এক ছাপোষা দর্জি। স্বভাব বেশ নম্র। ভাল লোক হিসাবেই তাঁকে জানতেন পাড়া-পড়শিরা। কিন্তু দিনের শেষে আঁধার নামলেই সেই ‘ভদ্রলোকের’ ভোল পাল্টে যেত। যে হাত দিয়ে সেলাই মেশিন চালিয়ে পোশাক তৈরি করতেন, সেই হাত দিয়েই ঝরাতেন রক্ত। দিনে দর্জি আর রাতে হয়ে যেতেন খুনি।
তাঁর নাম আদেশ খামরা। পাড়ার সবচেয়ে শান্তশিষ্ট ভদ্রলোক যে খুনি হতে পারেন, তা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি আদেশের পড়শিরা। কিন্তু দিনের বেলার সেই সাধারণ দর্জিই ৩৩টি খুন করেছিলেন।
২০১৮ সাল। সে বছরই পুলিশের জালে ধরা পড়েছিলেন আদেশ। তার পর যত তদন্ত এগিয়েছে, উঠে এসেছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। রাত হলেই দর্জি আদেশ হয়ে যেতেন খুনি। তাঁর নিশানায় থাকতেন লরি চালকরা।
এ দেশে অনেক ‘সিরিয়াল কিলার’-এর কীর্তিই প্রকাশ্যে এসেছে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম আদেশ। ২০১০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত একের পর এক খুন করে পুলিশের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন তিনি। আদেশের হত্যালীলা মনে করিয়েছে সিরিয়াল কিলার রামন রাঘবের কথা। যিনি ৪২টি খুন করেছিলেন। মনে করিয়েছে কলকাতার স্টোনম্যান আতঙ্কের কথা।
মধ্যপ্রদেশের রাইসেন জেলার মান্ডিদীপ এলাকার বাসিন্দা আদশ। দর্জি হিসাবে কাজ করতেন। ভদ্র স্বভাবের জন্য তাঁর সঙ্গে এলাকার অনেকের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় ছিল। আদেশের গ্রেফতারের পর তাই স্বাভাবিক ভাবেই চমকে গিয়েছেন তাঁর পড়শিরা।
‘সিরিয়াল কিলার’ আদেশের নিশানায় থাকছেন ট্রাক চালকরা। যে ৩৩ জনকে খুন করেছেন আদেশ, তাঁরা সকলেই ট্রাক চালক। কিন্তু কেন ট্রাক চালকদের খুন করতেন আদেশ? কী ছিল তাঁর উদ্দেশ্য?
২০১০ সাল। সে বছরই অমরাবতীতে প্রথম এক ট্রাক চালককে খুন করেছিলেন আদেশ। এর পর যত দিন গড়িয়েছে, আদেশের হাতে ট্রাক চালকদের খুনের সংখ্যা ততই বেড়েছে। মধ্যপ্রদেশ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা, ছত্তীসগঢ়ে ট্রাক চালকদের হত্যা করতেন আদেশ।
আদেশের খুন করার ধরন দেখে বিস্মিত হয়েছেন তদন্তকারীরা। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছিল, মিশুকে স্বভাবের আদেশ। তাই অপরিচিত ট্রাক চালকদের সঙ্গে সহজেই মিশে যেতেন। অল্প আলাপেই ট্রাক চালকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলতেন।
এর পর গল্পের ছলে ট্রাক চালকদের সঙ্গে ভাব জমাতেন। তার পর তাঁদের সঙ্গে মদ্যপান করতেন। ওই পানীয়তেই মাদক মিশিয়ে দিতেন আদেশ। যা পান করে নেশাচ্ছন্ন হয়ে পড়তেন ট্রাক চালকরা। তার পরই তাঁদের শ্বাসরোধ করে খুন করতেন আদেশ।
তদন্তকারীরা এও জানিয়েছিলেন যে, মদ্যপানের বদলে অনেক সময়ই মাদক মেশানো মিষ্টি বা অন্য কোনও খাবার খাওয়াতেন ট্রাক চালকদের। তার পর সেই মাদক মেশানো খাবার খেয়ে ট্রাক চালকরা বেহুঁশ হলেই তাঁদের খতম করতেন আদেশ। খুনের পর তাঁদের দেহ লোপাট করা হত।
ট্রাক চালকদের সঙ্গে আদেশের ভাব জমানোর কায়দাও ছিল বেশ চমকপ্রদ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মোবাইল চার্জার চেয়ে ট্রাক চালকদের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করতেন আদেশ। সেই কথোপকথনের মাধ্যমেই তাঁদের আস্থা অর্জন করতেন তিনি।
তবে সবটা যে আদেশ একা হাতে সামলাতেন, তা নয়। রাতের হাইওয়েতে ট্রাক চালকদের খুন করতে আদেশের একটা ‘গ্যাং’ ছিল। অনেকেই আদেশের সঙ্গে মিলে এই কাজ করতেন। আবার আদেশের দলের সদস্যরা পরে আলাদা ‘গ্যাং’ তৈরি করতেন।
কিন্তু কেন ট্রাক চালকদের খুন করতেন আদেশ? তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পেরেছিল যে, ট্রাক লুট করাই ছিল আসল উদ্দেশ্য। চালক বা খালাসিদের খুনের পর সেই ট্রাকের ভোল পাল্টে বিক্রি করতেন আদেশ।
২ থেকে ৩ লক্ষ টাকায় ওই ট্রাকগুলি বিক্রি করতেন আদেশ। বিক্রির সময় ওই ট্রাকগুলির পুরো ভোল পাল্টে দিতেন তিনি। এমনকি, ট্রাকের যন্ত্রাংশও বদলে ফেলতেন।
একের পর এক ট্রাক চালকের খুনের ঘটনায় শোরগোল পড়ে গিয়েছিল সেই সময়। ধরপাকড় শুরু করেছিল পুলিশ। গ্রেফতার করা হয়েছিল জয়করণ নামে এক যুবককে।
জয়করণকে গ্রেফতারের পরই আদেশকে বাগে পায় পুলিশ। তবে আদেশকে পাকড়াও করতে গিয়ে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল খাকি উর্দিধারীদের। এমনকি, আদেশকে গ্রেফতারের পর পুলিশ আধিকারিকরা ভাবতেই পারেননি, তাঁদের জালে ধরা পড়েছে এক ভয়ঙ্কর খুনি।
উত্তরপ্রদেশের সুলতানপুরের জঙ্গলে টানা ৩ দিন ধরে অভিযান চালিয়েছিল পুলিশ। রাতের বেলায় জঙ্গলের মধ্যে আদেশকে ধরেছিলেন ভোপালের তদানীন্তন মহিলা পুলিশ সুপার বিট্টু শর্মা। তাঁরা যে এক ‘সিরিয়াল কিলার’কে পাকড়াও করেছেন, তা প্রথমে টেরই পাননি বিট্টু এবং আরও এক পুলিশ সুপার রাহুল লোধা কুমার। পরে তাঁকে জেরা করতেই হতবাক হয়ে যান পুলিশ আধিকারিকরা।
এত খুনের পরও আদেশের কোনও হেলদোল ছিল না। চোখেমুখে অনুতাপের কোনও চিহ্ন ছিল না। যে ৩৩ জনকে খুন করেছেন আদেশ, তাঁদের সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্য পুলিশকে দেন তিনি।
এক জন সাধারণ দর্জি কী ভাবে ‘সিরিয়াল কিলার’ হলেন? তাঁর নেপথ্যে কি কেউ ছিলেন? ‘ইকোনমিক টাইমস’ জানিয়ছে, এক খুনির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন আদেশ। তাঁকে তিনি ‘কাকু’ বলে ডাকতেন। তাঁর নাম অশোক খামরা।
অশোকও একের পর এক ট্রাক চালকদের খুন করেছেন। সেই সংখ্যাটা ১০০। ২০১০ সালে গ্রেফতার করা হয়েছিল অশোককে। পুলিশি নিরাপত্তায় অশোককে ট্রেনে করে ভোপাল নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। সেই সময়ই পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালান অশোক। তার পর থেকে তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
বর্তমানে জেলে বন্দি আদেশ। গত বছর আদেশকে নিয়ে একটি খবর প্রকাশ্যে এসেছিল। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম মারফত জানা গিয়েছিল যে, ৫৩ বছর বয়সি আদেশ জেলের মধ্যে নাকি বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পড়ছেন। ধার্মিক হয়ে উঠেছেন। সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে এক আধিকারিক জানিয়েছিলেন যে, জেলের কুঠুরিতে অধিকাংশ সময় ধর্মীয় এবং বিভিন্ন অনুপ্রেরণামূলক বই পড়ে সময় কাটাচ্ছেন আদেশ।