অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, খাওয়াদাওয়ায় অনিয়ম, শরীরচর্চায় অনীহা— এই তিন বদভ্যাস ডেকে আনে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি! সম্প্রতি সংবাদের শিরোনামে উঠে এসেছে এমন কিছু হার্ট অ্যাটাকের ঘটনা, যা ঘুম কেড়েছে অনেকের।
বাস চালাতে চালাতেই আচমকা হার্ট অ্যাটাক হল চালকের। স্টিয়ারিংয়ের উপর ঢলে পড়েন তিনি। নিয়ন্ত্রণহীন বাস তার পর সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা একের পর এক গাড়িতে ধাক্কা মারে।
এই ঘটনায় মৃত্যু হয় এক পথচারীর, আহত হন একাধিক। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, হার্ট অ্যাটাকেই চালক হরদেব পাল (৬০)-এর মৃত্যু হয়েছে। মৃত চালক ছিলেন মধ্যপ্রদেশের জবলপুরের বাসিন্দা।
সম্প্রতি আরও একটি হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর ঘটনা সংবাদের শিরোনামে উঠে এসেছে। গত বৃহস্পতিবার কাটনির সাই মন্দিরে পুজো দিতে গিয়েছিলেন রাজেশ মেহানি। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে, সাইয়ের বিগ্রহের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে সামনে এসে দাঁড়ান। তার পর বিগ্রহের সামনে মাথা নত করে বসে পড়েন। এর পর বেশ কয়েক সেকেন্ড কেটে গেলেও মাথা তোলেননি তিনি।
১৫ মিনিট দেখার পর মন্দিরের পুরোহিতকে খবর দেন অন্য ভক্তরা। পরে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত বলে ঘোষণা করেন। চিকিৎসকরা জানান, ‘সাইলেন্ট’ হার্ট অ্যাটাকেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর।
ভরা মণ্ডপে চলছিল বিয়ের অনুষ্ঠান। চারদিকে নিমন্ত্রিতের ঢল, সাজ সাজ রব। বর অপেক্ষা করছেন কখন কনে এসে তাঁকে বরমালা পরিয়ে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করে নেবেন। সেজেগুজে কনে এলেনও বটে, তবুও হল না মালামদল। ঘটনাটি লখনউয়ের ভাদওয়ানা গ্রামের মালিহাবাদ অঞ্চলের।
২০-র শিবাঙ্গী মালা হাতে কনে বিয়ের মণ্ডপে এসে মালা পরাতে গিয়ে হঠাৎ করেই অচৈতন্য হয়ে পড়ে যান। হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতেই হয় তাঁর মৃত্যু। এ ক্ষেত্রেও মৃত্যুর কারণ হার্ট অ্যাটাক।
এখানেই শেষ নয়, ১৮ বছর বয়সি জুবেরেরও মৃত্যু হয়েছে হার্ট অ্যাটাকে। বন্ধুদের সঙ্গে রাস্তায় হাঁটছিল সে। সিসিটিভিতে দেখা যায়, হঠাৎই জোরে হাঁচি আসে তাঁর। তার পর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বন্ধুর গায়ে ঢলে পড়েন তিনি।
তার পর তাঁর বন্ধুরা হাত-পা ঘষতে শুরু করেন। তাতেও লাভের লাভ কিছুই হয়নি। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। কারণ এ ক্ষেত্রেও, হার্ট অ্যাটাক।
সব ঘটনার নেপথ্যেই হার্ট অ্যাটাক। ১৮ থেকে ৬০— সব বয়সিদেরই কাবু করছে সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক বা সাইলেন্ট অ্যাকিউট মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন (এসএএমআই)। কেকে, সিদ্ধার্থ শুক্ল, সিদ্ধার্থ সূর্যবংশীর, রাজু শ্রীবাস্তবের উদাহরণ মৃত্যুভীতি তৈরি করছে অল্পবয়সিদের মনে। যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ আছে, রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি কিংবা যাঁদের স্থূলতার সমস্যা রয়েছে, তাঁদের হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামীর মতে, ‘‘যাঁরা ধূমপান করেন, কিংবা যাঁদের ডায়াবিটিসের মতো রোগ রয়েছে তাঁদের সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।’’
এই প্রকার হার্ট অ্যাটাক হলে রোগীর বুকে তীব্র যন্ত্রণা হয় না, বড়জোর এমনটা হলে রোগী অচৈতন্য হয়ে পড়েন। হার্ট অ্যাটাকের মূল উপসর্গ ব্যথা, আর এ ক্ষেত্রে কোনও রকম ব্যথা হয় না, তাই একে ‘সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক’ বলা হয়।
অ্যাকিউট মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন হলে রোগীর ঘাম হয়, বুকে চিনচিন ব্যথা হয়, ফলে রোগী খানিকটা আঁচ করতে পেরে হাসপাতালে যাওয়ার সুযোগ পান। অথচ সাইলেন্ট অ্যাকিউট মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন হলে রোগী সেই সুযোগটি পান না। তাই মৃত্যুর হার এ ক্ষেত্রে অনেকটাই বেশি।
চিকিৎসকের মতে, যাঁদের রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের সমস্যা বা ডায়াবিটিস আছে তাঁদের ধূমপান একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া উচিত। নইলে কিন্তু ঝুঁকি অনেক বাড়বে।
এই প্রকার হার্ট অ্যাটাক থেকে বাঁচার উপায় কী? চিকিৎসকের জবাব, ‘‘ধূমপান বন্ধ করতে হবে। ডায়াবিটিস থাকলে তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে, অস্বাস্থ্যকর খাওয়াদাওয়ায় রাশ টানতে হবে।’’
হালফিলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জিমে গিয়ে পেশিবহুল চেহারা বানানোর ঝোঁক বেড়েছে। মূলত শাহরুখ, হৃতিকই তাঁদের ‘আইডল’! তারকাদের মতো চেহারা বানাতে কেবল ভারী শরীরচর্চাতেই আটকে থাকেন না তাঁরা। চলে দেদার স্টেরয়েড নেওয়া। ডায়েটে তাঁরা রাখেন প্রোটিন শেক, সেখানেও থাকে স্টেরয়েড। দীর্ঘ দিন ধরে স্টেরয়েড নেওয়া শরীরের জন্য একেবারেই ভাল নয়। এতে বাড়ে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি।
সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক আগে থেকে বোঝা না গেলেও অ্যাকিউট মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন হলে বেশ কিছু লক্ষণ দেখা যায়। এই উপসর্গগুলি আমরা অনেক ক্ষেত্রেই অন্য রোগের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলি।
এই প্রকার হৃদ্রোগের উপসর্গ কী? এই প্রকার হার্ট অ্যাটাকে বুকে চাপ, ব্যথা, এগুলি মাঝেমাঝে হয়। আবার সেরেও যায়। আমরা ভেবে বসি গ্যাসের সমস্যা।
মাঝেমাঝে বুকে চিনচিনে ব্যথা এই প্রকার হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম লক্ষণ। বুকের বাঁ দিকে ব্যথা তো বটেই, অনেক সময়ে গোটা বুক জুড়েই চাপ ও অস্বস্তি অনুভব করেন রোগী।
শুধু বুকেই নয়, বাহু, পিঠ, ঘাড় ও চোয়ালে ব্যথাও কিন্তু এই ধরনের হার্ট অ্যাটাকের পূর্বলক্ষণ হতে পারে। সঙ্গে শ্বাসকষ্টের সমস্যাও দেখা যায়।
খুব অল্পেই ক্লান্ত হয়ে পড়া, সামান্য শারীরিক পরিশ্রমেই হাঁপাতে দেখা যায়। এমনকি, এক জায়গায় বসে থেকেও ক্লান্তি আসতে পারে এমন অবস্থায়।
শীতকালেও অস্বাভাবিক ভাবে ঘেমে যাচ্ছেন? কিংবা মাঝেমাঝেই ঠান্ডায় কাঁপুনি দিচ্ছে? এই লক্ষণগুলি দেখা দিলেও সাবধান হতে হবে।
এই প্রকার উপসর্গ দেখা দিলে অবহেলা নয়। কোলেস্টেরল ও ওবেসিটি থাকলে সচেতন থাকুন, প্রতি তিন মাস অন্তর লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা করান। নিয়মিত শরীরচর্চা ও হাঁটাহাঁটি বজায় রাখুন। ডায়েটে বাদ দিন তেল-মশলার আধিক্য। যোগ করুন সবুজ শাকসব্জি ও ফল।
ধরুন আপনার কোনও রোগ নেই, তবুও ৬ মাস অন্তর অন্তর শারীরিক পরীক্ষা করাতেই হবে। ডায়াবিটিস, কোলেস্টেরল, রক্তচাপ বেড়েছে কি না তা পরীক্ষা করিয়ে নিলেই ভাল। এই সব রোগ শরীরে বাসা বাঁধলেই কিন্তু বাড়ে হৃদ্রোগের ঝুঁকি!
হার্টের সমস্যায় ভুগছেন কি না, তা সব সময়ে আগে থেকে বোঝা কিংবা জানা সম্ভব নয়। হয়তো যখন জানতে পারলেন, আপনার হাতে চেষ্টা করার সময়টা পর্যন্ত নেই। তাই প্রাক্-উপসর্গের অপেক্ষায় বসে থাকবেন না। সব সময়ে তা দৃশ্যমান না-ও হতে পারে। হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি এড়াতে নিজের যত্ন নিন। স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার দিকে জোর দিন। চিকিৎসকের সঙ্গে সংযোগে থাকুন।
যদি হার্টের সমস্যা ধরা পড়ে, তা হলে শরীরচর্চা করার ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা নিতে হবে। রক্তচাপ, কোলেস্টেরল থাকলেও চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে তবেই শরীরচর্চা করুন। আদৌ ভারী শরীরচর্চা করবেন কি না, তা জেনে নিন চিকিৎসকের কাছ থেকে।