হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী স্বর্গে শুধু দেবতারাই থাকেন, এমন নয়। সেখানে অপ্সরাদের মতো জীবও বাস করেন। ‘অপ্সরা’রা ছড়িয়ে রয়েছেন হিন্দু ও বৌদ্ধ সাহিত্যে, স্থাপত্যে, চিত্রকলায়। পুরাণ-মতে, অপ্সরারা অপরূপ সুন্দরী। কিন্তু তাঁদের ঠিক রক্তমাংসের মানবী বলা যায় না। তাঁরা দেবতাদের মতোই অতিপ্রাকৃত। স্বর্গে অপ্সরাদের মূল কাজ দেবতাদের মনোরঞ্জন। তাঁরা নৃত্য, গীত ও অন্য কলায় পারদর্শী। পুরাণ এবং মহাকাব্যগুলি থেকে বিভিন্ন অপ্সরার নাম পাওয়া যায়। এঁদেরই অন্যতমা হলেন উর্বশী।
উর্বশীকে অপ্সরাদের মধ্যে সবথেকে আকর্ষণীয়া বলে বর্ণনা করে পুরাণ ও মহাকাব্যগুলি। তাঁর জন্মবৃত্তান্ত যেমন কৌতূহল জাগায়, তেমনই তাঁর জীবনের নানা ঘটনা তাঁকে পৌরাণিক চরিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম রহস্যময়ী হিসাবে চিহ্নিত করে।
‘উর্বশী’ শব্দটি ‘ঊরু’ থেকে জাত। ‘দেবী ভাগবত’ অনুসারে উর্বশীর জন্ম হয়েছিল নারায়ণের ঊরু থেকে। ‘ভাগবত পুরাণ’ এই বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দেয়। এক সময়ে ধর্ম রক্ষার জন্য বিষ্ণু নর ও নারায়ণ নামের দুই পুরষের অবতারে অবতীর্ণ হন। তাঁরা সন্ন্যাস ব্রত ধারণ করে কঠোর তপস্যা শুরু করেন।
নর-নারায়ণের তপস্যার চরিত্র দেখে দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর আসন হারানোর ভয় পান এবং তাঁদের তপোভঙ্গের জন্য কামদেব, ঋতুরাজ বসন্ত এবং অপ্সরাদের প্রেরণ করেন। এই কাণ্ডে বিরক্ত হয়ে নারায়ণ একটি ফুল নিয়ে তাঁর ঊরুতে রাখেন। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে এক পরমাসুন্দরী অপ্সরার জন্ম হয়। তাঁর সৌন্দর্যের কাছে রম্ভা, মেনকা, তিলোত্তমা প্রমুখ অপ্সরা ম্লান হয়ে যান এবং তাঁরা লজ্জায় সেখান থেকে অন্তর্হিত হন।
নর ও নারায়ণ দেবরাজ ইন্দ্রকে জানান যে, তাঁর সিংহাসনের প্রতি তাঁদের কোনও লোভ নেই। সেই সঙ্গে তাঁরা উর্বশীকে ইন্দ্রের হাতে সমর্পণ করেন। উর্বশী ইন্দ্রের সভার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অপ্সরা হিসাবে বিরাজ করতে থাকেন।
উর্বশীকে নিয়ে পুরাণ ও মহাকাব্যে প্রচুর কাহিনি রয়েছে। এর মধ্যে সব থেকে পরিচিত কাহিনিটি হল তাঁর সঙ্গে চন্দ্রবংশীয় রাজা পুরুরবার প্রেমকাহিনি। পুরুরবা উর্বশীকে বিবাহ করতে চাইলে উর্বশী তাঁকে তিনটি শর্ত দেন। যার মধ্যে অন্যতম ছিল, পুরুরবা উর্বশীর পোষ্য মেষকে রক্ষা করবেন এবং তাঁরা সঙ্গমের সময় ছাড়া পরস্পরকে তাঁরা নগ্ন দেখবেন না।
পুরুরবা এবং উর্বশীর দাম্পত্য জীবন আনন্দেই কাটছিল। কিন্তু তাঁর সভা থেকে উর্বশীর চলে যাওয়ায় দেবরাজ ইন্দ্র অসন্তুষ্ট হন। তিনি উর্বশী ও পুরুরবার বিচ্ছেদ ঘটানোর উদ্যোগী হন। তাঁরই নির্দেশে কয়েক জন গন্ধর্ব পুরুরবা ও উর্বশীর মিলনের সময় পোষ্য মেষটিকে চুরি করেন। মেষটির ডাকে উর্বশী বুঝতে পারেন, তাকে কেউ হরণ করছে। তিনি পুরুরবাকে তাঁর প্রতিশ্রুতি স্মরণ করিয়ে দেন।
প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে পুরুরবা নগ্ন অবস্থাতেই মেষ উদ্ধারে দৌড়ান। এমন সময় ইন্দ্র এক বজ্রপাত ঘটান। বজ্রের আলোকে পুরুরবাকে নগ্নাবস্থায় দেখতে পান উর্বশী। শর্ত অনুযায়ী উর্বশী পুরুরবাকে ছেড়ে স্বর্গে চলে যান। পরে অবশ্য উর্বশী অনেক বার পুরুরবার সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন এবং ছয়টি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। কিন্তু স্থায়ী ভাবে তিনি আর মর্ত্যে আসেননি।
বেদ-সহ বিভিন্ন প্রাচীন সূত্র থেকে জানা যায় উর্বশী দুই বিখ্যাত বৈদিক ঋষি বশিষ্ঠ এবং অগস্ত্যেরও ‘জন্মদাত্রী’। ‘ঋগ্বেদ’ থেকে জানা যায়, বরুণ এবং মিত্রদেব এক যজ্ঞ করছিলেন। সেই সময় উর্বশী তাঁদের সামনে আবির্ভূতা হন। তাঁকে দেখে দুই দেবতাই কামাতুর হয়ে পড়েন এবং তাঁদের বীর্যপাত হয়। সেই শুক্র দু’টি আলাদা পাত্রে রেখে দেওয়া হয় এবং সেই দুই পাত্র থেকেই বশিষ্ঠ এবং অগস্ত্যের জন্ম হয়। তবে পরে পুরাণের কালে এই কাহিনি ভিন্ন ভাবেও বর্ণিত হয়েছে।
মহাভারত অনুসারে, উর্বশী ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিরও জন্মদাত্রী। মহামুনি কশ্যপের পুত্র বিভাণ্ডক উর্বশীকে এক নদীতে স্নানরতা অবস্থায় দেখে কামাতুর হয়ে পড়েন এবং তাঁর রেতঃস্খলন হয়। সেই রেতঃ এক হরিণী (আসলে এক শাপগ্রস্তা অপ্সরা) তার দেহে ধারণ করে এবং শিং-যুক্ত এক দিব্য শিশুর জন্ম দেয়। ইনিই বিখ্যাত ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি।
উর্বশীর উল্লেখ মহাভারতে বিস্তারিত ভাবে রয়েছে। মহাভারতের বনপর্বে মহাদেব, বরুণ, কুবের ও যমের কাছ থেকে বিভিন্ন দিব্যাস্ত্র প্রাপ্ত হওয়ার পর অর্জুন অস্ত্র প্রার্থনা করলেন ইন্দ্রের কাছে। ইন্দ্র তাঁকে দেবলোকে নিমন্ত্রণ করলেন এবং সেখানেই তাঁকে দিব্যাস্ত্র প্রদান করবেন বলে জানালেন।
ইন্দ্র-প্রেরিত রথে চড়ে অর্জুন দেবলোকে গেলেন। সেখানে ইন্দ্রের কাছে বিভিন্ন প্রকার অস্ত্র শিক্ষা করে পাঁচ বছর অতিবাহিত করেন। অর্জুনের সেই সময়ে উর্বশী ও অন্য অপ্সরাদের নৃত্য দেখার সৌভাগ্য হয়। এই অপ্সরামণ্ডলীর মাঝে উর্বশীর দিকে অর্জুন বেশ কয়েক বার দৃষ্টিপাত করায় ইন্দ্র সে কথা গন্ধর্ব চিত্রসেনকে জানান। চিত্রসেন ছিলেন অর্জুনের নৃত্য, গীত ও বাদ্যের গুরু। তিনি উর্বশীকে জানান যে, অর্জুন তাঁর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছেন এবং তাঁর প্রতি মিলনাকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন।
উর্বশী চিত্রসেনকে জানালেন যে, তিনিও অর্জুনের প্রতি অনুরক্তা। তিনি অপূর্ব সাজে সজ্জিতা হয়ে অর্জুনের কাছে গেলেন এবং মিলিত হতে চাইলেন। কিন্তু অর্জুন জানালেন যে, উর্বশী তাঁর প্রণম্যা। তিনি তাঁকে মাতৃভাবে দেখেন। কারণ পুরুরবার সঙ্গে সংসর্গের ফলে আয়ু জন্মগ্রহণ করেন। আয়ুর প্রপৌত্র হলেন পুরু। অর্জুন তাঁরই বংশধর। সেই যুক্তিতে উর্বশী অর্জুনের মাতৃতুল্যা।
অর্জুনের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে উর্বশী তাঁকে অভিশাপ দিলেন যে, তিনি সম্মানহীন নপুংসক নর্তক হয়ে স্ত্রীলোকের মধ্যে বিচরণ করবেন। উর্বশীর অভিশাপে অর্জুন বিভ্রান্ত বোধ করেন এবং ইন্দ্রের শরণাপন্ন হন।
ইন্দ্র অর্জুণের প্রশংসা করে বলেন, তিনি ধৈর্যে ঋষিদেরকেও পরাজিত করেছেন। তবে উর্বশীর অভিশাপ তাঁর কাজে লাগবে। অজ্ঞাতবাসের সময়ে অর্জুন এক বছর নপুংসক নর্তক হয়ে কাটাবেন। পরে আবার পুরুষত্ব ফিরে পাবেন।
অজ্ঞাতবাসকালে অর্জুন নপুংসক দশা প্রাপ্ত হন এবং রাজা বিরাটের আশ্রয়ে তিনি বৃহন্নলা নাম নিয়ে রাজ-অন্তঃপুরে নৃত্য, গীত ও বাদ্যের শিক্ষিকা হিসেবে এক বছর অতিবাহিত করেন।