আকারে খুব বড় নয়। দৈর্ঘ্য মাপতে ন্যানোমিটারের আশ্রয় নিতে হয়। সেই ছোট্ট চিপের মধ্যেই কিন্তু লুকিয়ে বিশ্ব জুড়ে বড়সড় পরিবর্তনের বীজ। চিপ বদলে দিতে পারে অনেক সমীকরণ।
মোবাইল, ক্যামেরা থেকে শুরু করে ল্যাপটপ— বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতির দুনিয়া চিপ ছাড়া অচল। যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশে চিপ দরকার হয়। এই চিপের বাজারেই আমেরিকার সঙ্গে দ্বন্দ্ব বেঁধেছে চিনের।
বিশ্ব জুড়ে চিপ তৈরির বাজারে আধিপত্য বিস্তার করতে দীর্ঘ দিন ধরেই সচেষ্ট চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আমেরিকা এবং চিন। আমেরিকার একের পর এক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে এ বার ‘প্রত্যাঘাত’-এর ছক কষেছে চিন।
চিপ তৈরিতে কাজে লাগে মূলত দু’টি ধাতু— গ্যালিয়াম এবং জার্মেনিয়াম। আমেরিকার সঙ্গে ‘বাণিজ্যদ্বন্দ্বে’ এই ধাতু দু’টিকেই হাতিয়ার করেছে চিন।
সম্প্রতি, চিন সরকার গ্যালিয়াম এবং জার্মেনিয়ামের বেশ কিছু পণ্যের রফতানির উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। রফতানিতে বসেছে নানা রকম শর্ত।
সরকারের এই নতুন ঘোষণায় যদিও ফাঁপরে পড়েছেন চিনা ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিরা। তাঁরা চিপের বাজারে বড়সড় ক্ষতির আশঙ্কা দেখছেন। রফতানিতে বিধিনিষেধের কারণে ব্যবসার ক্ষতি হতে পারে বলেও মনে করছেন তাঁরা।
সরকারের বিধিনিষেধে চিনের চিপ তৈরির বাজারে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারাবেন বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
চিনের এক যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারী সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছে, সরকারের ঘোষণার কথা জানাজানি হওয়ার পর থেকেই পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে।
চিন সরকার জানিয়েছে, জাতীয় নিরাপত্তা সুনিশ্চিত এবং স্বার্থ সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্যেই গ্যালিয়াম এবং জার্মেনিয়ামের পণ্য রফতানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
চিনের বাণিজ্য মন্ত্রক জানিয়েছে, আগামী ১ অগস্ট থেকে গ্যালিয়ামে তৈরি আটটি পণ্য এবং জার্মেনিয়ামে তৈরি ছ’টি পণ্যের রফতানি নিয়ন্ত্রণ করা হবে। ওই পণ্যগুলি রফতানির জন্য আলাদা করে সরকারের অনুমতি নিতে হবে।
চিনের এই পদক্ষেপের নেপথ্যে তাদের আমেরিকাবিরোধী মনোভাবকেই দেখছেন অনেকে। তাঁদের মতে, দীর্ঘ দিন ধরে চিনের প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে থমকে দিতে আমেরিকা নানা কৌশল অবলম্বন করেছে। এ বার চিন তারই প্রত্যাঘাতে প্রস্তুত।
মোবাইল, ল্যাপটপ, সৌর প্যানেল, বৈদ্যুতিন যানবাহনের সেমিকন্ডাক্টর তৈরি হয় গ্যালিয়াম এবং জার্মেনিয়াম দিয়ে। এই দুই ধাতুর প্রাথমিক উৎপাদক চিন।
২০২২ সালে গ্যালিয়ামে তৈরি চিনের পণ্য সবচেয়ে বেশি কিনেছে জাপান, জার্মানি এবং নেদারল্যান্ডস। জার্মেনিয়ামের পণ্য সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে জাপান, ফ্রান্স, জার্মানি এবং আমেরিকায়।
চিনের ক্রেতাদের মধ্যে আমেরিকাও রয়েছে। ফলে রফতানি নিয়ন্ত্রিত হলে চিপের ব্যবহার তথা প্রযুক্তির দুনিয়ায় পিছিয়ে পড়বে আমেরিকা। এ ভাবেই তাদের সমস্যায় ফেলতে পারে বেজিং।
অনেকের ধারণা, চিপ রফতানির জন্য অনুমতি চাইতে বলেছে চিন সরকার। তার মাধ্যমেই আমেরিকায় এই পণ্য রফতানিতে তারা বাধা দিতে পারে। বিপদে পড়তে পারে ওয়াশিংটন।
চিনের আরোপিত বিধিনিষেধ ১ অগস্ট থেকে প্রযুক্ত হতে চলেছে। ইউরোপ, আমেরিকার অনেক ক্রেতা তার আগেই বেশি করে এই ধরনের পণ্য কিনে মজুত করে রাখতে চাইছে। ফলে চিপের বাজারে নতুন সঙ্কট তৈরি হতে পারে।
চিন থেকে কেনা গ্যালিয়াম, জার্মেনিয়াম ব্যবহার করে উন্নত প্রযুক্তির মাইক্রোচিপ প্রস্তুত করে বিভিন্ন আমেরিকান সংস্থা। তার পর সেগুলি আবার চিনে বিক্রি করা হয়।
গত কয়েক মাসে আমেরিকা চিনে মাইক্রোচিপ বিক্রিতে একাধিক বিধিনিষেধ আরোপ করেছে বলে অভিযোগ। মনে করা হচ্ছে, সেই কারণেই পাল্টা দিচ্ছে বেজিংও।
চিপের বাজারে আমেরিকা এবং চিনের এই পারস্পরিক টানাপড়েন সারা বিশ্বের বাণিজ্যেই প্রভাব ফেলতে পারে। দুই বৃহৎ শক্তির ঘাত-প্রতিঘাতে ক্ষতির আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীমহল।