ইরানের পর এ বার পাকিস্তান? ইসলামাবাদের পরমাণু হাতিয়ার ছিনিয়ে নেবে আমেরিকা? মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা। যদিও তাতে সরাসরি ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির নাম করেননি তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়া ইস্তক পরমাণু হাতিয়ার ইস্যুতে ইরানকে ক্রমাগত নিশানা করে চলেছেন ট্রাম্প। এ ব্যাপারে একটি নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিতে তেহরানকে সই করাতে চাইছেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে পারস্য উপসাগরের কোলের শিয়া মুলুকটির সঙ্গে একপ্রস্ত আলোচনা সেরেছে ওয়াশিংটন।
চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল সম্ভাব্য পরমাণু চুক্তি নিয়ে ইটালির রাজধানী রোমে দ্বিতীয় পর্যায়ে দু’পক্ষের আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। ঠিক তার মুখে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘‘কট্টরপন্থীদের হাতে কখনওই পরমাণু অস্ত্র থাকতে পারে না।’’ তাঁর ওই মন্তব্যের পরই দুনিয়া জুড়ে শোরগোল পড়ে যায়।
বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, এ ক্ষেত্রে কট্টরপন্থী বলতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট শুধুমাত্র ইরানের কথাই বলছেন না। সেই তালিকায় রয়েছে পাকিস্তানেরও নাম। ইসলামাবাদের পরমাণু অস্ত্র নিয়ে গত কয়েক বছরে ওয়াশিংটনের উদ্বেগ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও মনে করেন তাঁরা।
আমেরিকার স্থানীয় সংবাদ সংস্থাগুলির দাবি, গত বছরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ক্ষমতা হস্তান্তর পর্বে ট্রাম্পের পূর্বসূরি জো বাইডেন প্রশাসন পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রভান্ডার নিয়ে সতর্ক করে। এই সংক্রান্ত একটি গোপন রিপোর্টও নতুন সরকারের হাতে তুলে দেয় তারা।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় উদ্বেগ ‘বন্ধু’ ইজ়রায়েলকে নিয়ে। কারণ, ইহুদিভূমিকে পৃথক দেশ হিসাবে মান্যতা দেয়নি ইসলামাবাদ। তাঁদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে ইরান মদতপুষ্ট প্যালেস্টাইনপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠী হামাস, হিজ়বুল্লা বা হুথিদের দিকে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে (পিওকে) লশকর-ই-ত্যায়বা, জইশ-ই-মহম্মদ এবং হিজ়বুল মুজাহিদিনের মতো ইসলামাবাদ মদতপুষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলির ডাকা সভায় প্রধান অতিথির আসনে ছিলেন হামাসের বেশ কয়েক জন শীর্ষনেতা। ওই ঘটনার দিকে কড়া নজর ছিল ওয়াশিংটনের।
পিওকের সভা থেকে ইজ়রায়েলকে নিয়ে বিষোদ্গার করেন হামাস নেতৃবৃন্দ। ইহুদিদের ‘গণহত্যাকারী’ বলতেও ছাড়েননি তাঁরা। পরবর্তী সময়ে অবশ্য হামাসের গড় প্যালেস্টাইনের গাজ়ায় বোমাবর্ষণের মাত্রা বৃদ্ধি করে ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ)।
ট্রাম্প আবার প্যালেস্টাইনবাসীদের থেকে গাজ়াকে পুরোপুরি মুক্ত করার কথা বলেছেন। সেখানে নতুন করে শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। আর তাই আইডিএফের গাজ়ায় আক্রমণের ঝাঁজ বৃদ্ধির নেপথ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের প্রচ্ছন্ন মদত রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের বড় অংশ।
এই পরিস্থিতিতে হামাস বা হিজ়বুল্লার মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর পরমাণু অস্ত্র চেয়ে পাকিস্তানের দ্বারস্থ হওয়া আশ্চর্যের নয়। তাতে রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা সম্মতি জানালে ইজ়রায়েলের অস্তিত্ব যে বিপন্ন হওয়ার মুখে পড়বে, তা বলাই বাহুল্য। ফলে এই ইস্যুতে হিসাব কষা শুরু করেছে ট্রাম্প প্রশাসন।
সংবাদ সংস্থা দ্য গার্ডিয়ানের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৭ সাল থেকে পাকিস্তানের পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা চালিয়ে যাচ্ছে আমেরিকার প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগন। ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্টের ওভাল অফিসে এই সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট পাঠানো হয়।
২০১৭ সালে বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন পেন্টাগনের এক পদস্থ কর্তা। তাঁর কথায়, ‘‘যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র পাকিস্তানের কাছে মজুত রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, বার বার সেনা শাসন এবং চরমপন্থার দ্রুত বৃদ্ধির ফলে সেগুলি যে জঙ্গিদের হাতে পড়বে না, তা নিশ্চিত করে বলা বেশ কঠিন।’’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পেন্টাগনের ওই আধিকারিক বলেন, ‘‘ইসলামাবাদের পরমাণু অস্ত্রের ঠিকানাগুলি মোটামুটি আমাদের জানা। ফলে দ্রুত অভিযান চালিয়ে সেগুলির দখল নেওয়া একেবারেই কঠিন হবে না।’’ যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপ করলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাতের সূচক যে হ্রাস পাবে, তা বলাই বাহুল্য।
২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘ওয়ার অন দ্য রক্স’ প্রবন্ধে পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা প্রকাশ করেন ক্রিস্টোফার ক্ল্যারি। ২০০৬-২০০৯ সাল পর্যন্ত মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিবের কার্যালয়ে দক্ষিণ-এশিয়া ডেস্কে কাজ করতেন তিনি। ক্ল্যারির দাবি, ইসলামাবাদের কাছে শতাধিক পরমাণু অস্ত্র রয়েছে।
‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর আবার দাবি, পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা ১৭০। ক্ল্যারি জানিয়েছেন, যুদ্ধের সময় প্রয়োজনে ২০০ থেকে ৩০০টি পর্যন্ত এই ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র তৈরির সক্ষমতা রয়েছে রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তাদের। প্রবন্ধে এই বিষয়টি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।
সূত্রের খবর, ইসলামাবাদের পরমাণু অস্ত্রভান্ডারের বড় অংশই রয়েছে বালোচিস্তানে। এর উত্তরে খাইবার-পাখতুনখোয়া এবং পশ্চিমে আফগানিস্তান। বর্তমানে পাক সেনার বিরুদ্ধে একরকম যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন বালোচ বিদ্রোহীরা। তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) বিদ্রোহীদের আবার দাপাদাপি রয়েছে খাইবার-পাখতুনখোয়ায়।
রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তাদের অভিযোগ, পর্দার আড়ালে থেকে টিটিপিকে মদত দিচ্ছে আফগানিস্তানের বর্তমান শাসক তালিবান। এই দুই বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে পাক পরমাণু অস্ত্র পড়ুক, তা চায় না আমেরিকা। কারণ, সে ক্ষেত্রে ঘুরপথে তা হিন্দুকুশের কোলের শাসকদের কাছে পৌঁছোনোর আশঙ্কা থাকছে।
গত শতাব্দীর ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। ১৯৫৪ সালে আমেরিকার নেতৃত্বে তৈরি হয় ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা’ বা সিটো (সাউথ ইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন)। এর অন্যতম সদস্য রাষ্ট্র ছিল পাকিস্তান।
কিন্তু, ২১ শতকে চিনের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক মজবুত হওয়ায় পাকিস্তানের উপর থেকে বিশ্বাস হারাতে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গত বছর ইসলামাবাদের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে বাইডেন প্রশাসন, যার কড়া নিন্দা করতে ছাড়েননি রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা।
পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রের উপরে যুক্তরাষ্ট্রের যে নজর রয়েছে, প্রকাশ্যে তা কবুল করেছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। কুর্সি হারানোর পর একটি জনসভায় তিনি বলেন, ‘‘দেশকে চার-পাঁচ টুকরো করার চক্রান্ত চলছে। এর জন্য প্রথমে আণবিক অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া হবে।’’