যুদ্ধক্ষেত্র আর চৌঁষট্টি খোপের বোর্ডের মিল কোথায়? এক, দু’ক্ষেত্রেই রাজাকে নিজের জন্য নিরাপদ দুর্গ বানাতে হয়। দুই, বিপক্ষকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দিতে হয়। তিন, রণকৌশল ঠিক করে ভাঙতে হয় শত্রুপক্ষের প্রতিরোধ। চালে ভুল হলে বা কৌশলে পেরে উঠতে না পারলেই কিস্তিমাত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যখন দু’দেশের ‘রাজা’ ভ্লাদিমির পুতিন এবং ভোলোদেমির জেলেনস্কির মধ্যে প্রবল স্নায়ুযুদ্ধ চলছে, তখন যুদ্ধ নিয়ে মুখ খুললেন প্রাক্ত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন— সুপার গ্র্যান্ডমাস্টার গ্যারি কাসপারভ।
দাবার দুনিয়ায় আজও সম্মানিত কাসপারভ। আটবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। তবে অবসর নেওয়ার পর এই কাসপারভ চলে আসেন সক্রিয় রাজনীতিতে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে পুতিনের বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়িয়েওছিলেন।
বরাবরই পুতিন-বিরোধী বলে পরিচিত কাসপারভ। তাঁকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা বলেন পুতিনের নিন্দা না করে না কি এক গ্লাস জলও খান না সুপার গ্র্যান্ডমাস্টার! সেই কাসপারভ যে পুতিনের যুদ্ধের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করবেন, তা জানা ছিল। যদিও কাসপারভএ বার একটু অন্য কথা বললেন।
পুতিনের সমালোচনা করেও কাসপারভ জানিয়েছেন, ইউক্রেনের এই দুর্দশার জন্য দায়ী গোটা বিশ্ব। বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকার মতো পশ্চিমের শক্তিশালী দেশগুলি। যারা পুতিনের সাহস নিরন্তর বাড়িয়েই গিয়েছে।
কাসপারভের বক্তব্য, এখন জার্মানি-সহ ইউরোপের একাধিক দেশ ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে, কিন্তু গত এক বছর ধরে যখন পুতিন এদের চোখের সামনে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছেন, তখন একটি শব্দও পুতিনের বিরুদ্ধে উচ্চারণ করেননি এই সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধান।
এই উদাসীনতা কেন? তার কারণও ব্যখ্যা করেছেন ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’। তাঁর যুক্তি, ‘‘আসলে জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্সের মতো দেশগুলির ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িয়ে আছে রাশিয়ার সঙ্গে। তাই পুতিন যখন সবার সামনে ইউক্রেনের দুর্গের চারপাশে একে একে ঘুঁটি সাজিয়েছেন, তখন তা দেখেও মুখে রা কাড়েনি বাকি সব দেশ।
প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল নৌবহর প্রকাশ্যেই কৃষ্ণ সাগরে নিয়ে এসেছিলেন পুতিন। এই কৃষ্ণ সাগরের লাগোয়া ইউক্রেনের একটি বড় অংশ। আজ যে ইউক্রেনকে চার পাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে রাশিয়া, তার কারণ এই দেশগুলির সব দেখেও চুপ করে থাকার সিদ্ধান্ত।
যুদ্ধ শুরুর সপ্তাহ খানেক আগে রাশিয়া জানিয়েছিল, তারা ইউক্রেনের সীমানা থেকে সেনা সরিয়ে নিচ্ছে। কাসপারভের বক্তব্য, ‘‘পুতিন তো বরাবরই মিথ্যেবাদী। নিজের স্বার্থে মিথ্যে কথা বলা ওঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সে কথা বিশ্বনেতারা জানতেন না, তা তো নয়! তারপরও আমেরিকা মুখ খুলল যুদ্ধের দিন কয়েক আগে। তখন তারা বলছে, রাশিয়া সেনা সরানোর নামে ধোঁকা দিয়েছে ইউক্রেনকে।’’
কাসপারভের প্রশ্ন রাশিয়া যখন ইউক্রেনের প্রান্তে নৌবহর সাজাচ্ছে আমেরিকা তখন চুপ করে ছিল কেন? ইউরোপ কেন কিছু বলেনি? নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবেই কি চুুপ করেছিল তারা?
কাসপারভের মতে, পুতিন যাতে নিজেকে অপ্রতিরোধ্য ভাবেন, তার ব্যবস্থা করে দিয়েছে এই দেশগুলিই। পুতিনকে কিছুটা ইচ্ছে করেই মাত্রাছাড়া আত্মবিশ্বাস জুগিয়ে গিয়েছে তারা। কিন্তু সেই আত্মবিশ্বাস এ বার টোল খেয়েছে।
কাসপারভ জানিয়েছেন, পুতিন ভেবেছিলেন কিভের দখল পেতে তাঁর দু’দিন কিংবা তিন দিন লাগবে। তিনি ভাবতে পারেননি ইউক্রেনও প্রতিরোধ তৈরি করতে পারে।
কাসপারভের ব্যাখ্যা, পুতিন ভাবতে পারেননি, ‘রাজা’ জেলেনস্কিকে চারপাশে ঘিরে কিভে এমন দুর্ভেদ্য দুর্গ তৈরি করতে পারে ইউক্রেনের সেনা। ভয় পেয়ে অস্ত্র সংবরণের বদলে সিদ্ধান্ত নিতে পারে যুদ্ধ করার।
কাসপারভের ধারণা, পুতিন যদি ইউক্রেনে সফল হন তবে তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে আগামী দিনে চিনও একই ভাবে হামলা চালাতে পারে তাইওয়ানে। বরাবরই রাশিয়ার ভাল বন্ধু চিন। চিনের কথা ভেবেই না কি ইউক্রেনে হামলার আগে শীতের ওলিম্পিক শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল রাশিয়া।
কাসপারভ একটি সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি দাবি করেছেন, রাশিয়া -ইউক্রেনের এই যুদ্ধে আপতভাবে রাশিয়াকে খলনায়ক মনে হলেও আসলে পশ্চিমি দেশগুলিও এর জন্য সমান দায়ী। এই যুদ্ধ তাদেরই তৈরি করা।
তবে এই যুদ্ধে আর কিছু না পারলেও একটা কাজ করতে পেরেছে বলে মনে করেন গ্যারি। তাঁর মতে, পুতিন যে একেবারে অপ্রতিরোধ্য নয়, তা বুঝিয়ে দিয়েছে ইউক্রেন। পুতিনের মিথ্যে ‘শক্তিশালী ভবমূর্তি’কেও কিছুটা নষ্ট করা গিয়েছে। গ্যারির কথায়, এটাই যা প্রাপ্তি।