২০১৮ সালের ২২ মে। বেদান্তের স্টারলাইট তামার কারখানা বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচির ১০০তম দিন ছিল। তামিলনাড়ুর থুঠুকুড়িতে বাসিন্দাদের বিক্ষোভে আচমকা চলল পুলিশের গুলি। তার পরই রক্তের স্রোত বয়ে গেল এলাকায়।
পুলিশের গুলিতে ১৪ জনের মৃত্যুর অভিযোগ ঘিরে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল তামিল রাজনীতিতে। যার আঁচ এসে পড়েছিল দিল্লি রাজনীতিতেও।
তামার কারখানার জন্য বিষাক্ত হচ্ছে পরিবেশ। এর জেরে দুরারোগ্য রোগের প্রকোপ বাড়ছে। এই অভিযোগে কারখানা বন্ধের দাবি জানিয়েছিলেন আশপাশের গ্রামবাসীরা।
দেখতে দেখতে পাঁচ বছর পার হয়ে গিয়েছে। এখনও গুলি চালানোর ঘটনার ক্ষত নিয়ে দিন গুজরান করছেন সে দিনের ঘটনায় নিহতদের পরিজনরা। কবে বিচার হবে, এই আশায় বুক বেঁধে রয়েছেন আহতরাও।
গুলি চালানোর ঘটনার তদন্তে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। চলতি বছরের ১২ মে রাজ্য সরকারকে রিপোর্ট জমা দিয়েছে ওই কমিশন। বিচারপতি অরুণা জগদিসান কমিশনের ওই রিপোর্ট ফাঁস হয়ে গিয়েছে।
ওই রিপোর্টে বিচারপতি উল্লেখ করেছেন যে, উস্কানি ছাড়াই আইনের ঊর্ধ্বে গিয়ে গুলি চালিয়েছে পুলিশ। রিপোর্টের ফাঁস হওয়া অংশ প্রকাশ্যে আসতেই তা জনসমক্ষে আনার দাবি উঠেছে। ঘটনায় জড়িত পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে যাতে আইনি পদক্ষেপ করা হয়, সেই দাবি জানিয়েছেন নিহতদের পরিজনরা।
সে দিনের বিক্ষোভ প্রদর্শনে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় অষ্টাদশী স্লোলিনের। ‘দ্য নিউজ মিনিট’-এ স্নোলিনের মা বনিতা বলেন, ‘‘কমিশনের রিপোর্টকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু পদক্ষেপ করতে হবে। দ্রুততার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিনকে ব্যবস্থা নিতে হবে...। এত রক্ত আর চোখের জলের কি বিচার হবে না?’’
বনিতার কথায়, রিপোর্টে যে ১৭ জন পুলিশ আধিকারিকের নাম রয়েছে, তাঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। তিনি আরও বলেছেন, ‘‘স্নোলিনের মৃত্যুর শোকে বাকি জীবনটা কাটাতে হবে। কোনও পদক্ষেপেই ওর জীবন আর ফিরে পাব না। অন্তত বিচার হোক।’’
আদরের সন্তানকে হারানোর যন্ত্রণায় বনিতা বলেছেন, ‘‘এমনটা যেন আর কোনও পরিবারের সঙ্গে না ঘটে। স্নোলিনের মুখ-গলা ফুঁড়ে বুলেট ঢুকে গিয়েছিল। মৃত্যুর আগে কতটা ভয়াবহতা অনুভব করেছিল ওই ছোট মেয়েটা, ভাবুন তো।’’
সে দিন পুলিশের গুলিতে ছেলে রঞ্জিতকে হারিয়েছিলেন মুথুলক্ষ্মী। চলতি বছরের অগস্টে ২৬ বছর বয়স হত রঞ্জিতের। বক্সিং তাঁর নেশা ছিল। তাঁর কথায়, শুধু মাত্র পুলিশের শীর্ষ আধিকারিকরাই নন, এই ঘটনায় কনস্টেবল পর্যায়ের পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিনি বলেছেন, ‘‘এমন অনেক কনস্টেবল রয়েছেন, যাঁরা আমাদের বাড়ির অদূরে বসবাস করেন। তাঁদেরই হাতে বহু মানুষ সে দিন জখম হয়েছিলেন। ওঁদেরকে এ ভাবে স্বাধীন ভাবে ঘোরাফেরা করতে দেখে আমাদের কেমন লাগে ভেবে দেখুন। ওঁরা জানেন আমরা কারা, আমাদের মানুষের চোখেই দেখেন না।’’
রঞ্জিতের মৃত্যুর মুহূর্তের সেই ভয়াবহ স্মৃতি স্মরণ করে তাঁর মা বলেন, ‘‘ওর বাবা দিনমজুর। ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি ছিল ওর। চাকরির চেষ্টায় ছিল। আমরা ওকে বেশি টাকা দিতে পারতাম না। মৃত্যুর সময় ওর পকেটে মাত্র পাঁচ টাকা ছিল।’’
পুলিশের গুলিতে গুরুতর জখম হয়েছিলেন প্রিন্সটন। হামলায় এক পা হারিয়েছেন তিনি।
সে দিনের ঘটনার স্মৃতি আউড়ে তিনি বললেন, ‘‘আমার তখন ২২ বছর বয়স। কেরিয়ার শুরু করছিলাম সে সময়। চেন্নাইয়ে চাকরি করতাম। এআইএডিএমকে সরকার আমায় ‘ভিলেজ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার’ (গ্রাম প্রশাসনিক কর্তা)-র চাকরি দিয়েছিল। এটা ক্ষেত্রসমীক্ষা (‘ফিল্ড ওয়ার্ক’)-র কাজ ছিল। যখন আমি বললাম যে, আমার এক পা নেই, তাই এ কাজ করা মুশকিল। কেউ কর্ণপাত করেননি। পরে আমার হয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ই পলানিস্বামীর কাছে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন প্রভু নামে এক সমাজকর্মী। যে মুখ্যমন্ত্রী এই ঘটনার জন্য দায়ী, তাঁর কাছেই বাধ্য হয়ে চাকরির জন্য যেতে হল।’’
প্রিন্সটন জানান, ডিএমকে সরকারে আসার পর ডেস্কে কাজ পান তিনি। তাঁর কথায়, বর্তমানে স্ট্যালিনের সরকারের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে। পুলিশকর্মীদের বরখাস্ত করতে হবে। যদি কোনও সাধারণ নাগরিক খুন করেন, তা হলে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? তা হলে পুলিশের ক্ষেত্রে কেন সেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? এই প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ই পলানিস্বামীর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ওই যুবক।
বর্তমান সরকার প্রতিশ্রুতি মতো শেষমেশ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কবে নেবে, তারই প্রতীক্ষায় দিন কাটাচ্ছেন প্রিন্সটন, মুথুলক্ষ্মী, বনিতারা।