বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতি রয়েছে আমেরিকায়। তাদের মুদ্রাই বিশ্ব অর্থনীতির চালিকাশক্তি। বিশ্বের নানা প্রান্তে কোথাও কোনও দেশ বিপদে পড়লে আমেরিকা অর্থসাহায্য করে থাকে।
কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির এই ‘বটগাছ’ও বিপন্ন। আমেরিকার আকাশে দেখা দিয়েছে মন্দার কালো মেঘ। দেশের অভ্যন্তরীণ বেশ কিছু সমস্যা আর্থিক বিশেষজ্ঞদের চিন্তায় রেখেছে।
একের পর এক অভ্যন্তরীণ জট মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে আমেরিকায়। সরকার অর্থনীতি সামলাতে কিছুটা হলেও হোঁচট খাচ্ছে। এতে খুব শীঘ্র বিপদের আশঙ্কা না থাকলেও ভবিষ্যতের জন্য সিঁদুরে মেঘ ঘনাচ্ছে।
আপাতত পাঁচটি সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে আমেরিকায়। যা দেশের অর্থনীতিকে ধীরে ধীরে মন্দার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
আমেরিকায় সরকারের অন্যতম মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ধর্মঘট। দেশের গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থাগুলির কর্মীরা ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন। ক্রমে ধর্মঘটের পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমেরিকার অটোমোবাইল ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন ধর্মঘটে নেমেছে। একাধিক নামী গাড়ি সংস্থার কর্মীবৃন্দ সেই ধর্মঘটে যোগ দিচ্ছেন। দাবি মূলত বেতন বৃদ্ধি এবং পরিকাঠামোগত অন্যান্য সুযোগসুবিধা।
আমেরিকার ২১টি প্রদেশে গাড়ি সংস্থার মোট ২৫ হাজার কর্মী ধর্মঘটে যোগ দিয়েছেন। তাঁরা কাজ বন্ধ করায় গাড়ির নির্মাণকার্য ব্যাহত হচ্ছে। আমেরিকার অর্থনীতির একটা বড় ভরসার জায়গা হয়ে উঠছে নড়বড়ে। গত কয়েক দিনের ধর্মঘটে কয়েকশো কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে গাড়ি নির্মাণশিল্পে।
শুধু গাড়ি নয়, সামগ্রিক ভাবে আমেরিকার নির্মাণশিল্পের গতিই সম্প্রতি শ্লথ হয়ে উঠেছে। নির্মাণকারী সংস্থাগুলি গত ১১ মাস ধরে সঙ্কুচিত হয়ে চলেছে। নতুন করে ডালপালা মেলতে পারছে না। উৎপাদন কমে এসেছে।
আমেরিকায় কোভিড অতিমারির সময় থেকে ছাত্রছাত্রীদের টাকা ধার দিয়েছিল সরকার। সরকারি সেই খাত থেকে কঠিন সময়ে প্রয়োজনমতো টাকা নিয়েছিলেন ছাত্রছাত্রীরা। এ বার সেই টাকা ফেরত দেওয়ার সময় এসেছে।
চলতি বছর থেকেই বাধ্যতামূলক ভাবে ঋণ পরিশোধ করবেন আমেরিকার পড়ুয়ারা। গত সাড়ে তিন বছর ধরে যে টাকা তারা সরকারের কাছ থেকে নিয়ে ব্যবহার করেছে, তা ফিরিয়ে দিতে হবে ধীরে ধীরে।
এই ঋণ পরিশোধেও লুকিয়ে আছে অর্থনৈতিক মন্দার বীজ। কারণ, ঋণ শোধ করতে গেলে ছাত্রছাত্রী এবং তাদের পরিবারের উপর অর্থনৈতিক চাপ পড়বে। তাতে আমেরিকার বাজারে লেনদেনে ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
ঋণ শোধ করতে হলে বাড়তি খরচে রাশ টানবেন সাধারণ মানুষ। তারা সঞ্চয়ের চেষ্টা করবেন। এতে দেশের অর্থনীতি মার খাবে। ডলারের লেনদেনে কিছুটা হলেও প্রভাব পড়বে।
তেলের দাম নিয়েও সঙ্কটে আমেরিকা। ২০২২ সালে অপরিশোধিত তেলের দাম বেশ খানিকটা কমেছিল। রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ তার অন্যতম কারণ। যুদ্ধের সময় পশ্চিমি দেশগুলির নিষেধাজ্ঞা প্রযুক্ত হলে রাশিয়া অনেক কম দামে বাজারে তেল ছেড়েছিল।
কিন্তু রাশিয়ার রফতানিকৃত তেলের দামও এখন আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। সামগ্রিক ভাবে তার প্রভাব পড়ছে বিশ্বের তেলের বাজারে। দাম আবার চড়তে শুরু করেছে। চাহিদা অনুযায়ী জোগান হচ্ছে না তেলের।
চলতি বছরের শুরুর দিকে আমেরিকায় প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ৮০ ডলার। বর্তমানে সেই দাম বেড়ে হয়েছে ৯০ ডলার।
আমেরিকার সরকারের খরচও গত কয়েক বছরে চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। দেশের জিডিপির এক চতুর্থাংশ ছুঁয়েছে খরচের পরিমাণ। সরকারের বিনিয়োগে এর প্রভাব পড়তে পারে। যা অর্থনীতিকেও ধাক্কা দেবে।
আমেরিকার বিভিন্ন ব্যাঙ্কগুলিতে সুদের হার ক্রমশ বাড়ছে। অর্থনীতিবিদেরা তাকেও খুব ভাল চোখে দেখছেন না। এতে অদূর ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতির উপর প্রভাব পড়তে পারে।
অর্থনীতিবিদেরা এই ছোট ছোট কারণগুলিকে তুচ্ছ করে দেখার পক্ষপাতী নন। এই মুহূর্তে আমেরিকার অর্থনীতি চাপমুক্ত। কিন্তু আগামী দিনে এই ছোট সমস্যাগুলিই ডেকে আনতে পারে মন্দা।
আমেরিকা বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়ায় সেখানে মন্দা দেখা দিলে তার প্রভাব পড়বে অন্য দেশের উপরেও। সর্বত্র মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতির মতো সমস্যা প্রকট হবে। সার্বিক ভাবে বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার দিকে এগিয়ে যাবে। তাই আমেরিকার অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে চিন্তিত বিশেষজ্ঞেরা।