কথায় বলে— ‘মান্ধাতার আমল’। কিন্তু কে এই মান্ধাতা? অনুসন্ধান করতে বসলে পুরাণ আর মহাকাব্য থেকে এমন সব কাহিনি উঠে আসে, যা সত্যিই হতবাক করে দেয়। পৌরাণিক রাজা মান্ধাতার কাহিনি বর্ণিত আছে ‘মহাভারত’-এর বনপর্বে। ওই মহাকাব্যেরই দ্রোণ ও শান্তি পর্বে তাঁর উল্লেখ রয়েছে। তিনি রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ। সুতরাং তিনি ‘রামায়ণ’-এও উল্লিখিত। সর্বোপরি ‘ঋগ্বেদ’-এর দশম মণ্ডলের ১৩৪ সংখ্যক স্তোত্র মান্ধাতার প্রতিই উৎসর্গীকৃত।
মান্ধাতা অনেক জায়গায় ‘মান্ধাতৃ’ নামেও উল্লিখিত রয়েছেন। তিনি ইক্ষ্বাকু বা সূর্যবংশীয় রাজা। তাঁর পিতা অযোধ্যারাজ যুবনাশ্ব। সব থেকে আশ্চর্যের কথা, পুরাণ মতে মান্ধাতা মাতৃগর্ভজাত নন। তাঁকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন তাঁর পিতা।
মহাভারত-এর বনপর্বে মান্ধাতার জন্মবৃত্তান্ত পাণ্ডবদের কাছে বর্ণনা করেন লোমশ মুনি। তাঁর বর্ণিত কাহিনি অনুসারে অযোধ্যার রাজা যুবনাশ্ব নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি মন্ত্রীদের উপর রাজ্যভার দিয়ে বনে গিয়ে সন্তান কামনায় যোগসাধনা শুরু করেন। এক দিন তিনি ক্লান্ত ও পিপাসার্ত অবস্থায় চ্যবন মুনির আশ্রমে প্রবেশ করে দেখলেন, যজ্ঞবেদির উপর এক কলস জল রয়েছে।
ক্লান্ত যুবনাশ্ব সেই জল পান করে অবশিষ্ট জল কলস থেকে ফেলে দিলেন। চ্যবন সেখানে এসে দেখলেন, কলস জলশূন্য। যুবনাশ্ব তাঁকে জানালেন যে, তিনিই সেই জল পান করেছেন। চ্যবন বললেন, ওই কলসের জল ছিল মন্ত্রঃপূত যা রাখা ছিল যুবনাশ্বেরই স্ত্রীর জন্য। ওই জল পান করলে রানি সন্তানসম্ভবা হতেন। এখন রাজা তা পান করায় রাজাকেই গর্ভধারণ করতে হবে। সেই সঙ্গে চ্যবন এও জানালেন যে, রাজাকে প্রসব যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে না।
একশত বছর যুবনাশ্ব গর্ভধারণ করলেন। অবশেষে তাঁর শরীরের বাম পার্শ্ব ভেদ করে এক পুত্রের জন্ম হল। অপূর্বদর্শন ও তেজস্বী সেই পুত্রকে দেখতে দেবতারাও উপস্থিত হলেন। সমস্যা দেখা দিল সদ্যোজাত শিশুর খাদ্য নিয়ে। সে মাতৃগর্ভজাত নয়, ফলে তার মা তাকে স্তন্যদুগ্ধ দান করতে পারবেন না। তখন দেবরাজ ইন্দ্র বললেন— ‘মাং ধাস্যতি।’ এর অর্থ— ‘আমাকে পান করবে’। ইন্দ্র তাঁর তর্জনি শিশুর মুখে পুরে দিলেন। সেখান থেকে দুগ্ধ নির্গত হয়ে শিশুকে পুষ্ট করল। ‘মাং ধস্যতি’ থেকেই তার নাম হল ‘মান্ধাতা’।
মান্ধাতা কালক্রমে এক তেজস্বী পুরুষ হয়য়ে উঠলে তাঁকে দেবরাজ ইন্দ্র স্বয়ং যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করেন। তিনি ধনুর্বিদ্যায় পারঙ্গম ছিলেন। মান্ধাতা ত্রিভুবন জয় করে এবং বহু যজ্ঞ করে ইন্দ্রের অর্ধাসন লাভ করেন।
যুবনাশ্বের পরে মান্ধাতা ইক্ষ্বাকু সিংহাসনে আরোহণ করেন। মান্ধাতার আমল ছিল অসম্ভব সম্মৃদ্ধিতে পূর্ণ। তিনি এত সম্পদ আহরণ করেছিলেন যে, প্রজাদের কাছ থেকে কর নেওয়ারও কোনও প্রয়োজন ছিল না। তিনি সমস্ত কর অবলুপ্ত করেন। ‘মান্ধাতার আমল’ প্রবাদটি সম্ভবত সেই সুখ ও স্মৃদ্ধির কালকেই চিহ্নিত করে।
দাতা বা দানবীর হিসেবেও মান্ধাতা বিপুল খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তিনি একশত অশ্বমেধ এবং একশত রাজসূয় যজ্ঞ সম্পন্ন করেন। সেই সব যজ্ঞে তিনি পু্রোহিত ও অন্য ব্রাহ্মণদের বিপুল পরিমাণ সোনা ও গরু দান করেন।
মান্ধাতা শিবভক্ত ছিলেন। নর্মদা নদীর মধ্যস্থ এক দ্বীপে তিনি ওঁকারেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গের আরাধনা করেন। অধুনা মধ্যপ্রদেশের এই স্থানটি আজও ‘মান্ধাতা’ নামেই পরিচিত। পরে অবন্তী জনপদের রাজধানী এখানে গড়ে ওঠে। এর অন্য নাম শিবপুরী বা মহিষ্মতি।
মান্ধাতার সঙ্গে রাক্ষসরাজ রাবণের এক বার যুদ্ধ হয়েছিল। দুই শিবভক্তের এই লড়িয়ে কারওরই জয় হয়নি। তবে মহা পরাক্রমশালী রাবণও মান্ধাতার শৌর্যকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে মান্ধাতারই বংশধর রমচন্দ্রের হাতে রাবণ নিহত হন। মান্ধাতার পরাক্রমের জন্য তাঁকে বহু পুরাণে ‘ত্রাসদস্যু’-ও বলা হয়েছে।
সূর্যবংশী ইক্ষ্বাকু রাজা মান্ধাতা বিবাহ করেন চন্দ্রবংশী যাদবরাজ-কন্যা বিন্দুমতীকে। তাঁরা তিন পুত্র ও ৫০টি কন্যার জন্ম দেন। তাঁর তিন পুত্র— পুরুকুৎস, অম্বরীশ এবং মুচুকুন্দও মহাপরাক্রমশালী ছিলেন বলে পুরাণ থেকে জানা যায়।
মান্ধাতা স্বর্গের সম্পূর্ণ অংশ জয় করতে চাইলে দেবরাজ ইন্দ্র প্রমাদ গণেন। তিনি মান্ধাতাকে জানান যে, লবণাসুর নামে এক অসুররাজকে মান্ধাতা তখনও পরাভূত করতে পারেননি। ইন্দ্রের প্ররোচনায় মান্ধাতা লবণাসুরের রাজধানী মধুপুরী আক্রমণ করেন।
রাবণের ভগ্নীপতি লবণাসুরও ছিলেন শিবভক্ত। তিনি শিবের কাছ থেকে এক দৈব ত্রিশূল লাভ করেছিলেন। এই ত্রিশূলের কল্যাণে তিনি অপরাজেয় ছিলেন। মান্ধাতার আক্রমণ প্রতিহত করতে লবণাসুর সেই ত্রিশূল প্রয়োগ করেন। সৈন্য-সামন্ত সহ মান্ধাতা সেই ত্রিশূলের তেজে ভস্মীভূত হন।
বহু যুগ পরে মান্ধাতার বংশধর শত্রুঘ্ন লবণাসুরকে বধ করে পূর্বপুরুষের অভিষ্ট কাজ সম্পূর্ণ করেন। প্রসঙ্গত, সেই যুদ্ধে লবণাসুর ত্রিশুলটি নিয়ে অবতীর্ণ হননি।
মান্ধাতার জন্মকাহিনি নিয়ে পুরাণবিদ দেবদত্ত পট্টনায়েক ‘দ্য প্রেগন্যান্ট কিং’ নামে এক উপন্যাস লিখেছেন ২০০৮ সালে। এখানে অবশ্য যুবনাশ্বকে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সমসাময়িক বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এ কারণে দেবদত্ত অন্যান্য পুরাণবিদদের কাছে সমালোচিতও হয়েছেন। তবে এই উপন্যাসে পুরুষের গর্ভধারণের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে দেবদত্ত লিঙ্গ-ভিত্তিক আত্মপরিচয় নিয়ে বহু প্রশ্ন তুলেছেন, যা এই সময়ের পুরাণ চর্চাকারীদের কাছে ভাবনার নতুন দ্বার উন্মুক্ত করেছে বলেও অনেকে মনে করেন।