সময় নিরন্তর বহমান৷ জীবনের পথে কিছু মুহূর্তকে শাশ্বত করে রাখতেই যাবতীয় লিপি পুঁথি চিঠি ইত্যাদির আগমন৷
প্রাচীনকালে রাজা মহারাজারা লিপিতে লিখে রাখতেন তঁদের অমর কীর্তি অথবা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য৷ ইতিহাসের পাতায় এমন বহু লিপি স্মৃতিসৌধ রয়েছে যার পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি আজও৷
এই সময় কোডিং অত্যন্ত জনপ্রিয়৷ কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, প্রাচীনকালেও ছিল কোডিং এর ব্যবহার৷
গোপন কথা লিখে রাখা হত বিভ্রান্তিকর চিত্র সঙ্কেতের মাধ্যমে৷ সবচেয়ে বিখ্যাত এবং এখনও অমীমাংসিত কোডগুলির মধ্যে অন্যতম শাগবরো কোড।
শাগবরো কোড উন্নতমানের মাইলফলক বা উচ্চ প্রযুক্তিতে লেখা নয়। এটি ইংল্যান্ডের একটি প্রাসাদের বাগানে খোদাই করা হয়েছে।
বিস্ময়কর এই স্মৃতিসৌধটি ইংল্যান্ডের স্টাফোর্ডশায়ারের শাগবরো এস্টেটের বাগানে অবস্থিত। ফরাসি বারোক চিত্রকর নিকোলাস পুসাঁ (১৫৯৪-১৬৬৫)-র আঁকা ‘আর্কেডিয়ান শেফার্ডস’ নামক ছবি থেকে গৃহীত দেওয়াল ভাস্কর্যের নীচে খোদাই করা কয়েকটি এলোমেলো অক্ষর।
অজানা কোন শিল্পী এই আটটি রহস্যময় অক্ষর খোদাই করেছেন। অক্ষরগুলি হল — OUOSVAVV— অন্য দু’টি অক্ষর, D এবং M এর মধ্যে এই অক্ষরগুলি লেখা।
আনুমানিক ২০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন আপাতদৃষ্টিতে এই এলোমেলো অক্ষরমালা। কিন্তু এই লিপিই বছরের পর বছর বিশ্বজুড়ে ভাষাবিদ, ইতিহাসবিদ সকলের কাছেই অপার বিস্ময়!
শাগবরো লিপি কি অষ্টাদশ শতকের পবিত্র গ্রেলের কোন গোপন সূত্র, নাকি নিছক প্রয়ানলেখ? এই প্রশ্ন ভাবিয়েছে চার্লস্ ডিকেন্স, ডারউইন এর মতো প্রতিভাবান ব্যক্তিত্বদের৷
ঊনবিংশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা এই অমীমাংসিত লিপির রহস্য উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মাঝপথেই তা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
যদিও, ভাষাতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ এবং ল্যাটিন ও আরবি শিক্ষক কিথ ম্যাসি বিশ্বাস করেন যে তিনি এই অমীমাংসিত ধাঁধার একটি যথাযথ উত্তর খুঁজে পেয়েছেন।
আমেরিকার জাতীয় সুরক্ষা সংস্থা কিথ ম্যাসিকে এই রহস্যময় লিপির পাঠোদ্ধারের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন৷ ম্যাসি তাঁর ল্যাটিন ভাষাজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত এই লিপির পাঠোদ্ধার করতে চেষ্টা করেন৷
ম্যাসি মনে করেন, আপাতদৃষ্টিতে অস্পষ্ট কিছু অক্ষর ‘O-U-O-S-V-A-V-V’- এর অর্থ হতে পারে ‘Oro Ut Omnes Sequantur Viam Ad Veram Vitam,’ যা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, ‘আমি প্রার্থনা করি, যেন সকলে জীবনে সত্যের পথ অনুসরণ করতে পারে।’
ম্যাসি তাঁর পাঠোদ্ধার সম্পর্কে আশাবাদী৷ ম্যাসির মতে, এই সমাধান সহজবোধ্য এবং ব্যাকরণগত ভাবে অর্থপূর্ণ বাক্যকে নির্দেশ করে৷ যার সমস্ত অংশ শাগবরো লিপি তৈরির পূর্ববর্তী বা সমসাময়িক।
ম্যাসি সোজাসাপটা ভাবে ভাবার এবং বিশাল গভীর তাৎপর্য না খোঁজার পরামর্শ দিয়েছিলেন৷ ম্যাসি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করেন, লিপির ঠিক নীচে ডি এবং এম অক্ষরগুলি প্রধান সূত্র।
ম্যাসি মনে করেন শাগবরো কোডের অর্থ বোঝার ক্ষেত্রে ডি এবং এম অক্ষরদুটি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মনে করেন যে সংক্ষিপ্ত অক্ষরগুলি ‘ডিস ম্যানিবুস’ যার অর্থ ‘মানেসের জন্য’ (পাতালের পৌরাণিক আত্মা), যা বহু প্রাচীন খ্রিস্টান সমাধিতে খোদাই করা রয়েছে৷
মানেস এবং খ্রিস্টান সমাধির মধ্যে সংযোগ সম্পর্কে বিশদ ভাবে বর্ণনা করে ম্যাসি বলেছেন লিপিটি লাতিন ভাষায় রচিত একটি সমাধি স্মারক। উপরন্তু, বাইবেলের একটি অনুচ্ছেদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে বলেই ম্যাসির অভিমত৷
বাইবেলের (জন ১৪:৬, ‘‘এগো সাম ভিয়া এত ভেরিতাস এত ভিতা’’), যার অর্থ আমিই পথ, আমিই সত্য এবং আমিই জীবন৷ এই ধাঁধার টুকরোগুলোর সঙ্গে এই বক্তব্য পুরোপুরি মিলে যায় বলেই মনে করেন ম্যাসি৷
রহস্যময় এই অক্ষরগুলি সম্পর্কে বহু গবেষক, বিজ্ঞানী এবং ঐতিহাসিক নিজ নিজ ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং সকলেই ভিন্ন ভিন্ন অর্থ উদ্ধার করেছেন৷
এমনই একজন বিশেষজ্ঞ হলেন স্মৃতিসৌধ এবং সমাধি বিশেষজ্ঞ এ জে মর্টন৷ তাঁর মতে এই রহস্য অর্থহীন, এলোমেলো কিছু অক্ষর সমষ্টি যা বাড়ির বাসিন্দা জর্জ অ্যাডামস এবং মেরি ভার্নন-ভেনাবলস (ছবিতে) নিজেরাই তৈরি করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা এটি তৈরি করেছিলনে কেন তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গিয়েছে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, শাগবরো লিপিগুলিকে ব্যাখ্যা করার জন্য অনেকগুলি অনুমান তৈরি করা হয়েছে। মোটামুটিভাবে তিনটি তত্ত্ব উঠে এসেছে।
তিনটি তত্ত্ব হল —প্রথমত, অ্যাক্রোস্টিক অর্থাৎ সাঙ্কেতিক কাব্যময়, যার একটি অক্ষর একটি শব্দের প্রতীক মাত্র৷ দ্বিতীয়ত, নন অ্যাক্রোস্টিক অর্থাৎ কোনও সঙ্কেত নেই৷ লিপিগুলি একটি প্রাচীন প্রেমের চিঠি যা পবিত্র গ্রেল (যিশুখ্রিস্ট তাঁর শেষ নৈশভোজে যে পানপাত্র ব্যবহার করেছিলেন এবং যে পানপাত্রে ক্রুশবিদ্ধ অবস্থায় যিশুর দেহ থেকে ক্ষরিত রক্ত ধরে রাখা হয়, সেই পানপাত্রই ‘হোলি গ্রেল’ নামে পরিচিত। বাইবেলে অবশ্য এর কোনও উল্লেখ নেই। জনশ্রুতি অনুযায়ী, এই পানপাত্র মানুষকে অমরত্বের সন্ধান দিতে পারে।)-কে মহিমান্বিত করে। তৃতীয়ত, জর্জ আনসন তার মৃত স্ত্রীর জন্য শোকজ্ঞাপন করতে খোদাই করিয়েছিলেন এই লিপি৷
শাগবরোর মুখপাত্র জানান, প্রতি সপ্তাহে পাঁচ থেকে ছয়জন ব্যক্তি দাবি করেন দীর্ঘ দিনের বিস্ময়কর এই লিপির পাঠোদ্ধার করে ফেলেছেন৷ কিন্তু আজ পর্যন্ত সঠিক প্রমাণ কেউ দিতে পারেননি৷
এই রহস্যময় লেখার সমাধান কখনও হবে কি না কেউ জানে না৷ জাতীয় ট্রাস্ট এর কর্মীদের মতে, রহস্যময় ধাঁধাটির পাঠোদ্ধার কার্যত অসম্ভব এবং তার চেষ্টা করা কেবল নতুন নতুন ভাবে বিভ্রান্ত হওয়া৷ আজও বহু পর্যটক প্রাচীন এই বিস্ময়কে দেখতে ভিড় করেন এই লিপির চারপাশে৷