প্রায় চার সপ্তাহ ধরে চলছে রক্তক্ষয়ী হামলা এবং পাল্টা হামলা। তবে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধে বিরতির নামগন্ধ নেই। যুদ্ধ কখন থামবে? বিশ্ব জুড়েই প্রশ্ন আমজনতার। আদৌ কি তেমন সম্ভাবনা রয়েছে? রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কী কী পরিণতি হতে পারে বলে মনে করছেন যুদ্ধবিশারদেরা?
যে কারণগুলির জন্য যুদ্ধ শুরু হয়, তার ফয়সালা হয়ে গেলেই তো সংঘর্ষ থেমে যেতে পারে! তার জন্য যুযুধান দু’পক্ষ আলোচনা টেবলে বসতে পারে। অথবা রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে সমাধানসূত্র খোঁজার পথে এগোতে পারে। তত্ত্বগত ভাবে এমনটা বলা গেলেও বিষয়টি যে আদৌ ততটা সহজ নয়, তার উদাহরণ আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া বা লিবিয়ার মাটিতে সংঘর্ষ।
রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধও কি তেমন পরিণতির দিকে এগোচ্ছে? গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোর থেকে ইউক্রেনের মাটিতে আক্রমণ শুরু করেছে রাশিয়া। পুতিনের দাবি, প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির আমলে ইউক্রেনের মাটিতে ‘গণহত্যা’ রুখতেই এ হামলা। জেলেনস্কি সরকারের এ ‘অপরাধে’ আমেরিকার নেতৃত্বাধীন নেটো বাহিনীর মদত রয়েছে বলেও দাবি পুতিনের।
ইউক্রেন আক্রমণের পিছনে আরও কারণ রয়েছে বলে দাবি করেছে রাশিয়া। যুদ্ধের আগে ইউক্রেনের ডনেৎস্ক এবং লুহানস্ককে স্বাধীন বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন পুতিন। জেলেনস্কির কাছেও একই দাবি তাঁর। এ ছাড়া, ২০১৪ সালের যুদ্ধে ইউক্রেনের হাত থেকে বেদখল হওয়া ক্রাইমিয়াকে তাঁদের দেশের অংশ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হোক বলেও দাবি করেছেন পুতিন। ইউক্রেন যাতে নেটোয় যোগদান না করে, সে দাবিও তুলেছে রাশিয়া।
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের দাবি, নেটোর সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্ক নিয়েও আপত্তি রয়েছে পুতিনের। তাঁর অভিযোগ, আমেরিকা এবং নেটো গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলি রাশিয়াকে ভৌগোলিক ভাবে ঘিরে ফেলার ছক কষছে। মূলত সে কারণেই মৌখিক চুক্তি অগ্রাহ্য করে ইউক্রেনকে নেটোয় অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।
প্রায় এক মাসের সংঘর্ষে দু’পক্ষের কম ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। আমেরিকার একটি দৈনিক সংবাদপত্রের দাবি, ইতিমধ্যেই রাশিয়ার ৭,০০০ সেনা নিহত হয়েছে। আহত ১৪ হাজারেরও বেশি।
রাশিয়ার মতো ইউক্রেনের ক্ষয়ক্ষতিও কম নয়। জেলেনস্কির সেনাবাহিনীর ২,৮৭০ জন নিহত এবং ৩,৭০০ আহত। এ ছাড়া ৫৭২ জনকে বন্দি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ইউক্রেনের ৩০ লক্ষ ঘরহারা বাসিন্দা অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর থেকে তুলনামূলক ভাবে শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ ফায়দা করতে পারেনি রাশিয়া। খারসেন, খারকিভ, মারিয়ুপুল, সামি, চেরনিহিভ-সহ বহু শহর ঘিরে রেখেছে পুতিনবাহিনী। তবে খারসেনের দখল ছাড়া তাদের হাত ফাঁকা।
যুদ্ধের জেরে আর্থিক নিষেধাজ্ঞার কোপে পড়েছে রাশিয়া। সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান পলিসি অ্যানালিসিস (সিইপিএ)-র স্ট্যাটেজিক স্টাডিজ-এর তরফে অবসরপ্রাপ্ত লেফ্টেন্যান্ট জেনারেল বেন হেজেস সংবাদমাধ্যমে বলেন, ‘‘যে ভাবে নিষেধাজ্ঞার বোঝা বাড়ছে, তাতে শীঘ্রই ১৫ হাজার কোটি ডলার বিদেশি মুদ্রা ঋণখেলাপি হতে পারে রাশিয়ার। এ ছাড়া, রাশিয়ার অন্দরে পুতিনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে।’’
যুদ্ধে নেটোর ভূমিকা নিয়েও ক্ষোভ বাড়ছে জেলেনস্কির। এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে অস্ত্রসাহায্য করলেও সরাসরি ময়দানে নামেনি নেটো। অন্য দিকে, ইউক্রেনের আকাশসীমায় উড়ান নিষিদ্ধও করেনি। যা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জেলেনস্কি। যুদ্ধের গোড়ার দিকে উৎসাহী হলেও ইউক্রেন যে আর নেটো গোষ্ঠীর সদস্য হতে চায় না, তা-ও জানিয়েছেন তিনি।
যুদ্ধের চতুর্থ সপ্তাহে কার্যত সুর নরম হয়েছে দু’পক্ষেরই। ইউক্রেনের আশা, আগামী মে মাসের মধ্যে যুদ্ধে শেষ হতে পারে। ইতিমধ্যেই রাশিয়াপন্থী ডনেৎস্ক এবং লুহানস্কের বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতায় যেতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন জেলেনস্কি। অন্য দিকে, রাশিয়াও বুঝতে পারছে যে কিভ দখল করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
তবে কি শীঘ্রই যুদ্ধশেষের শুরু? যুদ্ধবিশারদেরা বেশ কয়েকটি সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করছেন।
এমন হতে পারে যে এককালে সিরিয়া বা চেচনিয়ায় যুদ্ধের নীতিতে ইউক্রেনের মাটিতেও বোমাবর্ষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিল রাশিয়া। যার জেরে কিভের দখল নিজেদের হাতে নিয়ে ইউক্রেনে তাঁদের পছন্দ মতো সরকার গড়লেন পুতিন।
আরও একটি সম্ভাবনার কথা মনে করছেন যুদ্ধবিশারদেরা। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান পুরোপুরি থামিয়ে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপ্রক্রিয়া শুরু করল রাশিয়া।
অন্য দিকে, যুদ্ধ থামাতে বাধ্য হয়েই ডনেৎস্ক এবং লুহানস্কের পাশাপাশি খারসেনকেও স্বাধীন বলে স্কীকৃতি দিল ইউক্রেন।
যুদ্ধের গতি বাড়াতে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করতে পারে রাশিয়া। পশ্চিমী দেশগুলির অস্ত্রঘাঁটিগুলি লক্ষ্য করে ইউক্রেনের পড়শি দেশ পোল্যান্ডেও আঘাত হানতে পারে পুতিনবাহিনী। এর জেরে নেটোকে সরাসরি যুদ্ধে টেনে আনতে পারে রাশিয়া। যাতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের বদলে পশ্চিমী দেশগুলির সরাসরি সংঘাত শুরু হতে পারে।