নামে ধনকুবের। অথচ খাটিয়েও ‘পয়সা’ দেন না ব্রিটেনের সবচেয়ে ধনী ভারতীয় পরিবার হিন্দুজারা। এমনই অভিযোগ উঠেছে তাঁদের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ, হিন্দুজা পরিবারে কর্মরত গৃহপরিচারক বা পরিচারিকাদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়, তা দেখলে মনে হতে পারে তাঁদের একরকম ‘কিনেই নিয়েছেন’ তাঁরা। জেনেভার আদালতে তাই ভারতীয় ধনকুবেরদের বিরুদ্ধে উঠেছে মানব পাচারের অভিযোগ!
এই অভিযোগে হিন্দুজা পরিবারের চার সদস্যকে শুধু আদালতেই আসতে হয়নি, তাঁদের সাড়ে পাঁচ বছরের জেলের সাজা দেওয়ার প্রস্তাবও উঠেছে।
কেন এই শাস্তি দেওয়া উচিত, তার সবিস্তার বর্ণনাও দেওয়া হয়েছে জেনেভার আদালতে। বলা হয়েছে, ভারতীয় ধনকুবেররা তাঁদের গৃহপরিচারকদের প্রাপ্য অর্থ তো দেনই না, উপরন্তু অমানবিক আচরণ করেন তাঁদের সঙ্গে।
জেনেভার আদালতে ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে, হিন্দুজারা তাঁদের আদরের পোষা কুকুরের জন্য যে অর্থ ব্যয় করেন, তাঁদের পরিচারকেরা তার সিকিভাগও পান না।
এই বক্তব্যের সমর্থনে বিস্তারিত হিসাবও পেশ করা হয়েছে আদালতে। হিন্দুজাদের বিপক্ষের আইনজীবী বলেছেন, ব্রিটেনে হিন্দুজাদের প্রাসাদোপম বাড়িতে দৈনন্দিন ঠিকে কাজের জন্য ভারত থেকেই আনা হয় পরিচারক-পরিচারিকাদের।
দৈনিক ১৮ ঘণ্টার কাজ করা পরিচারকদের জন্য দিনপ্রতি বরাদ্দ থাকে ৬.১৯ পাউন্ড। অর্থাৎ, ভারতীয় মুদ্রার হিসাবে ৬৫৭.৬৪ টাকা। গোটা বছরের হিসাব করলে দাঁড়ায় ২২৫৯.৩৫ পাউন্ড বা ভারতীয় মুদ্রায় যা দু’লক্ষ ৪০ হাজার টাকার কিছু বেশি।
অথচ আদরের সারমেয়র জন্য বছরে ৭৬১৬ পাউন্ড ব্যয় করেন হিন্দুজারা। ভারতীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ আট লক্ষ ন’হাজার ১৪৩ টাকা! অর্থাৎ, এক জন পরিচারকের বাৎসরিক বেতনের প্রায় চার গুণ।
অর্থাৎ, এক জন পরিচারকের থেকে প্রায় চার গুণ বেশি খরচ হয় পোষ্যের আদরযত্নে! ব্রিটেনবাসী ধনী পরিবারের এই অমানবিক বৈষম্যের খতিয়ানে বিস্মিত আদালতও।
কারণ হিন্দুজাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা গৃহপরিচারক নিয়োগের পরে তাঁদের থেকে পাসপোর্ট নিয়ে নেন। বাইরের জগতের সঙ্গে কোনও সম্পর্কই রাখতে দেওয়া হয় না তাঁদের।
এমনকি, ব্রিটেনে থাকা সত্ত্বেও তাঁদের বেতন দেওয়া হয় ভারতীয় মুদ্রায়। যাতে কোনও ভাবেই সেই অর্থ বাইরে ব্যবহার করতে না পারেন ওই পরিচারকেরা।
যদিও হিন্দুজারা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁদের পাল্টা দাবি, তাঁদের পরিবারে যাঁরা পরিচারকের কাজ করেন, তাঁদের বেতনের পাশাপাশি আশ্রয় এবং খাবারও দেওয়া হয়।
শুধু তা-ই নয়, হিন্দুজারা আরও বলেছেন, পরিচারকেরা যথাবিধি সম্মান পান তাঁদের পরিবারে। আত্মপক্ষ সমর্থনে কয়েক জন পরিচারিকার বয়ানও পেশ করেছেন হিন্দুজারা।
তবে একই সঙ্গে তাঁরা এ-ও জানিয়েছেন, তাঁদের পরিবারে পরিচারকের নিয়োগের বিষয়টি তাঁরা দেখেন না। হিন্দুজারা জানিয়েছেন, ভারতীয় এজেন্সি মারফত হিন্দুজা ইন্ডাস্ট্রি কর্তৃপক্ষই বিষয়টি দেখাশোনা করেন। সেই যুক্তি যদিও ধোপে টেকেনি।
গত সোমবার থেকে এই মামলা চলছিল জেনেভার আদালতে। হিন্দুজা পরিবারের যে চার সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের জেলের সাজার দাবি উঠেছে।
অভিযুক্ত চার হিন্দুজার নাম—প্রকাশ হিন্দুজা, তাঁর স্ত্রী কমল হিন্দুজা, তাঁদের পুত্র অজয় হিন্দুজা এবং তাঁর স্ত্রী নম্রতা হিন্দুজা। এঁদের মধ্যে প্রকাশ এবং কমল বয়সজনিত কারণে আদালতে হাজিরা দেননি বলে তাঁদের সমালোচিতও হতে হয়।
প্রকাশ এবং কমলের বয়স যথাক্রমে ৭৮ এবং ৭৫ বছর। সেই বয়সের পরোয়া না করেই প্রকাশ এবং কমলকে সাড়ে পাঁচ বছর এবং অজয়-নম্রতার জন্য সাড়ে চার বছরের হাজতবাসের সাজা দেওয়ার প্রস্তাব দেন বিপক্ষের আইনজীবী।
এর পাশাপাশি এই মামলা লড়ার জন্য আদালতের যে ১০ লক্ষ ফ্রাঁ খরচ হয়েছে সেই অর্থও দিতে বলা হয় হিন্দুজাদের। আরও ৩৫ লক্ষ ফ্রাঁ জমা করতে বলা হয়েছে হিন্দুজা পরিবারের পরিচারকদের ক্ষতিপূরণের তহবিলে।
এখন দেখার এই অপরাধের জন্য আদতে কী শাস্তি পায় ধনকুবের পরিবার।