দিরে স্থাপিত দেবদেবীর মূর্তি কষ্টিপাথর দিয়ে তৈরি। স্থানীয়দের কাছে এই শিলা ‘নেল্লিকারু’ নামে পরিচিত।
রামমন্দিরের গর্ভগৃহে রামলালার যে মূর্তিটি রয়েছে তা দাঁড় করানো ভঙ্গিমায় রয়েছে। রামলালা পাঁচ বছর বয়সি বালক।
প্রথমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল শালগ্রাম শিলা দিয়ে তৈরি করা হবে রামলালার মূর্তি। নেপালের কালীগণ্ডকী জলপ্রপাত থেকে তুলে আনা ওই জীবাশ্ম প্রস্তর দিয়েই তৈরি করা হবে রামের বিগ্রহ, পরিকল্পনা ছিল এমনটাই।
হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী শালগ্রাম শিলাকে ভগবান বিষ্ণুর প্রতিভূ হিসাবে মানা হয়। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৩৫ টন ওজনের দু’টি শালগ্রাম শিলাখণ্ড নেপাল থেকে অযোধ্যায় নিয়ে আসা হয়।
সূত্রের খবর, রামমন্দিরের জন্য মন্দির কর্তৃপক্ষ তিনটি মূর্তি তৈরির বরাত দিয়েছিলেন। মূর্তি তৈরির জন্য নেপাল থেকে শালগ্রাম শিলা আনা হয়েছিল। কিন্তু তা মূর্তি তৈরির কাজে লাগেনি। কারণ, খোদাইয়ের সময় বার বার সেই পাথর ভেঙে যাচ্ছিল। পরে ঠিক হয় কালো পাথরের মূর্তি তৈরি হবে।
রামলালার মূর্তি নির্মাণে শালগ্রাম শিলা ব্যবহার না হলেও তা রামমন্দির চত্বরে রাখা হয়েছে। মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েছে কষ্টিপাথর দিয়ে নির্মিত মূর্তি।
অরুণ যোগীরাজের তৈরি বিগ্রহটির সামনেই রাখা হয়েছে রামলালার পুরনো মূর্তি। শ্রীরাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টের তরফে জানানো হয়েছে যে পুরনো মূর্তির উচ্চতা অনেকটাই কম।
রামলালার পুরনো মূর্তির উচ্চতা পাঁচ থেকে ছয় ইঞ্চি। সাত থেকে নয় মিটার দূর থেকে এত কম উচ্চতার মূর্তির দর্শন পাওয়া কষ্টসাধ্য। সে কথা ভেবে আরও বড় মূর্তি নির্মাণ করা হয়েছে বলে শ্রীরাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টের তরফে জানানো হয়েছে।
মাইসুরুর শিল্পীর তৈরি বিগ্রহ গর্ভগৃহে স্থান পেলেও সেই দৌড়ে ছিল আরও দুই বিগ্রহ। গর্ভগৃহে স্থান না পেলেও বিগ্রহ দু’টি মন্দিরেই রাখা হবে।
দৌড়ে থাকা একটি বিগ্রহ তৈরি করেছেন রাজস্থানের শিল্পী সত্যনারায়ণ পাণ্ডে। শ্বেতপাথরের তৈরি বিগ্রহের এক হাতে সোনার তির, অন্য হাতে সোনার ধনুক। বিগ্রহের ঠোঁটে গোলাপি আভা। ফুটে উঠেছে শিশুসুলভ হাসি। গায়ে গয়না এবং ধুতিও পাথরে খোদাই করা। পিছনে রয়েছে আর্চের মতো কাঠামো। তাতে খোদাই করা রয়েছে বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতার।
দৌড়ে থাকা অন্য একটি বিগ্রহ তৈরি করেছেন কর্নাটকের ভাস্কর গণেশ ভট্ট। সেটিও গর্ভগৃহে স্থান পায়নি। অন্য বিগ্রহের সঙ্গে গণেশ নির্মিত বিগ্রহটি মন্দিরের অন্যত্র রাখা হবে।