কালো দেহের উপর জমকালো হলুদ-কমলা রঙের লম্বা দাগ। আবার কোনওটির গায়ে সাদা, কালো, কমলা সরু সরু দাগ। হাজার হাজার সাপ কিলবিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে গোটা শহরে। তাদের দেখতে প্রতি বছর সেই শহরে ভিড় জমান কয়েক হাজার প্রকৃতিপ্রেমী, সর্পবিদ ও প্রাণীবিদেরা।
কানাডার ম্যানিটোবা শহর। সেখানকার গিমলি থেকে প্রায় ৩০ মিনিট পশ্চিমে অবস্থিত নার্সিস স্নেক ডেন। সাপের আখড়া। অঞ্চলটিতে প্রচুর জীর্ণ চুনাপাথরের গুহা রয়েছে। সেই ঠান্ডা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ সাপেদের বসবাসের জন্য আদর্শ।
কানাডার ম্যানিটোবাতে অবস্থিত নার্সিসে প্রতি বসন্তে ঘটে এক অসাধারণ ঘটনা। শীতের শেষে শীতঘুম ভেঙে ৭৫ হাজারেরও বেশি সাপ এখানে এসে জড়ো হয়। সেই সংখ্যা কখনও দেড় লক্ষের বেশি হয়। জোড়ায় জোড়ায় সাপ ঘুরতে দেখা যায় নার্সিসে।
আদতে এটি হল গার্টার সাপের মধুচন্দ্রিমার স্থান। বংশবৃদ্ধি ও প্রজননের জন্য পুরুষ ও স্ত্রী সাপের মিলনকেন্দ্র হয়ে ওঠে নার্সিসের বনভূমি। সেখানে পা দিলে একসঙ্গে প্রচুর পরিমাণে সাপ আপনাকে ‘স্বাগত’ জানাবে। সাপের ‘হনিমুন স্পট’ নামে পরিচিত এই শহরে প্রতি বছর বহু সাপ মিলনের জন্য জড়ো হয়।
পরিযায়ী সাপগুলি মূলত পূর্বাঞ্চলীয় গার্টার সাপ। জীববিজ্ঞানীরা প্রতি বছর মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত সাপের বিশাল সমাবেশ পর্যবেক্ষণ করতে নার্সিসে যান। শীতঘুমের পর গোপন আস্তানা থেকে বেরিয়ে এসে এই সাপগুলি উষ্ণতা এবং সঙ্গমের জন্য সঙ্গীর সন্ধানে নার্সিসে চলে আসে।
পুরুষ সাপ চেষ্টা করে স্ত্রী সাপদের আকৃষ্ট করার। প্রতিযোগিতা এতটাই কঠিন হয়ে পড়ে যে, কখনও কখনও দেখা যায় একটি স্ত্রী সাপকে বেষ্টন করে আছে শ’খানেক পুরুষ সাপ। শুধু ভালবাসার লড়াই নয়, চলে একে অপরের শরীরে লেপ্টে থেকে উষ্ণ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াও। শীতঘুমের ফলে সাপের শীতল রক্তকে গরম করে নেওয়ার জন্য সেগুলি দলবদ্ধ থাকে।
এই অঞ্চলটির লাল-পিঠযুক্ত গার্টার সাপের প্রজননভূমি হয়ে ওঠার পিছনে একটি আকর্ষণীয় ইতিহাস রয়েছে। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত নার্সিসের আশপাশে প্রায় ৭০ হাজার সাপ বাস করত। সেই বছরে, তীব্র আবহাওয়ার কারণে এই অঞ্চলে সাপগুলি তাদের শীতকালীন আস্তানায় সময়মতো পৌঁছোতে পারেনি। নার্সিসের খুব কাছেই রয়েছে একটি জাতীয় সড়ক।
সেই সড়ক পেরোতে গিয়ে গাড়ির ধাক্কায় মারা পড়ে প্রচুর গার্টার সাপ। সংখ্যাটা ১০ হাজারের কাছাকাছি। ওই অঞ্চলে গাড়ির চাকায় সাপ মারা যাওয়ার ঘটনাটি অস্বাভাবিক না হলেও সেই বছর মৃত সাপের সংখ্যা বিপুল হওয়ায় সেটি স্থানীয় প্রাণী সংরক্ষণকারীদের কাছে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
সেখানকার স্বেচ্ছাসেবকেরা হাইওয়ের নীচে থাকা সুড়ঙ্গে সাপগুলিকে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য বরফের বেড়া তৈরি করেন। ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে নিরাপদে যাতায়াতের সুবিধার্থে প্রতিরোধী বেড়া এবং ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ স্থাপন করা হয়। এর ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত সাপের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পায়।
প্রতিটি বসন্তে প্রকৃতির এক মনোমুগ্ধকর প্রদর্শনী দেখা যায় এখানে। পুরুষ সাপেরা অধীর আগ্রহে স্ত্রী সাপের আগমনের জন্য অপেক্ষা করে। এদের মধ্যে এক উন্মত্ত প্রজনন রীতি চালু আছে, যেখানে কয়েকশো পুরুষ সাপ একটি স্ত্রী সাপকে ঘিরে থাকে। স্ত্রী সাপের চারপাশে দল বেঁধে ঘোরে তারা। পুরুষ সাপ চেষ্টা করে স্ত্রী সাপকে আকৃষ্ট করতে। ফলে একটি নাটকীয় দৃশ্যের সাক্ষী থাকেন পর্যটকেরাও।
শীতকালে সাপগুলি চুনাপাথরের গুহায় মাটির নীচে থাকে। বসন্তের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষ সাপ প্রথমে জেগে ওঠে সঙ্গী খুঁজতে। স্ত্রী সাপটি পুরুষ সাপকে উপযুক্ত মনে করলে তবেই সম্পর্ক তৈরি করে।
পর্যটক ছাড়া এখানে আসেন সর্পবিশারদেরাও। নার্সিসে সাপের মিলনের ঘটনা বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে মত বিশেষজ্ঞদের। এটি বিজ্ঞানীদের সাপ নিয়ে গবেষণায় সাহায্য করে।
তিন কিলোমিটার পথ হাইকিং করে হাজার হাজার লাল-পিঠযুক্ত গার্টার সাপের দর্শন মেলে এখানে। গাছের ছায়ায় ঢাকা পথটিতে চলতে কোনও অসুবিধা হয় না। সুন্দর ভাবে দিক্নির্দেশ করা রয়েছে।
নার্সিসে সাপেদের আস্তানায় এসে তাদের স্পর্শ করার অনুমতিও মেলে। এই সাপগুলি বিষাক্ত নয়। তবে বিরক্ত করলে সাপগুলি আত্মরক্ষার জন্য কামড়াতে পারে। তবে এদের ছোট ছোট দাঁত ত্বকের বিশেষ ক্ষতি করে না বলেই জানা গিয়েছে।
যদি কেউ সাপ হাতে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেন, তা হলে গায়ে সাপের মলত্যাগ করার সম্ভাবনা থাকে। এটি সাপটির আরও একটি আত্মরক্ষার ব্যবস্থা। এই সাপের বিষ্ঠার গন্ধ দীর্ঘ সময় ধরে স্থায়ী হতে পারে।