সালটা ২০০৮। তারিখ ১৮ অগস্ট। প্রতিপক্ষ ছিল শ্রীলঙ্কা। এক দিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল বিরাট কোহলির। ডামবুলার মাঠে। সেই দিন মাত্র ১২ রান করেই ফিরে যেতে হয়েছিল তরুণ ক্রিকেটারকে। ম্যাচটা হেরেও ছিল ভারত। তার পর প্রথম শতরান আসতে লেগে গিয়েছিল একটা গোটা বছর।
তারিখ— ২০০৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর। স্থান— কলকাতার ইডেন গার্ডেন্স। প্রতিপক্ষ সেই শ্রীলঙ্কা। দ্বিতীয় ইনিংসে ১০৭ রান করে এক দিনের ক্রিকেটে শতরান-যাত্রা শুরু করেছিলেন কোহলি। ভারত সেই ম্যাচটা জিতেছিল। ১৪ বছর পর সেই ই়ডেনেই ‘ঈশ্বর’কে ছুঁয়ে ফেললেন কোহলি।
এখনও সচিন তেন্ডুলকরকেই ক্রিকেটের ‘ঈশ্বর’ বলে মানেন অধিকাংশ ভারতীয়। সেই সচিনের এক দিনের ক্রিকেটে ৪৯টি শতরানের রেকর্ড স্পর্শ করলেন কোহলি। রবিবার দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ১২১ বলে ১০১ রানের (অপরাজিত) ইনিংস খেললেন ‘চিকু’ (এই নামেই কোহলিকে ডেকে থাকেন সতীর্থেরা)। এর জন্য কোহলিকে শুভেচ্ছা বার্তাও দিয়েছেন সচিন। এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) লিখেছেন, ‘’৪৯ থেকে ৫০-এ পা দিতে ৩৬৫ দিন লেগেছে আমার। আশা করছি, তুমি কয়েক দিনের মধ্যেই ৪৯ থেকে ৫০-এ পা দেবে।’’
এক দিনের ক্রিকেটে শতরানের পরিসংখ্যান বলছে, সচিনকে বারবার পিছনে ফেলেছেন কোহলি। দু’জনেই জীবনের প্রথম শতরান করেন ২১ বছর বয়সে। তার পর প্রথম ১০টি শতরান করতে সচিন নিয়েছিলেন ১৩১টি ইনিংস। কিন্তু বিরাটের প্রথম ১০ শতরান এসেছিল ৮০টি ইনিংসে। অর্থাৎ শুরু থেকেই শতরান করার গতিতে সচিনের থেকে অনেক এগিয়ে বিরাট।
কোহলিই ভেঙেছিলেন সচিনের দ্রুততম ১৫টি শতরানের রেকর্ড। তখন চিকুর বয়স ২৪। সচিন ৪৯টি শতরান করেছিলেন ৪৬২টি ইনিংসে। সেই মাইলফলক মাত্র ২৮৯টি ইনিংসেই ছুঁয়ে ফেললেন বিরাট।
শুধু তা-ই নয়, যে ম্যাচে শতরান এসেছে, সেই ম্যাচ ভারত জিতেছে কি না, তার নিরিখেও এগিয়ে কোহলি। পরিসংখ্যান বলছে, সচিনের ৩৩টি শতরান ভারতকে ম্যাচ জিততে সাহায্য করেছে। অন্য দিকে, কোহলি ৪০টি ম্যাচে সেঞ্চুরি করে দেশকে জিতিয়েছেন।
দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং করে সচিন ১৭টি শতরান করেছেন। আর কোহলি করেছেন ২৭টি। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত, রান তাড়া করে কী ভাবে নিয়মিত ম্যাচ জেতা যেতে পারে, তা এক রকম ভাবে কোহলিই শিখিয়েছেন ভারতীয় দলকে।
বিশ্বকাপে শতরানে অবশ্য সচিন এখনও এগিয়ে। যদিও সচিন কোহলির চেয়ে বেশি বিশ্বকাপ খেলেছেন। ছ’টি বিশ্বকাপ খেলে সচিনের ঝুলিতে ছ’টি শতরান রয়েছে। আর কোহলি খেলেছেন চারটি বিশ্বকাপ। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে চারটি শতরান।
ঘরের মাঠে সব চেয়ে বেশি শতরান করেছেন কোহলি। দেশের মাটিতে সচিন করেছেন ২০টি সেঞ্চুরি। আর কোহলি ২৩টি। সচিন সব চেয়ে বেশি শতরান করেছেন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। সব মিলিয়ে ন’টি। আর বিরাটের সব চেয়ে বেশি শতরান এসেছে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে। মোট ১০টি।
এখন কোহলির বয়স ৩৫। পরিসংখ্যান বলছে, ৩৫ বছর বয়সি সচিনকে আরও নানা ক্ষেত্রে পিছনে ফেলেছেন বিরাট। ৩৫ বছর বয়সে এক দিনের ক্রিকেটে সচিন করেছিলেন ১৬,৩৬১ রান। ইনিংস খেলেছিলেন ৪০৭টি। আর বিরাট করেছেন ১৩,৫২৫ রান। তবে খেলেছেন ২৭৫টি ইনিংস। তাই সচিনের থেকে রান কম হলেও গড় অনেকটাই বেশি। ৩৫-এর সচিনের গড় ছিল ৪৪.৩৩। বিরাটের সেখানে ৫৮.০৪। হিসাবই বলছে, সচিনের সমান ম্যাচ খেললে তাঁকে ছাপিয়ে যেতে পারতেন বিরাট।
ভারতীয় ক্রিকেট মহলে প্রায়ই শোনা যায়, এক জন ভারতীয় ব্যাটার কত ভাল, তা বোঝা যায় অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং নিউ জ়িল্যান্ডের মাটিতে তিনি কেমন খেলছেন, তার উপর। এক দিনের ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সচিন খেলেছেন ৩৯টি ইনিংস। করেছেন ১৩৪৮ রান। গড় ৩৭.৪৪। বিরাট সেখানে ৩৫-এর সচিনকে ছাপিয়ে গিয়েছেন বলাই যায়। কারণ সচিনের থেকে ১০টি ইনিংস কম খেলে বিরাট করেছেন ১৩২৭ রান। গড় ৫১.০৩। শতরানের সংখ্যায় বিরাটের থেকে বেশ পিছিয়ে সচিন। ৩৫-এর সচিন অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে এক দিনের ক্রিকেটে করেছিলেন মাত্র একটি শতরান। বিরাট করেছেন পাঁচটি।
ইংল্যান্ডের মাটিতে আবার সচিনের থেকে বেশি ইনিংস খেলেছেন বিরাট। ২৬টি ইনিংস খেলে সচিন সেখানে ১০৫১ রান করেছিলেন। বিরাট ৩৩টি ইনিংসে করেছেন ১৩৪৯ রান। গড় বেশি বিরাটেরই।
সচিন এবং বিরাট একসঙ্গে পাঁচ বছর খেলেছেন। এক দিনের ক্রিকেটে ১৭টি ম্যাচে তাঁরা একসঙ্গে খেলেছেন। সেই ম্যাচগুলিতে সচিন করেছিলেন ৮৩৫ রান। বিরাট চারটি শতরান-সহ করেছিলেন ১১৫৯ রান। ৩১টি টেস্টে একসঙ্গে খেলেছিলেন তাঁরা। সেখানে সচিন সামান্য এগিয়ে বিরাটের থেকে। সচিন করেছিলেন ১৩৫২ রান। বিরাট করেছিলেন ১৩৪৭ রান। যদিও গড় (৫১.৮০) বেশি বিরাটের। দু’জনেই ওই ৩১টি টেস্টে পাঁচটি করে শতরান করেছিলেন।
সাদা বলের ক্রিকেটে রান পেলেও দলকে একার হাতে এখনও ট্রফি জেতাতে পারেননি বিরাট। ২০১১ সালের বিশ্বকাপ দলে বিরাট ছিলেন। তিনি ৯ ম্যাচে ২৮২ রান করেছিলেন। সেই বিশ্বকাপে সচিন ৯ ম্যাচে করেন ৪৮২ রান। পরবর্তী সময় বিরাট দেশের অধিনায়কও হয়েছেন, কিন্তু দলকে ট্রফি এনে দিতে পারেননি। গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সব থেকে বেশি রান এসেছে তাঁর ব্যাট থেকে। কিন্তু দল বিদায় নেয় সেমিফাইনাল থেকে।
লাল বলের ক্রিকেটে অবশ্য অনেক এগিয়ে সচিন। তাঁর ঝুলিতে ৫১টি শতরান রয়েছে। আর কোহলি এখনও পর্যন্ত করেছেন ২৯টি। এখন তাঁর যা বয়স, সেই হিসাবে আদৌ ওই রেকর্ড ছোঁয়া কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সচিনের সব মিলিয়ে ১০০টি শতরানের রেকর্ডও কোহলি স্পর্শ করতে পারবেন কি না, তা সময়েই বলবে। কোহলি এখন দাঁড়িয়ে ৭৯-এ।