মৃত্যুর ও পারের জগৎটা কেমন— এই প্রশ্ন অতি প্রাচীন কাল থেকে মানুষকে ভাবিয়েছে। এই ভাবনা থেকেই জন্ম নিয়েছে পরলোকের ধারণা। প্রিয়জন বিয়োগের পরে মানুষ ভাবতে চেয়েছে, তারা কোথাও না কোথাও রয়েছেই। ইহজগৎ থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে গিয়েছে ক্রমাগত। জন্ম হয়েছে প্ল্যানচেট বা ওই ধরনের ক্রিয়ার। কিন্তু সে সবের নেপথ্যে কোনও বৈজ্ঞানিক সত্য আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। কার্য-কারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা যায়নি পরলোকের অস্তিত্বকে। কিন্তু মজার ব্যাপার, দিকপাল এক বিজ্ঞানী তথা আবিষ্কারকই এক সময়ে চেয়েছিলেন পরলোকের সঙ্গে ইহলোকের সংযোগ স্থাপনের যন্ত্র আবিষ্কার করতে। কথাটা কল্পবিজ্ঞান-ফ্যান্টাসির মতো শোনালেও এমনটা কিন্তু সত্যিই ঘটেছিল।
সত্যজিৎ রায়ের কলমে প্রোফেসর শঙ্কু আবিষ্কার করেছিলেন ‘নিও-স্পেকট্রোস্কোপ’ নামের এক যন্ত্র, যা দিয়ে বিদেহী আত্মা বা সোজা বাংলায় ‘ভূত’ দেখা সম্ভব হত। কৌতূহল জাগে, শঙ্কুর এই আবিষ্কারের নেপথ্যে কি কাজ করেছিল আমেরিকান আবিষ্কারক টমাস আলভা এডিসনের ‘স্পিরিট ফোন’-এর ভাবনা? এডিসন এমন এক যন্ত্র তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যার দ্বারা পরলোকগত ‘আত্মা’র সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হবে।
১৯২০ সালে ‘দি আমেরিকান ম্যাগাজিন’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এডিসন জানান, তিনি মৃত ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগের যন্ত্র আবিষ্কারের সম্ভাবনাকে নিয়ে ভাবছেন। কিন্তু সেই সাক্ষাৎকারে এডিসন তাঁর প্রকল্পটি সম্পর্কে খোলসা করে কিছুই বলেননি। ফলে তাঁর সেই আবিষ্কার নিয়ে ধোঁয়াশাই থেকে যায়।
এডিসন তাঁর ডায়েরিতে নাকি এই ফোন সম্পর্কে বিশদ লিখে গিয়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর পর তাঁর ডায়েরি প্রকাশিত হলে দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট অংশটি সেখানে নেই। ফলে বিষয়টিকে সকলেই অলীক কল্পনা বলে উড়িয়ে দেন।
অনেকে মনে করেন, অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে সত্যিই নাকি আগ্রহী ছিলেন এডিসন। এবং তা নিয়ে তাঁর ডায়েরিতে বিশদ উল্লেখও ছিল। ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত ‘ডায়েরি অ্যান্ড সান্ড্রি অবজাভেশনস’-এ সেই সব অংশ বাদ দিয়ে দেওয়া হয়।
১৯৪৯ সালে ফ্রান্সে এডিসনের ডায়েরির ফরাসি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এবং সেখানে নাকি স্পিরিট ফোন-সহ তাঁর অতিপ্রাকৃত ভাবনার সম্পূর্ণটাই ছাপা হয়।
২০১৫ সাল পর্যন্ত এডিসনের ডায়েরির ফরাসি সংস্করণের কথা জানা ছিল না। ফিলিপ বাউদুইন নামের এক রেডিয়ো উপস্থাপক এক পুরনো জিনিসের দোকানে সেই বই খুঁজে পান। সেখান থেকেই তিনি এডিসনের জীবনের এই ‘বিস্মৃত’ অধ্যায়ের সন্ধান পান বলে জানান।
জানা যায়, কুড়ির দশকের শেষ দিকে এক গোপন গবেষণাগারে এডিসন নাকি মৃত ব্যক্তিদের কণ্ঠস্বর রেকর্ডিংয়ের কাজ করছিলেন। আমেরিকার ‘মডার্ন মেকানিক্স ম্যাগাজিন’-এর অক্টোবর, ১৯৩৩ সংখ্যায় এ বিষয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
‘মডার্ন মেকানিক্স ম্যাগাজিন’ দাবি করে, এডিসন নাকি পরলোকের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য এক যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। সেই যন্ত্রটির মধ্যে থেকে নাকি এক সূক্ষ্ম আলোকরেখা বেরিয়ে এসে পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণিকাকেও চিহ্নিত করতে পারত। এই ক্ষুদ্রতম কণাগুলির মধ্যে থেকেই নাকি পরলোকের প্রমাণ করা সম্ভব। পরিবেশে থেকে যাওয়া প্রয়াত মানুষের অস্তিত্ব-কণিকাও নাকি এই যন্ত্রে ধরা পড়ে।
‘মডার্ন মেকানিক্স ম্যাগাজিন’-এর সেই প্রতিবেদনকে অনেকেই গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দেন। জানা যায় না, এমন যন্ত্রের প্রদর্শন এডিসন সত্যিই করেছিলেন কি না। কিন্তু তিনি যে অতিপ্রাকৃত জগৎকে বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে বুঝতে চাইতেন, তা তিনি বহু বার বলেছিলেন।
ফিলিপ বাউদুইন জানান, যন্ত্রটি তৈরির ব্যাপারে এডিসন অনেকটাই এগিয়েছিলেন। তিনি এটির তাত্ত্বিক ভিত্তি এবং নির্মাণ-পরিকল্পনা লিখেও রেখেছিলেন। কিন্তু তিনি সত্যিই যন্ত্রটি তৈরি করে উঠতে পেরেছিলেন কি না, তা জানা যায় না। বাউদুইন জানিয়েছিলেন, এডিসন যন্ত্রটির কোনও নাম রাখেননি। তিনি এটিকে ‘ভাল্ভ’ বলে উল্লেখ করে গিয়েছেন তাঁর ডায়েরিতে।
পরবর্তী কালে অনেক পত্রিকাতেই এডিসনের ‘স্পিরিট ফোন’-এর ছবি ছাপা হয়। বলাই বাহুল্য, এই সব ছবি ছিল একান্তই কাল্পনিক।
এডিসনের সঙ্গে এই আবিষ্কারের ব্যাপারে আর এক জনের নাম উঠে আসে। তিনি খ্যাতনামা আবিষ্কারক নিকোলা টেসলা। টেসলা একসময়ে এডিসনের সহকারী ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের মধ্যে মতান্তর ঘটে। এবং তাঁরা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ান।
জানা যায়, এডিসন যখন ‘স্পিরিট ফোন’ নিয়ে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময়েই টেসলাও নাকি পরলোকের সঙ্গে যোগাযোগের যন্ত্র আবিষ্কারের চেষ্টা করছিলেন। বিংশ শতকের গোড়ায় বৈদ্যুতিক আলো এবং চলচ্চিত্র আবিষ্কৃত হলে টেসলা ভাবতে শুরু করেন, প্রযুক্তির সহায়তায় মৃতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন সম্ভব।
১৯০১ সালে একটি ক্রিস্টাল রেডিয়ো নিয়ে কাজ করার সময় এক রাতে টেসলা কিছু সিগন্যাল শুনতে পান। তাঁর দিনলিপিতে তিনি লেখেন, “প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এই সঙ্কেতগুলোর মধ্যে রহস্যময় কিছু রয়েছে। সে সব অতিপ্রাকৃতও হতে পারে।”
১৯১৮ সালে টেসলা ডায়েরিতে আবার লেখেন, তিনি রেডিয়োতে আবার কিছু রহস্যময় শব্দ শুনতে পেয়েছেন। তাঁর মতে, এই সব শব্দ ইহজাগতিক নয়। তিনি নাকি মানুষের কণ্ঠস্বরেই সম্পূর্ণ অচেনা ভাষায় এমন কিছু শুনতে পান, যা তাঁর অন্য কোনও জগতের বলে মনে হয়।
পরবর্তী কালে বিশেষজ্ঞরা জানান, টেসলা যে রেডিয়োযন্ত্র ব্যবহার করেছিলেন, তা খুব কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের শব্দকেও গ্রহণ করতে পারত। ফলে বহু রকমের স্বাভাবিক শব্দও তাঁর কাছে অচেনা বলে মনে হয়েছিল।
এডিসনের স্পিরিট ফোন বা টেসলার ভৌতিক রেডিয়ো— কোনও কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি বলে পরবর্তী কালের বিজ্ঞানীদের ধারণা।
এডিসন এবং টেসলা যে সময়ে ‘বৈজ্ঞানিক’ উপায়ে পরলোকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন, তা পাশ্চাত্যের এক বিশেষ সন্ধিসময়। ভিক্টোরিয়ান যুগের শেষ দিকে এবং আর্লি এডওয়ার্ডিয়ান যুগের প্রথম দিকের হিসেবে পরিচিত সেই সময়কাল ছিল ইউরোপ এবং আমেরিকায় অতিপ্রাকৃত সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। পশ্চিমের প্রায় সর্বত্র এই সব সাহিত্য রচনার সমান্তরালে চলত প্ল্যানচেট, ক্লেয়ারভয়েন্স বা সাইকিক কর্মকাণ্ড। এডিসন বা টেসলা যুগধর্মের প্রভাবেই সম্ভবত অতিপ্রাকৃত নিয়ে মাথা ঘামিয়েছিলেন। ‘ভৌতিক ফোন’ বা রেডিয়োর পরিকল্পনা সেই ভাবনারই বহিঃপ্রকাশ।