ভারত মহাসাগরের বুকে প্রায় জনহীন প্রবাল দ্বীপ। এত দিন সেখানে টিমটিম করে টিকে ছিল ব্রিটিশ রাজ। এ বার অস্ত গেল সেই সূর্যও। নামিয়ে ফেলা হয়েছে ‘ইউনিয়ন জ্যাক’। কিন্তু তার পরও রাতদিন বিদেশি বোমারু বিমান আর লড়াকু জেটের গর্জনে কান পাতা দায়! আশপাশের সমুদ্রে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যুদ্ধজাহাজ। কে বা কারা ছড়ি ঘোরাচ্ছে ওই নির্জন দ্বীপে? কেনই বা সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে সেনাঘাঁটি? প্রশ্ন অনেক, তবে উত্তর বেশ জটিল।
গত বছরের অক্টোবরে মরিশাসের সঙ্গে একটি হস্তান্তর চুক্তিতে সই করে ব্রিটিশ সরকার। সেই চুক্তি অনুযায়ী দিয়েগো গার্সিয়া-সহ চাগোস দ্বীপপুঞ্জের সার্বভৌমত্ব ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয় তারা। এ বছরের ১ এপ্রিল চুক্তিটি অনুমোদন করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কারণ, চাগোসে রয়েছে আমেরিকার কৌশলগত সামরিক ঘাঁটি।
হস্তান্তর চুক্তি অনুযায়ী, ৯৯ বছরের লিজ়ে চাগোস পাচ্ছে মরিশাস। তবে এই দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত দিয়েগো গার্সিয়াতে রয়েছে আমেরিকা ও ব্রিটেনের নৌঘাঁটি। এই ঘাঁটি অবশ্য ব্যবহার করতে পারবে দুই দেশের ফৌজ। চাগোসের অধিকার ত্যাগের পরও ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সেখান থেকে সেনাঘাঁটি সরাতে না চাওয়ার নেপথ্যে একাধিক কারণের কথা বলেছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
চাগোস দ্বীপপুঞ্জের এ হেন হস্তান্তর চুক্তির প্রবল সমালোচনা করেছেন আমেরিকা ও ব্রিটেনের পদস্থ সেনাকর্তারা। তাঁদের যুক্তি, এর ফলে ইন্দো-প্রশান্ত এবং ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় বৃদ্ধি পাবে চিনের প্রভাব। পাশাপাশি, ভবিষ্যতে পশ্চিম এশিয়া হোক বা দূরে কোথাও, যুদ্ধ পরিচালনা করতে গেলে সমস্যার মুখে পড়বে বাহিনী। আর তাই কোনও অবস্থাতেই সেখান থেকে নৌঘাঁটি সরাতে নারাজ তাঁরা।
ভারত মহাসাগরের দক্ষিণে মোট ৬০টি ছোট ছোট প্রবাল দ্বীপের একটি মালা তৈরি হয়েছে। এরই নাম চাগোস দ্বীপপুঞ্জ। এর অন্যতম হল দিয়েগো গার্সিয়া। অনন্ত জলরাশির মধ্যে ৩০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এটি গড়ে উঠেছে। আফ্রিকা এবং পশ্চিম এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থলে এই দ্বীপ অবস্থিত। হরমুজ প্রণালী থেকে এর দূরত্ব খুব বেশি নয়। প্রবাল দ্বীপপুঞ্জটিকে পাশ কাটিয়ে চলে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেলের পরিবহণ।
কৌশলগত দিক থেকে এই অবস্থানের কারণে দিয়েগো গার্সিয়ার নৌঘাঁটিকে ‘লজিস্টিক হাব’ হিসাবে ব্যবহার করেন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের সেনা অফিসারেরা। সেখান থেকে ড্রোন বা গুপ্তচর বিমান উড়িয়ে অহরহ চলে নজরদারি বা গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ। এ ছাড়া লম্বা দূরত্ব পেরিয়ে বোমারু বিমানের সাহায্যে আক্রমণ শানানোর ক্ষেত্রেও চাগোস দ্বীপপুঞ্জের ঘাঁটিটির প্রয়োজন হয় তাঁদের।
অতীতে উপসাগরীয়, ইরাক এবং আফগানিস্তানের যুদ্ধে একাধিক অভিযান পরিচালনায় দিয়েগো গার্সিয়ার সেনাঘাঁটি ব্যবহার করেছে আমেরিকা। পরমাণু চুক্তিকে কেন্দ্র করে বর্তমান সময়ে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এর জেরে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না দুনিয়ার তাবড় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
আর তাই ২১ শতকে ওয়াশিংটনের কাছে দিয়েগো গার্সিয়ার গুরুত্ব কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতিমধ্যেই সেখানে বি-২ স্পিরিট স্টেলথ বোমারু বিমান মোতায়েন করেছে মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগন। এর সাহায্যে পারস্য উপসাগরের শিয়া মুলুকটির ভিতরে ঢুকে হামলা চালাতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি, যুদ্ধের সময়ে হরমুজ প্রণালী পর্যন্ত রণতরীগুলিতে অহরহ গোলাবারুদ এবং রসদ পৌঁছোতে বেশ সুবিধা পাবে তারা।
ইরান উপকূল থেকে দিয়েগো গার্সিয়ার দূরত্ব মেরেকেটে ৩,৭৯৫ কিলোমিটার। আর তাই সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশের অনুমান, তেহরান-ওয়াশিংটন সম্মুখসমরে গেলে, দিয়েগো গার্সিকাকে সইতে হবে লড়ায়ের ক্ষত। কারণ ইতিমধ্যেই সেখানকার মার্কিন নৌঘাঁটিতে হামলা চালানোর পরিকল্পনা ছকে ফেলেছেন শিয়া ফৌজ় ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’ বা আইআরজিসির শীর্ষ অফিসারেরা।
ইরানের কাছে খোররামশাহর এবং সেজ্জিল-সহ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের বিশাল ভান্ডার রয়েছে। এগুলির সাহায্যে অনায়াসেই দিয়েগো গার্সিয়ার মার্কিন নৌঘাঁটিকে নিশানা করতে পারবে আইআরজিসি। এ ছাড়া শিয়া ফৌজের ড্রোন শক্তিও আমেরিকার কাছে যথেষ্ট উদ্বেগের।
এই প্রবাল দ্বীপগুলির মধ্যে আকারের দিক থেকে দিয়েগো গার্সিয়াই সবচেয়ে বড়। ১৫১২ সালে এর সন্ধান পান পর্তুগিজ নাবিক পেড্রো মাসকারেনহাস। জায়গাটা জনমানবশূন্য হওয়ায় তা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাননি তিনি। পরবর্তী কালে স্পেনীয় অভিযাত্রী দিয়েগো গার্সিয়া দে মোগুয়ের ফের পৌঁছোন ওই দ্বীপে। নিজের নামেই করেন প্রবাল দ্বীপের নামকরণ। সালটা ছিল ১৫৪৪।
১৮ শতক পর্যন্ত দিয়েগো গার্সিয়াতে ছিল না কোনও বসতি। ১৭৭৮ সালে মরিশাসের ফরাসি গভর্নর লোকলস্কর পাঠিয়ে সেখানে শুরু করেন নারকেল চাষ। তাতে কাজে লাগানো হয় দাসদের। ১৭৮৬ সালে কুষ্ঠরোগীদের উপনিবেশ হিসাবে দিয়েগো গার্সিয়ার ব্যবহার শুরু করে ফ্রান্স।
১৮১৪ সালে ইউরোপে শেষ হয় দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের যুদ্ধ। এলবা দ্বীপে নির্বাসিত হন ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট। লড়াই হেরে যাওয়ায় দিয়েগো গার্সিয়া ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেয় ফরাসি সরকার। চাগোস দ্বীপপুঞ্জ থেকে যাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে শুরু করেন ইংরেজ প্রশাসকেরা। এই নিয়ে পরবর্তী কালে দেখা দেয় নতুন রাজনৈতিক জটিলতা।
১৯৬৮ সালের ১২ মার্চ ব্রিটেনের শাসন থেকে মুক্তি পায় মরিশাস। দ্বীপরাষ্ট্রটি স্বাধীনতা পেলেও চাগোসের ক্ষমতা ছিল ইংল্যান্ডের হাতেই। ওই সময়ে আমেরিকাকে নৌঘাঁটি তৈরির জন্য দিয়েগো গার্সিয়ার জমি লিজ় দেয় ব্রিটিশ সরকার। এই নিয়ে দুই দেশের মধ্যে ৫০ বছরের চুক্তি হয়েছিল, যা সম্প্রতি আরও ২০ বছর বৃদ্ধি করা হয়ছে। ফলে, ২০৩৬ সাল পর্যন্ত সেখানে নৌবহর রেখে দিব্যি ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় নজরদারি চালাতে পারবে আমেরিকা।
এই পরিস্থিতিতে দিয়েগো গার্সিয়া তাদের দেশের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে দাবি তোলে মরিশাস। এই বিষয়ে ২০১৭ সালে ২২ জুন রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় পাশ হয় একটি সম্মতিপত্র। এই নিয়ে মীমাংসার জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালতকে (আইসিজে) অনুরোধ করা হয়েছিল। চাগোস দ্বীপপুঞ্জ থেকে দিয়েগো গার্সিয়াকে আলাদা ভাবে দেখার বিষয়টিকে অবৈধ বলে জানিয়েছিল আন্তর্জাতিক আদালত।
২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ভারত মহাসাগরীয় প্রবাল দ্বীপ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ রায় দেয় আন্তর্জাতিক বিচার আদালত। সেখানে বলা হয়, মরিশাস স্বাধীনতা লাভ করলেও সেখানকার ঔপনিবেশিকরণের সমাপ্তি আইনসম্মত ভাবে হয়নি। ফলে ব্রিটেনকে যত দ্রুত সম্ভব সেখানকার প্রশাসন চালানো থেকে সরে আসতে হবে।
আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের এই রায়ের পরেই চাপে পড়ে ব্রিটিশ সরকার। বাধ্য হয়ে ২০২২ সাল থেকে সমস্যা সমাধানের জন্য মরিশাসের সঙ্গে টানা আলোচনা চালায় ইংল্যান্ড। শেষ পর্যন্ত প্রবাল দ্বীপগুলি হস্তান্তরে রাজি হয় ব্রিটেন।
প্রবাল দ্বীপে বছরের পর বছর ধরে থাকার ফলে উন্নত সামরিক পরিকাঠামো তৈরি করেছে আমেরিকা। বিগত কয়েক বছর ধরেই যাদের চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে চিন। দিয়েগো গার্সিয়া হাতে থাকায় খুব সহজেই সেখান থেকে নৌবহর পাঠিয়ে দক্ষিণ চিন সাগর বা জাপান সাগর পর্যন্ত বেজিঙের আগ্রাসন রুখতে পারবে ওয়াশিংটন। শুধু তা-ই নয়, সে ক্ষেত্রে তাইওয়ান আক্রমণের আগেও দু’বার ভাবতে হবে চিনকে।
দিয়েগো গার্সিয়ার এই কৌশলগত অবস্থান এবং সেখানে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি থাকার কারণেই এর হস্তান্তরে প্রথম পর্যায়ে রাজি ছিল না ব্রিটেন। মরিশাস সরকার সামরিক ঘাঁটি থাকার বিষয়টি মেনে নেওয়ায় সমস্যা মিটে যায়। এর পরই দ্রুত চুক্তিপত্রে সই করে দিয়েছে ব্রিটেন।