কোনও দিন আধপেটা খেয়ে শুয়ে পড়েছেন। কোনও দিন দানাপানিটুকুও জোটেনি। মহারাষ্ট্রের গডচিরৌলির একটি অখ্যাত গ্রামের সেই আদিবাসী বালক বড় হয়ে হলেন বিজ্ঞানী। কাজ করছেন আমেরিকায়। ভাস্কর হলামি। শুধু ইচ্ছাশক্তি আর স্বপ্ন দেখার সাহস থাকলে সাফল্য যে ধরা দেবেই তার উদাহরণ মহারাষ্ট্রের এই আদিবাসী যুবক।
ভাস্করের বড় হয়ে ওঠা গডচিরৌলির কুরখেড়া তহসিলে। দারিদ্রক্লিষ্ট পরিবার থেকে উঠে আসা ভাস্কর এখন আমেরিকার মেরিল্যান্ডে একটি বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির বিজ্ঞানী। এই কোম্পানিটি কাজ করছে জেনেটিক মেডিসিন নিয়ে। আর ভাস্কর কাজ করছেন ‘আরএনএ ম্যানুফ্যাকচরিং’ এবং সিন্থেসিস নিয়ে। গডচিরৌলির ছোট্ট গ্রাম থেকে আমেরিকা— কেমন ছিল ভাস্কর হালামির স্বপ্নের উড়ান?
এখন ভাস্করের বয়স ৪৪ বছর। কাজের সূত্রে আমেরিকায় থাকলেও এখনও তাঁর মন পড়ে আছে মহারাষ্ট্রের ছোট্ট গ্রামে।
বিজ্ঞানীর কথায়, ‘‘এমনও দিন গিয়েছে যে একটা থালা থেকে পুরো পরিবার দুপুরের খাবার খেয়েছি। কোনও কোনও দিন কিচ্ছু না খেয়ে ঘুমোতে যেতে হয়েছে। কী ভাবে যে আমি এবং আমার বাড়ির লোকেরা বেঁচে ছিলাম, এটা ভেবে এখন অবাক হই।’’ কিন্তু ছোট্ট ভাস্কর স্বপ্ন দেখতেন দিন বদলাবেই। তিনিই সংসারে সুসময় আনবেন।
ছোট থেকে পড়াশোনায় দারুণ আগ্রহ ভাস্করের। চরম দারিদ্রের মধ্যেও পড়াশোনা ছাড়ার কথা ভাবতেই পারেননি তিনি। খিদে পেটে বই খুলে বসতেন। গোগ্রাসে গিলতেন জটিল অঙ্কের সূত্র, বিজ্ঞান।
প্রাকৃতিক কারণে ভাস্করের গ্রামে চাষবাস ঠিকঠাক হত না। যে বার বর্ষার মরসুমে তেমন বৃষ্টি হত না, প্রবল সমস্যায় পড়ত ভাস্করের পরিবার। তখন খাবার বলতে মহুয়া ফুল!
ভাস্করের কথায়, ‘‘অধিকাংশ দিন মহুয়া ফুল রান্না করে খেতে হত সবাইকে। কিন্তু সেই খাবার খাওয়া সহজ নয়, হজম করাও কঠিন ব্যাপার। তা-ও ওই সব খেয়ে কোনও রকম জীবন টিকিয়ে রাখতাম আমরা।’’
গ্রামের স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন ভাস্কর। বৃত্তি নিয়ে পাশ করে ভর্তি হন একটি সরকারি স্কুলে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত ওই স্কুলে পড়েছেন। তার পর একে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়েছেন। সঙ্গী সেই দারিদ্র। ভাস্করের এলাকায় তিনিই প্রথম বিজ্ঞানে স্নাতক। তিনিই একমাত্র লোক যাঁর পিএইচডি ডিগ্রি আছে।
এত বাধার মধ্যেও এত দূর পড়াশোনা করলেন কেমন করে? ভাস্করের উত্তর, ‘‘আমার বাবা-মা স্বল্পশিক্ষিত। কিন্তু নিজেদের সবটুকু দিয়ে আমাদের ভাইবোনদের পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।’’
গডচিরৌলির একটি কলেজ থেকে বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক পাশ করেন ভাস্কর। নাগপুরের ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে এমএসসি পাশ করেন।
২০০৩ সালে নাগপুরের লক্ষ্মীনারায়ণ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। পরে মহারাষ্ট্র পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় পাশ করে গবেষণার কাজে মন দেন ভাস্কর।
মিশিগান টেকনোলজিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি লাভ করেন মহারাষ্ট্রের অখ্যাত গ্রামের প্রায় দিন অভুক্ত থেকে পড়াশোনা করা মানুষটি।
এখন ডিএনএ এবং আরএনএ গবেষণায় বিশ্বের বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম নাম ভাস্কর হলামি। কিন্তু এখনও নিজের শিকড় ভোলেননি তিনি।