এক দিকে চিন, অন্য দিকে পাকিস্তানে। দুই প্রান্তের জোড়া শত্রুর মোকাবিলায় নৌসেনাকে ঢেলে সাজাচ্ছে ভারত। আর তাই পরমাণু শক্তিধর ডুবোজাহাজ থেকে শুরু করে বিমানবাহী রণতরী জল-ফৌজের হাতে তুলে দিয়েছে নয়াদিল্লি।
২০২৩ সালের গ্লোবাল ন্যাভাল পাওয়ার র্যাঙ্কিং অনুযায়ী, ভারতের হাতে রয়েছে বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম নৌসেনা। বর্তমানে জল-ফৌজের নিরিখে আমেরিকাকে সমানে সমানে টক্কর দিচ্ছে চিন। বেজিংয়ের কাছে রয়েছে ৭৩০টি যুদ্ধজাহাজ ও ৫৯টি ডুবোজাহাজ।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, ভবিষ্যতে ভারত-চিন যুদ্ধ হলে তা শুধুমাত্র অরুণাচল প্রদেশ, সিকিম ও লাদাখে আটকে থাকবে না। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরেও ছড়াবে সেই সংঘর্ষ। সেই কথা মাথায় রেখেই নৌসেনার শক্তি বৃদ্ধি করছে নয়াদিল্লি।
বর্তমানে ভারতীয় নৌসেনার হাতে বিমানবাহী রণতরী, উভচর মালবাহী ডক, ল্যান্ডিং শিপ ট্যাঙ্কস, ডেস্ট্রয়ার, ফ্রিগেট, পরমাণু শক্তিধর ডুবোজাহাজ, ডিজ়েল চালিত ডুবোজাহাজ, করভেট, লার্জ অফসোর ভেসেল, ফ্লিট ট্যাঙ্কার এবং আনুষঙ্গিক কিছু জলযান রয়েছে। নিখুঁত নিশানায় হামলা করে চোখের নিমেষে শত্রু ঘাঁটি উড়িয়ে দিতে এগুলি সিদ্ধহস্ত।
ভারতীয় নৌসেনার হাতে রয়েছে দু’টি বিমানবাহী রণতরী। যেগুলির পরিচয় আইএনএস বিক্রমাদিত্য ও আইএনএস বিক্রান্ত। আগামী দিনে আরও একটি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে নয়াদিল্লির।
২০১৩ সালে নৌসেনায় কর্মজীবন শুরু করে আইএনএস বিক্রমাদিত্য। যা ৩৬টি যুদ্ধবিমান নিয়ে জলে ভাসতে সক্ষম। এতে থাকে মিগ ২৯কেইউবি ও মিগ ২৯ কে ফাইটার। এই রণতরী থেকে চেতক, ধ্রুব ও কামোভ কেএ-৩১ চপার উড়িয়ে থাকে ভারতীয় নৌসেনা।
বিমানবাহী এই রণতরীটির জন্ম সাবেক সোভিয়েতে। ১৯৮৭ সালে রুশ নৌসেনা এটিকে ব্যবহার করা শুরু করে। ওই সময় এর নাম ছিল ‘অ্যাডমিরাল গোরশকভ’। কিন্তু সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পর যুদ্ধজাহাজটিকে ভারতের কাছে বিক্রি করে দেয় মস্কো। এর পরই নয়ারূপে আত্মপ্রকাশ করে ওই বিমানবাহী রণতরী।
২০২৩ সালে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি আইএনএস বিক্রান্ত হাতে পায় ভারতীয় নৌসেনা। যা তৈরি করেছে কেরলের কোচিন শিপ ইয়ার্ড। ২৮২ মিটার লম্বা এই যুদ্ধজাহাজটি সর্বোচ্চ ২৮ নটিক্যাল মাইল বেগে ছুটতে সক্ষম। ২৬টি রাফাল এম ফাইটার রাখার জায়গা রয়েছে এই রণতরীতে। এ ছাড়া একাধিক চপার নিয়েও ভাসতে পারবে এটি।
বিমানবাহী রণতরীর পরই আসবে ডুবোজাহাজের কথা। ভারতীয় নৌসেনার হাতে রয়েছে পরমাণু শক্তিচালিত এবং পারমাণবিক অস্ত্রবাহী ২টি ডুবোজাহাজ। যার নাম আইএনএস আরিহান্ত ও আইএনএস অরিঘাট। এগুলি কে ১৫ সাগরিকা ও কে ৪ ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম।
কে ১৫ সাগরিকার পাল্লা ৭৫০ থেকে ৮০০ কিলোমিটার। অন্য দিকে, সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম কে ৪। শেষের ক্ষেপণাস্ত্রগুলি পরমাণু হাতিয়ার বহনেও সক্ষম। পরমাণু শক্তিচালিত ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে সক্ষম আরও একটি ডুবোজাহাজ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে নয়াদিল্লির।
ভারতের কাছে বর্তমানে ১৭টি ডিজেল চালিত ডুবোজাহাজ রয়েছে। যার মধ্যে আইএনএস কালভেরি, আইএনএস করঞ্জ এবং আইএনএস সিন্ধুঘোষ উল্লেখযোগ্য। ডুবোজাহাজের সংখ্যা আরও বাড়াতে রাশিয়া, ফ্রান্স ও আমেরিকার সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে কেন্দ্র।
এ ছাড়া নৌসেনার হাতে রয়েছে বেশ কয়েকটি ডেস্ট্রয়ার শ্রেণির যুদ্ধজাহাজ। এই রণতরীগুলি ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম। যার মধ্যে রয়েছে ‘ব্রহ্মস’ ক্ষেপণাস্ত্রও। ভারতের ডেস্ট্রয়ার যুদ্ধজাহাজের মধ্যে আইএনএস বিশাখাপত্তনম, আইএনএস ইম্ফল, আইএমএস সুরত ও আইএনএস মর্মাগাঁও উল্লেখযোগ্য।
চলতি মাসেই রাশিয়ার থেকে দু’টি স্টেলথ ফ্রিগেট পাবে ভারত। এ ছাড়াও ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম এই ধরনের বেশ কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ রয়েছে নয়াদিল্লির কাছে। তবে ফ্রিগেট জাহাজ ডেস্ট্রয়ারের মতো বড় নয়। এর ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা করার পাল্লা সাধারণত কম হয়ে থাকে।
১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানের করাচি বন্দরে হামলা চালিয়ে গোটা দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ভারতীয় নৌসেনা। যার পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন ট্রাইডেন্ট’। ভারতের ওই আক্রমণে পাক নৌসেনা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।
অপারেশন ট্রাইডেন্টে ভারতীয় নৌবাহিনীর তিনটি জাহাজ, আইএনএস বীর, আইএনএস নিপত ও আইএনএস নির্ঘাট করাচি বন্দরে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। আচমকা ওই আক্রমণে তিনটি যুদ্ধজাহাজ হারায় পাকিস্তান। যার মধ্যে ছিল একটি মাইন সুইপার, একটি ডেস্ট্রয়ার ও একটি গোলা-বারুদ ভর্তি মালবাহী জাহাজ।
এ ছাড়া করাচি বন্দরের তেলের ডিপোতেও হামলা চালিয়েছিল ওই তিন ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ। ফলে বন্দরের একাংশে ভয়ঙ্কর আগুন লেগে যায়। অপারেশন ট্রাইডেন্টের তিন দিনের মাথায় ফের করাচি বন্দরে হামলা করে ভারতীয় নৌসেনা। সেই অপারেশনের কোড নাম ছিল ‘পাইথন’।
এই দুই অপারেশনে ভারতীয় নৌসেনার কোনও লোকসান হয়নি। পরবর্তী কালে ৪ ডিসেম্বরের হামলার কথা মনে রেখে ওই তারিখে ‘নৌসেনা দিবস’ পালন করা হয়।
মরাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছত্রপতি শিবাজিকেই ভারতীয় নৌবাহিনীর জনক বলে মনে করা হয়। ২০২৩ সালে ব্রিটিশ আমলে ব্যবহৃত পতাকা বদল করেছে ভারতীয় নৌসেনা। বর্তমানে সেখানে ব্যবহার হচ্ছে মরাঠাদের প্রতীক চিহ্ন।