২০১০ সালের ১২ জুন। আন্তর্জাতিক টি২০ ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন তিনি। বীরেন্দ্র সহবাগ, গৌতম গম্ভীর, যুবরাজ সিংহ, মহেন্দ্র সিংহ ধোনির মতো তারকারা তখন ভারতীয় ক্রিকেটের এক এক জন মহারথী। সেই ভিড়ে ছোট্ট ছেলেটা কিছুটা শান্তই ছিলেন। তার পর কেটে গিয়েছে ১৪ বছর। ২০২৪ সালের ২৯ জুন। জীবনের শেষ আন্তর্জাতিক টি২০ ম্যাচ খেললেন সে দিনের সেই ছোট্ট ছেলেটা। এখন আর তিনি শান্ত নন, আগ্রাসী মনোভাবের জন্যই পরিচিত। তিনি বিরাট কোহলি।
১৪ বছরে ১২৫টি টি২০ ম্যাচ খেলেছেন বিরাট। রান করেছেন চার হাজারের বেশি। ক্রিকেট কেরিয়ারে খেলেছেন ছ’টি টি২০ বিশ্বকাপ। অনেক উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে টি২০ কেরিয়ার শেষ করলেন কোহলি।
যেমন প্রশংসা কুড়িয়েছেন, তেমনই সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছেন। অনেকেই তাঁকে অবসর নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু কখনওই মুখে জবাব দেননি তিনি। পরিশ্রম করে ব্যাট হাতে জবাব দিয়েছেন। বার বার ফিরে এসেছেন।
টেস্ট, একদিনের ক্রিকেটের মতো টি২০-তেও নিজের ক্যারিশ্মা দেখিয়েছেন বিরাট। তাঁর ক্রিকেটীয় শট ছিল রূপকথার মতো। অনেকেই তাঁকে সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কিন্তু বিরাট সর্বদাই সেই তুলনা এড়িয়ে গিয়েছেন।
শনিবার টি২০ বিশ্বকাপ জিতে বিরাট কোহলি যখন এই ফরম্যাট থেকে অবসরের কথা ঘোষণা করলেন, তখন অনেকের চোখেই জল বাঁধ ভেঙেছিল। কথায় আছে, ‘শেষ ভাল যার সব ভাল তার’। বিরাটের জন্য সেই প্রবাদ অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হল শনিবার।
২০১০ সালে টি২০ ম্যাচে হাতেখড়ি হলেও বিরাট প্রথম ওই ফরম্যাটে বিশ্বকাপ খেলেন ২০১২ সালে। কিন্তু সে বার ভারতের জন্য বিশ্বকাপ ভাল যায়নি। সুপার ৮ থেকেই বিদায় নিতে হয় ভারতকে। তবে সুপার ৮-এ স্মরণীয় হয়ে রয়েছে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ।
ভারতের চির প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান। সব সময়ই এই দু’পক্ষের লড়াই হাইভোলটেজ ম্যাচ। ২০১২ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর সেই ম্যাচে চাপে ছিল ভারত। কারণ আগের ম্যাচ অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে হারতে হয়েছিল তাদের। সেই ম্যাচে প্রথমে বল করে পাকিস্তানকে মাত্র ১২৮ রানে আটকে দিয়েছিলেন ভারতীয় বোলারেরা।
তবে সেই রান তাড়া করতে নেমে প্রথম ওভারেই গৌতম গম্ভীরের উইকেট খুইয়ে চাপে পড়ে যায় ভারত। তখনই ব্যাট হাতে ম্যাচের রাশ ধরেন কোহলি। ৬১ বলে ৭৮ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে ভারতকে ম্যাচ জিতিয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন তিনি।
২০১৪ সালের বিশ্বকাপেও মনে রেখে দেওয়ার মতো ইনিংস খেলেছিলেন কোহলি। সেই কথা বলতে গেলেই উঠে আসে সে বারের সেমিফাইনালের কথা। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সেই ম্যাচ খেলেছিল ভারত। প্রথমে ব্যাট করে প্রোটিয়ারা ২০ ওভারে তোলে ১৭২ রান। জবাবে শুরুটা ভারত ভালই করেছিল। কিন্তু একটা সময় চাপে পড়ে যায় তারা।
সেখানেই ত্রাতা হয়ে সামনে আসেন বিরাট। ধীর গতিতে নিজের ইনিংস শুরু করলেও শেষের দিকে হাত খোলেন। ৪৪ বলে ৭২ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন তিনি। সেই ম্যাচে কোহলির স্ট্রাইক রেট ছিল ১৬৩.৬৪ শতাংশ। তবে ফাইনালে উঠলে সে বার বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছিল ভারতের। শ্রীলঙ্কার কাছে হারায় বিশ্বকাপ জয় অধরা থেকে যায়।
দু’বছর পর আবার একটা টি২০ বিশ্বকাপ। নেতৃত্বে তখনও মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। ভারতের মাটিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্বকাপটি। গ্রুপ পর্বেই ভারত মুখোমুখি হয়েছিল চির প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের। ইডেন গার্ডেন্সে ছিল ম্যাচ। ক্রিকেটপ্রেমীদের ভিড়ে উপচে পড়েছিল ক্রিকেটের নন্দন কাননে। কিন্তু বৃষ্টির জন্য খেলা হওয়াই এক সময় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত ১৮ ওভারের ম্যাচ হয়।
পাকিস্তান সে ম্যাচে প্রথম ব্যাট করে ১১৮ রান তুলতে পেরেছিল। রান তাড়া করতে নেমে দুই পাক পেসারের দাপটে চাপে পড়ে যায় ভারত। একটা সময় ভারতের স্কোর দাঁড়ায় ৪.৪ ওভারে ২৩ রানে ৩ উইকেট। সেখান থেকে কোহলির ব্যাটে ভর করে ম্যাচ জেতে ভারত। সে দিন বিরাট আবার প্রমাণ করেছিলেন কেন তাঁকে ‘চেজ় মাস্টার’ বলা হয়। ৩৭ বলে ৫৫ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি।
২০১৬ সালের বিশ্বকাপেই বিরাটের আরও একটি স্মরণীয় ইনিংস রয়েছে। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচ। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সেই ম্যাচ ছিল ‘ডু অর ডাই’। অলিখিত কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছিল ভারত।
অস্ট্রেলিয়ার ১৬০ রানের জবাবে ব্যাট করতে নেমে ভারতের টপ অর্ডার বড়সড় ধাক্কা খায়। ৭.৪ ওভারে ভারতের স্কোর ছিল মাত্র ৪৯ রান। উইকেট পড়ে গিয়েছিল তিনটে। সেই ম্যাচে বিরাট খেলেছিলেন ৫১ বলে ৮২ রানের অপরাজিত ইনিংস। একটা সময় ভারতের প্রয়োজন ছিল তিন ওভারে ৩৯ রান। ১৮তম ওভারে বিরাট দু’টি চার এবং একটি ছয় মেরে চাপমুক্ত করেন। আর পরের ওভারে চারটে চার মেরে জয় নিশ্চিত করেছিলেন কোহলিই।
২০২১ সালের বিশ্বকাপ ভারতের জন্য ছিল দুঃস্বপ্ন। শুধু ভারতের জন্য নয়, কোহলির জন্যও। সেই বিশ্বকাপে ভারত গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয়। কোহলির নেতৃত্বে সে বারের বিশ্বকাপে ভারতের হতশ্রী পারফম্যান্স নিয়ে কম সমালোচনা হয়নি। বিশ্বকাপ শেষে অধিনায়কের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন কোহলি।
সে বার একেবারেই ফর্মে ছিলেন না বিরাট। ব্যর্থতা পিছু ছাড়ছিল না তাঁর। সে বারই প্রথম কোনও বিশ্বকাপে ভারত হেরেছিল পাকিস্তানের কাছে। সেই ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে ভারত তুলেছিল সাত উইকেটে ১৫১। বিরাট করেছিলেন ৫৭ রান। তবে বল হাতে কোনও বোলারই দাগ কাটতে পারেননি। ১০ উইকেটে ম্যাচ হারে ভারত।
২০২২ সালের বিশ্বকাপের শুরুটা সেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই করেছিল ভারত। তত দিন ভারতীয় দলের অনেক কিছু বদলে গিয়েছে। কোহলির পর রোহিত ভারতীয় ক্রিকেট দলের নেতৃত্বে আসেন। মেলবোর্নে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ নিয়ে টান টান উত্তেজনা ছিল। প্রথম ব্যাট করে ভারত তোলে ১৫৯ রান। ভারতের শুরুটাও খারাপ হয়েছিল। পর পর উইকেট হারাতে থাকে ভারত। নাসিম শাহ, হ্যারিস রউফ, শাহিন আফ্রিদিদের মতো বোলারদের সামনে ভারতীয় টপ অর্ডার তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে।
সেখান থেকে ম্যাচের হাল ধরেন বিরাট। তাঁকে যোগ্য সঙ্গত দেন হার্দিক পাণ্ড্য। পঞ্চম উইকেটে এই জুটি স্কোরবোর্ডে যোগ করে ১১৩ রান। কিন্তু তাতেও জেতার মতো পরিস্থিতি ছিল না। শেষ তিন ওভারে ভারতের জন্য প্রয়োজন ছিল ৪৮ রান। ১৮তম ওভারে শাহিন আফ্রিদি বল করতে আসেন। সেই ওভারে ১৮ রান ওঠে। তার মধ্যে কোহলিরই ১৫ রান।
পরের ওভারে হ্যারিস রউফ ভারতের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন। প্রথম চার বলে দেন মাত্র দু’রান। তবে শেষ দুই বলে পর পর দু’টি ছক্কা হাঁকান বিরাট। শেষ ওভার ছিল টান টান উত্তেজনার। ভারতের জিততে প্রয়োজন ছিল ১৬ রান। সেই ওভারেই আউট হন হার্দিক। তবে শেষ পর্যন্ত ভারত ম্যাচটি জেতে। ৫৩ বলে ৮২ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন বিরাট।
তার পর ২০২৪। ১ জুন থেকে শুরু হওয়া এই বিশ্বকাপ নিয়ে তেমন উন্মাদনা ছিল না দর্শকদের মধ্যে। কিন্তু ২৯ জুন সেই ছবি পাল্টে দিয়েছে। গোটা টুর্নামেন্টে একটা ম্যাচও না হেরে ফাইনাল খেলেছে ভারত। যতই ভারত ফেভারিট থাকুক না কেন, দক্ষিণ আফ্রিকা যে কোনও সময় ‘অঘটন’ ঘটাতে পারে বলে বিশ্বাস ছিল সকলেরই। তবে শেষ হাসি হেসেছে ভারতই।
ফাইনালের আগে এ বারের বিশ্বকাপে বিরাটের ফর্ম নিয়ে কম সমালোচনা হয়নি। কেন তাঁকে দিয়ে ওপেন করানো হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্নও তুলেছিলেন অনেকে। ব্যাটে রান ছিল না একেবারেই। সেমিফাইনালের পরে বিরাটকে নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল রোহিতকেও। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘ফাইনালের জন্য সেরাটা তুলে রেখেছে বিরাট!’’ হলও তাই। ফাইনালে ৭৬ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। ভারতীয় ব্যাটারদের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। জেতেন ‘প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচ’ পুরস্কারও।
টি২০ বিশ্বকাপে শতরান না থাকলেও ১৪টি অর্ধশতরান রয়েছে বিরাটের। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি অর্ধশতরান তাঁরই দখলে। শনিবারের ম্যাচ জেতার পর আন্তর্জাতিক টি২০ থেকে অবসর ঘোষণা করেছেন তিনি। এই ফরম্যাটে শেষ হল বিরাট জমানা। লিখে রেখে গেলেন অনেক ইতিহাস।