ঐশ্বর্য রাই বচ্চন নন। বার্বি সাজা কিয়ারা আডবাণী, ‘হীরামাণ্ডি’র অদিতি রাও হায়দারি কিংবা উর্বশী রওতেলা, জ্যাকলিন ফার্নান্দেজ, প্রীতি জিন্টাও নন। কান চলচ্চিত্রোৎসবে এ বছর এই সমস্ত ভারতীয় তারকাই উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তাঁদের টেক্কা দিয়ে ফরাসি চলচ্চিত্রোৎসবের সমস্ত আলোটুকু যেন নিজের দিকে টেনে নিলেন ন্যান্সি ত্যাগী— গ্ল্যামার দুনিয়া থেকে যোজন দুরে থাকা এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ভারতীয় কন্যা। এ এক অন্য সিন্ডারেলার গল্প।
ন্যান্সি উত্তরপ্রদেশের মেয়ে। ভাই এবং মাকে নিয়ে তাঁর ছোট্ট সংসার। দিনের বেশির ভাগ সময় সেলাইয়ের মেশিনের সামনে বসেই সময় কাটে। এ হেন ন্যান্সি কানে শুধু এলেনই না, ফরাসি চলোচ্চিত্রোৎসবের রেড কার্পেটে হইচই ফেলে দিলেন।
পোশাক থেকে শুরু করে ন্যান্সির সাজগোজ, ক্যামেরার সামনে আত্মবিশ্বাস, এমনকি কানের রেড কার্পেটে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তাঁর জবাব সবই এখন ভাইরাল।
অনেকেই বলছেন, বিশ্বমঞ্চে দেশের সংস্কৃতি আর সম্মানকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন ২৩ বছরের এই তরুণী।
নামে চলচ্চিত্রোৎসব হলেও কানের খ্যাতির কেন্দ্রে রয়েছেন আকর্ষণীয় পোশাকে রেড কার্পেটে হাঁটা দেশ-বিদেশের তারকারা। কানে প্রদর্শিত ছবির থেকে অনেক বেশি আলোচনা এবং সমালোচনা হয় এই তারকাদের পোশাক নিয়ে।
নিরাশ করেন না তারকারাও। দর্শকদের মন বুঝে প্রতি বছরই কানের লাল গালিচায় তাঁরা নিয়ে আসেন নতুন চমক। চলচ্চিত্রের পর্দায় যেমন পরতে পরতে নাটকীয়তা থাকে, কানের লাল গালিচায় তেমনই নাটকীয়তার প্রদর্শন হয় তারকাদের পোশাকে।
ন্যান্সি কানের লাল গালচের সেই সারকথা জানতেন। তাই ঠিক করেন, তিনিও এমন পোশাক পরবেন যাতে তারকাদের পাশে তাঁকে ফিকে না দেখায়। বরং ভিড়ের মধ্যেও আলাদা ভাবে নজরে পড়েন তিনি।
পড়লেনও। কানের রেড কার্পেটে ন্যান্সি হাজির হয়েছিলেন একটি পিচ গোলাপি গাউন পরে। দিল্লির সীলমপুর বাজার থেকে কেনা কাপড় নিজের হাতে সেলাই করে বানানো গাউন। যার নীচের অংশ গোলাপি জলপ্রপাতের মতো ছড়িয়েছিল কানের রেড কার্পেটে। সেই গাউন দেখে চমকে গেলেন কোটি কোটি ডলার খরচ করে ডিজাইনার পোশাক কেনা তাবড় তারকারাও।
ন্যান্সিকে দেখে ঝলসে উঠতে থাকল বিদেশি সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ বাল্ব। তবে ন্যান্সির সম্ভবত কানের লাল গালচে তখনই ছাড়ার ইচ্ছে ছিল না। ক্যামেরার আগ্রহ দেখে গালচের উপরেই তাঁর গাউনটিতে ছড়িয়ে বসে পড়েন তিনি।
তত ক্ষণে কানের রেড কার্পেটে সবার নজর ঘুরেছে ভারতীয় কন্যার দিকে। বিদেশি সাংবাদিকেরা এসে জানতে চাইছেন তাঁর পোশাকের কথা। ভরিয়ে দিচ্ছেন প্রশংসায়। ন্যান্সি সেই সব প্র্রশ্ন আর প্রশংসারই সপ্রতিভ জবাব দিলেন। তবে ইংরেজিতে নয়। ফরাসিতেও নয়। কানের রেড কার্পেটে বিদেশি সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাব একগাল হেসে চোস্ত হিন্দিতে উত্তর দিলেন ন্যান্সি।
ফ্রান্স যেমন তার খাবারের জন্য বিখ্যাত, তেমনই ফরাসি ফ্যাশনও বন্দিত বিশ্ব জুড়ে। সেই ফ্রান্সের সাংবাদিকেরা, যাঁরা ফরাসি ডিজাইনারদের ফ্যাশনে অভ্যস্ত, তাঁদের মুগ্ধতা দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলেন ন্যান্সিও। তবে বুঝতে দিলেন না। বললেন, আমার পোশাক আমি নিজেই তৈরি করেছি। ১০০০ মিটার কাপড় আর ৩০ দিন সময় লেগেছে এই পোশাক তৈরি করতে। ন্যান্সির ওই আত্মবিশ্বাসী এবং সপ্রতিভ হিন্দি জবাবে মুগ্ধ হয়েছে দেশ।
নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় হওয়া ন্যান্সি এক বছর আগে স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তিনি কানের রেড কার্পেটে গিয়ে হাজির হবেন।
বাড়িতে একমাত্র উপার্জনকারী মা। কারখানায় কাজ করতেন তিনি। ভোর থেকে সন্ধে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর যখন বাড়ি ফিরতেন, তখন তাঁর মাথা থেকে পা পর্যন্ত কালো হয়ে থাকত কয়লার গুঁড়োয়।
ন্যান্সিরা দুই ভাই-বোন। তাঁদের দু’জনকেই সাধ্যমতো পড়াশোনা করিয়েছিলেন মা। ন্যান্সির তাই লক্ষ্য ছিল একটাই। যে ভাবে হোক উপার্জন শুরু করে প্রথমে মাকে কারখানার কাজ থেকে নিষ্কৃতি দিতে হবে।
২০২০ সালে লকডাউনের সময় বাড়িতে বন্দি থাকাকালীন ফেলে দেওয়া কাপড় থেকে নানা রকম পোশাক বানিয়ে ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করতে শুরু করেন ন্যান্সি। সেই সব কাজ নেটাগরিকদের নজর কাড়ে। তাঁর সৃজনশীলতা মুগ্ধ করতে থাকে নেটাগরিকদের। বাড়তে থাকে অনুগামীর সংখ্যাও। উৎসাহী ন্যান্সি তাই তাঁর জামাকাপড় বানানোর শখ জারি রাখেন। তার ভিডিয়ো, ছবি পোস্টও করতে শুরু করেন। ইনস্টাগ্রাম প্রভাবী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন ন্যান্সি। সমাজমাধ্যমেই উপার্জনও শুরু করেন।
২০২৩ সালে মায়ের কারখানার কাজ বন্ধ করেন ন্যান্সি। ওই বছরই ঘুরে যায় তাঁর ভাগ্যের চাকাও। কানে প্রতি বছরই সমাজমাধ্যম প্রভাবীদের একটি বড় অংশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিভিন্ন প্রসাধন সংস্থা তাঁদের সেখানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। ন্যান্সিও তেমনই একটি সংস্থার হয়ে কান চলচ্চিত্রোৎসবে যাওয়ার সুযোগ পান।
শুরু হয় ন্যান্সির নিজেকে মেলে ধরার প্রস্তুতি। ন্যান্সি জানিয়েছেন, এত দিন অনেক গাউনই নিজে হাতে বানিয়েছেন তিনি। কাপড় কেনা থেকে শুরু করে সেই সব গাউনের সব কিছুই নিজে হাতে করেছেন। কিন্তু কানের প্রথম দিনের গাউন কেমন হওয়া উচিত তা তাঁকে বলে দিয়েছিলেন তাঁর ভাই।
ন্যান্সি জানিয়েছেন ভাইয়ের কথাতেই গোলাপি ঝরনার মতো দেখতে বিপুল দৈর্ঘ্যের ওই গাউন তৈরি করেছিলেন ন্যান্সি। তবে সেই গাউন ফ্রান্সে নিয়ে যেতে তার ঘাম ছুটে গিয়েছিল।
একটি গাউনেরই ওজন হয়েছিল ২৫ কেজি! তা-ও গাউনের কিছুটা অংশ সঙ্গে না নিয়ে যেতে পেরে বাড়িতেই রেখে গিয়েছিলেন ন্যান্সি। ২৩ বছরের ওই তরুণী জানিয়েছেন, কান চলচ্চিত্রোৎসবে তাঁর পরা তিনটি পোশাকের ওজন হয়েছিল প্রায় ৬০ কেজি। সেগুলিকে নিয়ে যেতেই অনেক টাকা দিতে হয়েছিল তাঁকে।
জীবনে এই প্রথম বিমানের বিজ়নেস ক্লাসেও সফর করলেন তিনি। ন্যান্সি কান থেকে ফিরে এসে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ‘‘দারুণ লাগছিল আমার। আগে কখনও বিজ়নেস ক্লাসে যাইনি। দিব্যি পায়ের উপর পা তুলে আরামে চলে এলাম। প্রচুর ছবি তুলেছি। রিল্স বানিয়েছি।’’
তবে কানে পৌঁছে আরও অনেক কিছুই নতুন হয়েছে তাঁর জীবনে। কানে তাঁর বাকি দু’টি পোশাকের একটি ছিল শাড়ি। অন্যটি কালো রঙের করসেট এবং স্কার্ট। দু’ মাস ধরে ওই তিনটি পোশাক বানিয়েছিলেন তিনি। সব ক’টি পোশাকই সমালোচকদের প্রশংসা কুড়োয়। তবে কানে ন্যান্সির সেরা প্রাপ্তি তারকাদের থেকে পোশাক বানিয়ে দেওয়ার অনুরোধ।
ন্যান্সি জানিয়েছেন, তাঁর তৈরি পোশাক দেখার পর সোনম কপূর তাঁকে অনুরোধ করেছেন পোশাক বানিয়ে দেওয়ার জন্য। আরও অনেকের কাছ থেকে আসছে অনুরোধ। তিনি এখন ভাবতেই পারছেন না এত অনুরোধ একা হাতে সামলাবেন কী করে!