ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত সিকিম। দুর্যোগ এখনও পর্যন্ত প্রাণ কেড়েছে ১৯ জনের। নিখোঁজ কমপক্ষে ১০৩ জন। খোঁজ নেই বহু সেনা জওয়ানেরও। বুধবার ভোরে মেঘভাঙা বৃষ্টির জেরে লোনক হ্রদ ফেটে হুড়মুড়িয়ে জল নেমে আসে। বিপজ্জনক হয়ে ওঠে লোনক।
লোনক হ্রদ ফাটার কারণে ভেঙে গিয়েছে সিকিমের চুংথাম বাঁধ। তাতেই অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গিয়েছে তিস্তার জলস্তর। নদীর তাণ্ডবে আশপাশের এলাকা পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। পুজোর মুখে সিকিমে এই বিপর্যয়ের জেরে ঘুরতে যাওয়া বহু পর্যটক আটকে পড়েছেন প্রতিবেশী রাজ্যে।
রাজ্য প্রশাসন সূত্রে খবর, বাংলার অন্তত দু’হাজার পর্যটক সিকিমে আটকে পড়েছেন। জাতীয় সড়কে যান চলাচল বন্ধ। ফলে আপাতত অবরুদ্ধ ফেরার পথও। রাজ্য প্রশাসনের তরফে সিকিম সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের উদ্ধারের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
কেন এমনটা হল সিকিমে? শুধু কি মেঘভাঙা বৃষ্টিই এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী? তেমনটা মনে করছেন না বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞদের মত, মঙ্গলবার লোনক হ্রদ ফেটে সিকিমে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার নেপথ্যে রয়েছে ‘গ্লেসিয়াল লেক আউটবার্স্ট ফ্লাড’ (জিএলওএফ)।
জিএলওএফ হয় তখনই, যখন হিমবাহ গলা জল জমে সৃষ্ট হ্রদগুলি অতিরিক্ত জল জমার কারণে বা ভূমিকম্পের মতো কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে ফেটে যায়। যার ফলে হড়পা বানে ভেসে যায় আশপাশের এলাকা। সিকিমের ক্ষেত্রে ভূমিকম্পের বদলে অনুঘটকের কাজ করেছে মেঘভাঙা বৃষ্টি।
ভূমিকম্প এবং মেঘভাঙা বৃষ্টি ছাড়াও তুষারপাত, ভারী বৃষ্টিপাত এবং আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কারণেও হিমবাহের জল জমে সৃষ্ট হ্রদ ফেটে বন্যা বা জিএলওএফ হতে পারে।
জিএলওএফ-এর কারণে হিমবাহ হ্রদের আশপাশের এলাকাগুলি প্লাবিত হয়। পরিবেশের উপরেও যার প্রভাব মারাত্মক এবং সুদূরপ্রসারী হতে পারে।
মনে করা হচ্ছে, লোনক হিমবাহ গলতে থাকায় হ্রদে বিপজ্জনক ভাবে জলের পরিমাণ বাড়ছিল। ফলে হ্রদের দেওয়ালে চাপও ক্রমশ বাড়ছিল। সেই চাপ সহ্য করতে না পেরেই হ্রদ ফেটে যায়। ২০২১ সালে উত্তরাখণ্ডের চামোলিতে যে দুর্যোগ এসেছিল, তার নেপথ্যেও এই ‘গ্লেসিয়াল আউটবার্স্ট’ ছিল বলে মনে করা হয়। ২০১৩ সালে উত্তরাখণ্ডের কেদারনাথের ভয়াবহ বন্যাও জিএলওএফ-এর কারণে হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
সিকিমে দুর্যোগ নেমে আসার অনেক আগেই নাকি এই হ্রদ নিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্ট (আইসিআইএমওডি)। সাবধান করেছিল ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোও।
আইসিআইএমওডি সংস্থাটি উপগ্রহচিত্রের মাধ্যমে পুরো সিকিমে ৩২০টি হিমবাহ হ্রদের সন্ধান পেয়েছে। যেগুলির মধ্যে ১৪টি বিপজ্জনক বলে জানিয়েছিল তারা। সেই বিপজ্জনক হ্রদের তালিকায় ছিল দক্ষিণ লোনক হ্রদও।
আইসিআইএমওডি সূত্রে খবর, লোনক হ্রদ লোনক হিমবাহ সৃষ্ট। ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৭ হাজার ১০০ ফুট উপরে লোনক হিমবাহটি রয়েছে। ২৬০ ফুট গভীর, প্রায় ২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং আধ কিলোমিটার চওড়া এই হিমবাহটি। সব মিলিয়ে ১.২৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই হিমবাহ।
লোনক হ্রদ ১৬৮ হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এই হ্রদের আয়তন এবং গভীরতা দ্রুত বাড়ছিল। হিমবাহ সৃষ্ট হ্রদ হলেও এতে জল বেশি ছিল না। কিন্তু গত পাঁচ দশকে এই হ্রদের গভীরতা দ্রুত বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে জলস্তরও।
বর্তমানে এই হ্রদের গভীরতা ১০ তলা বাড়ির সমান। দৈর্ঘ্যে আড়াই কিলোমিটার এবং প্রস্থে ৬০০ মিটার। হ্রদের এই দ্রুত পরিবর্তনে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, মেঘভাঙা বৃষ্টি হলে মহাবিপদ নেমে আসবে সিকিমে। হলও তাই।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পাঁচ হাজার মিটার উচ্চতায় রয়েছে এই হ্রদ। এক সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছিল, যে ভাবে উষ্ণায়নের প্রভাব বাড়ছে, তাতে এই হ্রদে জমে থাকা বরফ দ্রুত গলতে শুরু করবে, সেই সঙ্গে জলস্তর বাড়বে। তার সঙ্গে যদি মেঘভাঙা বৃষ্টি হয়, তা হলে হ্রদ ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। অনেক সময় বরফে বরফে ঘষা লেগেও গলন প্রক্রিয়া দ্রুত হতে থাকে। লোনক হ্রদের ক্ষেত্রেও তেমনটা ঘটেছে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
২০২১ সালেও উত্তর সিকিমের লোনক হ্রদ নিয়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছিল। তখন যদিও বিষয়টি নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামানো হয়নি। তবে শেষরক্ষা হল না। বুধবার লোনক হ্রদ ফেটে সৃষ্ট হড়পা বানে সিকিমের ২২ হাজারেরও বেশি মানুষের জীবনে প্রভাব পড়েছে।
এ ছাড়াও ২০১৬ সালে, লাদাখের ‘স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্টের’ সোনম ওয়াংচুক জিএলওএফ নিয়ে সতর্ক করেছিলেন। জিএলওএফ রোধ করার জন্য হিমবাহ থেকে সৃষ্ট হ্রদে উচ্চ ঘনত্বের পলিথিন পাইপ বসানো হয়েছিল।
২০০১ সালের ‘সিকিম হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টে’ও হিমবাহ থেকে সৃষ্ট হ্রদ ফেটে সিকিমে বিপত্তি ঘটতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছিল।