বন্ধু দেশের শত্রুর প্রতি ‘বন্ধুত্ব’ দেখাতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হল পাকিস্তানকে। পরিস্থিতি এমন যে, এমনিতেই অর্থনৈতিক সঙ্কটে নাজেহাল ইসলামাবাদ নতুন এক বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে।
তিন দিনের সফরে পাকিস্তান সফরে গিয়েছিলেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসি। এই সফরে তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে আটটি সমঝোতাপত্রে (মউ) স্বাক্ষর করেন।
কোন কোন বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে, তা স্পষ্ট ভাবে জানা না গেলেও কানাঘুষোয় জানা গিয়েছে, পাকিস্তানে গ্যাসের পাইপলাইন বসাতেই এই সফর। তবে গোপনে দুই দেশের মধ্যে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সংক্রান্ত চুক্তিও হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে পাকিস্তানের এই আশায় জল ঢেলে আমেরিকা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, ইরানের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তির পথে হাঁটলে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ার ঝুঁকির কথাও মাথায় রাখতে হবে।
আমেরিকান বিদেশ দফতরের মুখ্য সহকারী মুখপাত্র বেদান্ত পটেল এক সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, ‘‘গণবিধ্বংসী অস্ত্র কেনার নেটওয়ার্কের বিস্তার যেখানেই ঘটবে, আমরা সেখানে বাধা দেব এবং ব্যবস্থা নেব। ইরানের সঙ্গে যে কোনও রকম ব্যবসায়িক চুক্তিতে যারা যাবে, তাদের বলব নিষেধাজ্ঞার কোপে পড়ার সম্ভাব্য ঝুঁকির কথাটাও মাথায় রাখতে।’’
নিষেধাজ্ঞার হুঁশিয়ারির কারণ জানতে চাওয়া হলে পটেল বলেন, ‘‘কারণ, এরা হল সেই সব সংস্থা, যারা গণবিধ্বংসী অস্ত্র ছড়িয়ে দিচ্ছে। এদের ঘাঁটি চিন এবং বেলারুশে। এরা পাকিস্তানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পের যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করেছিল।’’ কোন সংস্থা, বেদান্ত অবশ্য তা স্পষ্ট করেননি।
তবে, আমেরিকার তরফে এ-ও জানানো হয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাকিস্তান তাদের গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা সহযোগী। তাই মনে করা হচ্ছে, প্রকারান্তরে হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখলেও এখনই সরাসরি পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতে জড়াতে চাইছে না জো বাইডেনের দেশ।
কিন্তু রইসির সফর নিয়ে গোড়ার দিকে পাকিস্তানে যা সমারোহ, আয়োজন করেছিল, তার জৌলুস অনেকটাই কমে যায় আমেরিকা হুঁশিয়ারি দেওয়ার পর। পাকিস্তানে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর রইসিই প্রথম কোনও রাষ্ট্রপ্রধান, যিনি পাকিস্তানের মাটিতে পা রাখলেন।
পাকিস্তানের বিদেশনীতিতে ইরান যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা দেশ, সেই বার্তা দিতে চেষ্টার কসুর করেনি ইসলামাবাদ। পাকিস্তানের একটি রাস্তার নাম বদলে ‘ইরান অ্যাভিনিউ’ রাখা হয়েছে। ২৩ এপ্রিল রইসির সফর উপলক্ষে করাচিতে সরকারি ছুটি পর্যন্ত দিয়ে দেওয়া হয়।
তিন দিনের সফরে ইরানের প্রেসিডেন্ট পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ, প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি, সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের সঙ্গে দেখা করেন। সন্ত্রাসবাদকে দুই দেশের মূল সমস্যা হিসাবে ধরে নিয়ে তা প্রতিহত করতে দ্বিপাক্ষিক বোঝাপড়া বৃদ্ধির উপর জোর দেন শাহবাজ় এবং রইসি।
রইসি আগামী তিন-চার বছরে দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ এক হাজার কোটি ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৮৩৩১৪ কোটি টাকা)-এ নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। তবে শাহবাজ় যৌথ ঘোষণাপত্রে কাশ্মীর প্রসঙ্গ রাখতে চাইলেও ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার প্রশ্নে তাতে নাকি সায় দেননি রইসি।
গত জানুয়ারিতেই পাকিস্তানের বালুচিস্তানে জঙ্গি সংগঠন জইশ আল অদলের ঘাঁটিতে মারাত্মক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা চালায় ইরান। ইরানের উপর পাল্টা হামলা চালায় পাকিস্তান। এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, তাদের ‘মার্গ বার সরমাচার’ নামক ওই অভিযানে ‘বেশ কয়েক জন সন্ত্রাসবাদী’র মৃত্যু হয়েছে।
তার পর অবশ্য সুর নরম করে দু’পক্ষই। ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিও গত কয়েক মাসে বদলে যায়। ইরান সরাসরি ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে ফের আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়ার বিরাগভাজন হয়। অন্য দিকে, টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক দুরবস্থায় কোণঠাসা হয় পাকিস্তানও।
পাকিস্তান অবশ্য পশ্চিম এশিয়ার সংঘাত এবং সঙ্কট থেকে দূরত্ব বজায় রাখার ইঙ্গিত দিয়ে জানিয়েছে, রইসির সফরের সঙ্গে ওই সবের কোনও সম্পর্কই নেই। তবে অনেকেই মনে করছেন, এটা ইসলামাবাদের ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’ অবস্থান, যা তারা বার বার করে এসেছে।
অন্য দিকে গুণগত মানের নিরিখে প্রত্যাশা পূরণ না করায় পাকিস্তান থেকে চাল রফতানি বন্ধের হুঁশিয়ারি দিয়েছে বিশ্বের আর এক বৃহৎ শক্তি রাশিয়া। মস্কো নিজেদের সিদ্ধান্তে অবিচল থাকলে অর্থনৈতিক দিক থেকে বড় ধাক্কা খেতে হবে ইসলামাবাদকে। সাম্প্রতিক সময়ে ২০১৯ সালেও এক বার পাকিস্তান থেকে চাল কেনা বন্ধ করেছিল রাশিয়া।
সব মিলিয়ে রইসির সফরে লাভের চেয়ে লোকসানই বেশি হল কি না, এখন তারই হিসাব কষতে বসেছেন পাকিস্তানের শীর্ষকর্তারা।