ramayana

বাল্মীকির আগে লিখিত হয়েছিল ‘রামায়ণ’! কে লিখেছিলেন সেই মহাকাব্য

বাল্মীকি সামনেই দেবর্ষি নারদ জানান, তিনি এর চেয়েও উৎকৃষ্ট এক ‘রামায়ণ’-এর সন্ধান জানেন।

Advertisement
নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০২২ ০৮:২৩
Share:
০১ ১৬

এ কথা প্রায় সকলেই জানেন যে, ‘রামায়ণ’-এর রচয়িতা মহাকবি বাল্মীকি। কিন্তু এই মহাকাব্যের আদিকাণ্ডেই বলা হয়েছে যে, রামকথা বাল্মীকির কল্পনা থেকে জাত নয়। বরং ইক্ষ্বাকু বংশের রাজা রামচন্দ্রের জীবন ও কাহিনি সম্পর্কে অনেকেই অবগত ছিলেন। কবিত্বশক্তি লাভের পরে যখন বাল্মীকি কী নিয়ে কাব্য রচনা করবেন বলে ভাবছেন, তখন দেবর্ষি নারদ তাঁর সামনে আবির্ভূত হন। বাল্মীকি দেবর্ষিকে তাঁর সমস্যার কথা জানান।

০২ ১৬

বাল্মীকি নারদকে জানান যে, তিনি সর্ব সুলক্ষণযুক্ত এবং সর্বগুণান্বিত কোনও পুরুষকে কেন্দ্র করে এক মহাকাব্য রচনা করতে আগ্রহী। তেমন কোনও পুরুষের সন্ধান কি নারদ তাঁকে দিতে পারেন? এর উত্তরে নারদ তাঁকে ইক্ষ্বাকু বংশের রাজা রামচন্দ্রের কথা জানান। তিনি কয়েকটি মাত্র শ্লোকে রামচন্দ্রের কীর্তি বর্ণনা করে বলেন যে, এই সর্ব সুলক্ষণযুক্ত ও সর্ব গুণান্বিত পুরুষোত্তম সম্প্রতি একশো অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন করেছেন। কয়েক হাজার ব্রাহ্মণকে গাভী দান করেছেন এবং আরও অনেক সুকর্ম করেছেন। ধরাধামে ধর্ম প্রতিষ্ঠার কাজ শেষ হলে রামচন্দ্র ব্রহ্মলোকে ফিরে যাবেন। বাল্মীকি রামচন্দ্রের কাহিনিকে তাঁর কাব্যে অমর করে রাখতে পারেন।

Advertisement
০৩ ১৬

এই কাহিনি থেকে এটুকু বোঝা যায় যে, লিখিত হওয়ার আগে রামচন্দ্রের কাহিনি লোকমুখে প্রচলিত ছিল। কিন্তু তাকে মহাকাব্যের রূপদান করেন বাল্মীকিই। সে দিক থেকে দেখলে বাল্মীকিই ‘রামায়ণ’-এর রচয়িতা। কিন্তু ভারতীয় লোকসমাজে ‘রামায়ণ’ রচনা নিয়ে এক মধুর কাহিনি প্রচলিত রয়েছে, যেখানে বাল্মীকির ‘রামায়ণ’ রচনার আগেই রচিত এক ‘রামায়ণ’-এর সন্ধান পাওয়া যায়।

০৪ ১৬

জনশ্রুতিতে বহমান সেই কাহিনিটি এই রকম— ‘রামায়ণ’ রচনা শেষ করে বাল্মীকি তাঁর কাব্য দেবতাদের পাঠ করে শোনাতে আগ্রহী হন। ইন্দ্র, বরুণ, বায়ু, অগ্নি প্রমুখ দেবতা এবং গঙ্গা ও যমুনার মতো দেবী সেই কাব্য শুনে বিমোহিত হয়ে পড়েন এবং তাঁরা অবিমিশ্র প্রশংসা করতে থাকেন বাল্মীকির কবিত্বশক্তির।

০৫ ১৬

সেখানে দেবর্ষি নারদও উপস্থিত ছিলেন। তিনি কিন্তু প্রশংসায় অংশগ্রহণ করলেন না। তাঁর নীরবতা দেখে বাকিরা প্রশ্ন করেন। নারদ জানান, তিনি এর চেয়েও উৎকৃষ্ট এক ‘রামায়ণ’-এর সন্ধান জানেন।

০৬ ১৬

এ বার বাল্মীকির বিস্মিত হওয়ার পালা। তিনি নারদের কাছে জানতে চান, সেই ‘রামায়ণ’ কে রচনা করেছেন। নারদ খানিক টালবাহানার পরে জানান, সেই ‘রামায়ণ’-এর রচয়িতা আর কেউ নন, স্বয়ং মহাবীর হনুমান।

০৭ ১৬

তাঁর চেয়েও উৎকৃষ্ট ‘রামায়ণ’ রচয়িতার নাম শুনে মহাকবির চোখ কপালে। তাঁর রচনায় হনুমান এক বানর। তিনি মহাবীর, তিনি না থাকলে রামচন্দ্রের পক্ষে সীতাকে উদ্ধার করা আরও বেশি দুরূহ হত। মহাকপি ‘রামায়ণ’-এর অন্যতম প্রধান চরিত্র। কিন্তু তিনি যে কবিত্বশক্তির অধিকারী হয়ে তাঁর চেয়েও উৎকৃষ্ট কাব্য রচনা করবেন, এ কথা মহাকবি কিছুতেই মানতে পারছিলেন না।

০৮ ১৬

তাঁর ‘রামায়ণ’ রচনা যে সময় সমাপ্ত হয়, সেই সময়ে হনুমান ঠিক কোথায় অবস্থান করছেন, তা বাল্মীকি জানতেন না। তিনি নারদের কাছে পবনপুত্রের ঠিকানা জানতে চান। নারদ জানান, সীতার বরে অমরত্বপ্রাপ্ত হয়ে হনুমান হিমালয়ের পাদদেশে এক কদলীবনে বাস করছিলেন।

০৯ ১৬

তাঁর চেয়েও উৎকৃষ্ট ‘রামায়ণ’ কেমন হতে পারে, এ নিয়ে কৌতূহল ধরে রাখতে পারেননি বাল্মীকি। বহু ক্লেশ সহ্য করে পাহাড়-পর্বত পার হয়ে হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত সেই কদলীবনে এসে পৌঁছন বাল্মীকি। কিন্তু হনুমান তখন সেখানে ছিলেন না।

১০ ১৬

সেখানেই তিনি দেখতে পান পর্বতগাত্রে কী সব লেখা যেন খোদিত রয়েছে। বাল্মীকি সেগুলি পড়তে শুরু করেন এবং বুঝতে পারেন যে, রুক্ষ পাথরের গায়ে নখের আঁচড়ে কেউ সেই সব লিখেছেন। অচিরেই বাল্মীকি বুঝতে পারেন, সেই সব লিখনই আসলে হনুমানের লেখা ‘রামায়ণ’।

১১ ১৬

সেই ‘রামায়ণ’ পড়তে পড়তে বাল্মীকি আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়েন। তার কাব্যসুষমা এবং ছত্রে ছত্রে নিহিত ভক্তিরস তাঁকে আপ্লুত করে ফেলে। নিজের অজান্তেই আনন্দাশ্রু নেমে আসে মহাকবির দু’চোখ বেয়ে। তিনি বুঝতে পারেন, হনুমান রচিত ‘রামায়ণ’ একেবারেই ভিন্ন স্তরের এক মহাকাব্য। যেখানে ভক্তিরস ভাসিয়ে দিতে পারে পাঠককে। বাল্মীকি এ-ও বুঝতে পারেন যে, এই দিক থেকেই হনুমানের ‘রামায়ণ’ তাঁর ‘রামায়ণ’-এর চেয়ে অনেক বেশি হৃদয়গ্রাহী।

১২ ১৬

এমন সময় সেখানে আগমন ঘটে স্বয়ং হনুমানের। তিনি বাল্মীকিকে তাঁর অশ্রুমোচনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে মহাকবি তাঁকে জানান, তাঁর সারা জীবনের কাজকে বিসর্জন দিতে ইচ্ছা করছে হনুমানের ‘রামায়ণ’ পড়ে।

১৩ ১৬

হনুমান বাল্মীকিকে বললেন, এমন চিন্তা বৃথা। কারণ, তিনি ‘রামায়ণ’ রচনা করেছেন তাঁর আরাধ্য শ্রীরামচন্দ্রকে সদা স্মরণে রাখার জন্য। এ ‘রামায়ণ’ একান্ত ভাবেই তাঁর ব্যক্তিগত উপলব্ধির প্রকাশ। কিন্তু বাল্মীকির রচনা এক মহান কাব্য। যা রচিত হয়েছে এক বিশেষ দূরত্ব থেকে। সে কারণে যুগ যুগ ধরে মানুষ বাল্মীকির কাব্যই পড়বেন, হনুমানের রচনা নয়।

১৪ ১৬

এই বলে হনুমান তাঁর ‘রামায়ণ’ লেখা পর্বতটিকে উপড়ে ছুড়ে দিলেন দূরে। শতসহস্র যোজন পার হয়ে সেটি সমুদ্রে গিয়ে পড়ল। বাল্মীকি বিস্মিত হলেন এই কাণ্ডে। হনুমান তাঁকে জানালেন, এই ‘রামায়ণ’-এর আর কোনও প্রয়োজন নেই। কারণ, রামকথা তাঁর হৃদয়ে খোদিত হয়ে আছে।

১৫ ১৬

এই প্রচলিত কাহিনির অন্য একটি বয়ানকে এক গ্রন্থে তুলে ধরেছেন দেবদত্ত পট্টনায়ক। তিনি লিখেছেন, হনুমান তাঁর ‘রামায়ণ’ লিখেছিলেন কদলীপত্রে। বাল্মীকির কথায় তিনি সেই পাতাগুলিকে এক মুহূর্তে ধ্বংস করে ফেলেন। বাল্মীকিকে তিনি জানান, মহাকবি ‘রামায়ণ’ লিখেছেন নিজের অমরত্বের জন্য। মানুষ যাতে রামকথা পড়তে পড়তে তার রচয়িতাকে মনে রাখেন, সেটাই তাঁর অভিপ্রায়। কিন্তু হনুমান ‘রামায়ণ’ লিখেছেন শুধু মাত্র তাঁর প্রভু রামচন্দ্রকে মনে রাখতে। এর থেকে বেশি কিছু তাঁর চাওয়ার নেই।

১৬ ১৬

দেবদত্ত তাঁর বইয়ের শেষে জানিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত বিভিন্ন ‘রামায়ণ’-এর কথা। মহাকবি বাল্মীকির রচনা থেকে সেগুলি বহুলাংশেই আলাদা। কিন্তু প্রতিটি ‘রামায়ণ’-ই তার নিজস্ব মহিমায় ভাস্বর। সেই মহিমা রামচন্দ্রের কীর্তির মহিমা। কে তার লেখক, সে কথা কেউ মনে রাখেন না। কৃত্তিবাস থেকে তুলসিদাস, বাঁকুড়ার জগৎরাম-রামপ্রসাদ থেকে কোঙ্কন উপকূলের মৌখিক ঐতিহ্যে বহমান ‘রামায়ণ’ আসলে তার কাহিনি-সৌন্দর্যেই ভাস্বর। সে কাহিনি চিরায়ত। কবিদের নশ্বরতাকে অতিক্রম করে অমরত্ব প্রদান করে সেই কাহিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement