গায়ে ফোস্কা ফেলা গরম থেকে নিস্তার পেতে ভরসা বৃষ্টি। অথচ বৃষ্টি আসবে বলেও আসছে না। বর্ষার এখনও কিছুটা দেরি। তার আগে বৃষ্টির দেবতার মন পেতে নানা রকম আয়োজন শুরু করেছেন ভারতের একটি রাজ্যের বাসিন্দারা।
ভারতের দক্ষিণ ভারতের রাজ্য কর্নাটকের কয়েকটি গ্রামে নাকি বৃষ্টি একেবারেই পড়ছে না। যদিও রাজ্যের বাকি জেলাগুলি বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে।
কোথাও কোথাও বৃষ্টির চোটে বন্যা হওয়ার জোগাড়। অথচ কর্নাটকের গড়গ জেলা এবং বিজয়পুরা জেলার কয়েকটি গ্রামে ছিটেফোঁটা বৃষ্টিরও দেখা নেই। গ্রামে বৃষ্টি নামাতে তাই নানা রকম চেষ্টা শুরু করেছেন গ্রামবাসীরা।
গডগের লক্ষ্মেশ্বর গ্রামের বাসিন্দারা যেমন পুতুলের বিয়ে দিয়েছেন!
কাপড়ের দু’টি পুতুলকে বর-বউ সাজিয়ে তাদের গ্রামের ছেলে-মেয়ের মতোই আদরযত্ন করে দেওয়া হয়েছে বিয়ে। মানুষের বিয়ে আর পুতুলের বিয়ের ফারাক ছিল না কোনও। সমস্ত রীতি মেনেই হয়েছে অনুষ্ঠান।
প্রথমে পাত্রীপক্ষ এবং পাত্রপক্ষে কারা থাকবেন, তা ঠিক করেছেন গ্রামবাসীরা। তার পর গায়েহলুদ থেকে শুরু করে কন্যাদান, সিঁদুরদান, সাত পাক ঘোরা, এমনকি নববিবাহিত পুতুল-বউকে পুতুল-বরের সঙ্গে জাঁকজমক করে তার ‘বাড়ি’তে পাঠানোর ব্যবস্থাও হয়েছে।
আর পাঁচটা বিয়েবাড়ির মতোই এই বিয়েতেও ছিল ঢালাও খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। পাত পেড়ে পুতুলের বিয়ে খেয়েছেন গ্রামের লোকই।
তাঁরা জানিয়েছেন, এ সবই আদতে বৃষ্টির দেবতাকে তুষ্ট করার নিয়ম। যা এই গ্রামে দীর্ঘ দিন ধরে পালন করা হচ্ছে। আর তাঁরা দেখেছেন, যত বারই এই নিয়ম পালন করা হয়েছে, তার সাত দিনের মধ্যে বৃষ্টি নেমেছে গ্রামে।
লক্ষ্মেশ্বরের মতোই অবস্থা বিজয়পুরার কালাকেরি গ্রামের। চাতকের মতো এক ফোঁটা বৃষ্টির আশায় দিন গুনছে কর্নাটকের এই গ্রাম।
পাশের গ্রামে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হলেও এই গ্রামে বৃষ্টি হয়নি। গ্রামবাসীদের ধারণা, তাঁদের উপর মৃত আত্মাদের অভিশাপ লেগেছে।
আত্মাদের তুষ্ট করতে কালকেরি গ্রামেরও এক অদ্ভুত নিয়ম আছে। সেখানে বৃষ্টি আনতে কবর খুঁড়ে তুলে আনা হয় মৃতদেহ। তার পর পাম্প করে জল ঢুকিয়ে দেওয়া হয় মৃতদেহের মুখে।
সব মিলিয়ে দেড় হাজার মানুষের বাস কালকেরিতে। এখানকার সবাই প্রায় অড়হর ডালের চাষ করেন। তাই বৃষ্টি হওয়া বা না হওয়ার উপর তাঁদের গোটা বছর নির্ভর করে।
গত বছরও ঠিক এমনই হাল হয়েছিল কালকেরিতে। গত বছরও এই নিয়ম পালন করা হয়েছিল। গ্রামে মৃতদের একটি তালিকা তৈরি করে, সেই তালিকা ধরে একের পর এক মৃতদেহকে জল ‘খাওয়ানো’ হয়েছিল কর্নাটকের এই গ্রামে। আর আশ্চর্যজনক বিষয় হল, তার পরে বৃষ্টিও নেমেছিল গ্রামে।
প্রতিটি কবরের ঠিক মাথার দিকে পাইপ ঢুকিয়ে পাম্প করে জল ঢোকানো হচ্ছিল। ২৫তম কবরটিতে যখন জল দেওয়া হচ্ছে, ঠিক তখনই গ্রামে বৃষ্টি নামে!
কালকেরির গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন বহু বছর আগে হাঁ করে মুখ খোলা অবস্থায় এক ব্যক্তির মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়েছিল কালকেরিতে। সে বছর গোটা গ্রামে খরা হয়েছিল।
গ্রামের বয়স্করা এর পর এক জ্যোতিষীকে বিষয়টি জানাতে তিনি বলেন, তৃষ্ণার্ত মৃতদেহকে কবর দেওয়ার জন্যই গ্রামবাসীদের ‘শাস্তি’ পেতে হচ্ছে।
এর পর ওই জ্যোতিষীর কথা শুনেই ওই ব্যক্তির কবরে জল প্রবেশ করানো হয়। কথিত আছে তার পরেই বৃষ্টি নেমেছিল গ্রামে। এই ঘটনায় গ্রামবাসীদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায়। যা আজও চলে আসছে।
দীর্ঘ দিন বৃষ্টি না হলে আরও এই রকম আরও অনেক প্রথা মেনে চলেন বিভিন্ন প্রদেশের মানুষজন। বাংলাতেও রয়েছে এমন নানা প্রথা।
বৃষ্টি না হলে বর্ষার রাগ গাওয়ারও চল আছে। সব থেকে প্রচলিত যে গল্প, তা মিয়াঁ তানসেনের। আকবরের সভায় নবরত্নের অন্যতম রত্নটিকে নিয়ে নাকি অনেকেই হিংসায় জ্বলেপুড়ে যেতেন। তাঁরাই নাকি তানসেনকে শেষ করার উপায় হিসেবে তাঁকে দীপক রাগ গাইতে প্ররোচিত করেন। যে রাগ গাইলে আগুনে পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তা হলে সেই আগুনে তানসেনও পুড়ে যেতে পারতেন। এই ছিল তাঁদের অভিসন্ধি।
পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে দীপক গাওয়ার পর বৃষ্টি আনতে মেঘমল্লার গাওয়ার প্রয়োজন। সেটা তানসেন বিলক্ষণ জানতেন। যে কারণে নিজের কন্যা এবং গুরু-কন্যাকে মল্লারে তালিম দেন।
নির্দিষ্ট দিনে যখন তানসেন দীপক রাগ ধরলেন, কিছু ক্ষণের মধ্যে চারদিক তপ্ত হতে থাকল। সভাগৃহের মোমবাতিতে আগুন ধরে গেল। বিপদ বুঝে সবাই দিগ্বিদিক ছুটতে শুরু করলেন। তানসেনের গায়েও প্রবল তাপ। যে তাপ ক্রমে বাড়ছে।
এর পর তানসেন বাড়ির পথ ধরলেন। যেখানে তখন দুই মেয়ে গান ধরেছে মেঘমল্লারে। অতঃপর বৃষ্টি নামল। শান্ত হল বসুধা। প্রাণে বাঁচলেন তানসেনও। এ সবই গল্প কথা এবং মানুষের বিশ্বাস। কে না জানে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু…।