ঝুঁকি নিয়েই বিপজ্জনক অভিযানের পরিকল্পনা করেছিল ইজ়রায়েল। নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন সিডস অফ সামার’, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘গ্রীষ্মবীজের অভিযান’। পরে অবশ্য সেই নাম বদলায়। অভিযানের নতুন নাম হয় ‘অপারেশন আর্নন’। আর্নন শব্দের অর্থ সূর্যের আলো।
দ্বিতীয় নামটিই অভিযানের উদ্দেশ্যের সঙ্গে মেলে। কারণ এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল শত্রুর গোপন ডেরা থেকে পণবন্দিদের মুক্ত করে আনা। অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরানো। ভাবা সহজ। কিন্ত এই অভিযানের পদে পদে ছিল প্রাণের ঝুঁকি। নিজেদের তো বটেই, যাঁদের বাঁচাতে যাওয়া, তাঁদেরও।
এক মাস আগে থেকে তিল তিল করে সাজানো হয়েছিল ছক। ভুল এড়াতে শত্রুপক্ষের নকল ঘাঁটি সাজিয়ে দিনরাত অভিযানের মহড়া দিয়েছিলেন কম্যান্ডোরা। অভিযানের আগের সাত দিন ধরে চলেছিল সেই মহড়া। কিন্তু এত কিছুর পরেও শেষকালে শত্রুঘাঁটিতে গিয়ে বদলে গেল সব অঙ্ক!
গত ৮ জুন প্যালেস্তাইনের সশস্ত্র সংগঠন হামাসের খাসতালুক গাজ়ায় ওই অভিযান চালায় ইজ়রায়েলের জাতীয় সন্ত্রাস মোকাবিলা বাহিনী ইয়ামাম। তাদের সাহায্য করতে ওই অভিযানে যোগ দিয়েছিল ইজ়রায়েলের নিরাপত্তা সংস্থা সিন বেট, ইজ়রায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী, এমনকি আমেরিকার গোয়েন্দারাও।
৮ জুন সেই অভিযানের পরে গাজ়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রক একটি বিবৃতি দিয়ে জানায়, গাজ়ার বুকে হওয়া নজিরবিহীন এবং ন্যক্কারজনক ঘটনা ওই অভিযান।
কারণ ওই অভিযানে প্রাণ হারান গাজ়ার ২৭৬ জন সাধারণ মানুষ। গুরুতর জখম হন আরও ৬৯৮ জন। যাঁদের অধিকাংশই এই সংঘর্ষের সঙ্গে কোনও ভাবে জড়িত ছিলেন না বলে দাবি হামাসের।
গত শনিবার, অর্থাৎ ৮ জুন সকালে গাজ়ার নুসেইরত শরণার্থী শিবির এলাকার বাজারে বেরিয়েছিলেন সেখানকার মানুষজন। চলছিল নিত্য কেনাকাটা। তাঁরা ভাবতেই পারেননি, হামাসের কৃতকর্মের গুনাগার প্রাণ দিয়ে চোকাতে হবে তাঁদের।
গাজ়ার সীমান্ত থেকে অনেকখানি ভিতরে নুসেইরত শরণার্থী শিবির। চারপাশ বাজারে ঘেরা। আমেরিকার গোয়েন্দারা খবর পেয়েছিলেন, ইজ়রায়েল থেকে নিয়ে আসা বন্দিদের এখানেই লুকিয়ে রেখেছে হামাস। এঁদের মধ্যে হামাসের হাতে অপহৃত ২৬ বছরের এক ইজ়রায়েলি তরুণীও আছেন। যাঁর নাম নোয়া আরগামানি।
আট মাস আগে নোয়াকে ইজ়রায়েলের একটি গানের অনুষ্ঠান থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায় হামাস। তারিখটি ছিল ৭ অক্টোবর, ২০২৩। ওই দিনই হামাস হামলা করেছিল ইজ়রায়েলে। গাজ়া থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে রকেট এসে পড়েছিল দক্ষিণ ইজ়রায়েলে।
সে দিনই ইজ়রায়েলের ওই গানের অনুষ্ঠানো উপস্থিত ছিলেন নোয়া। হামাসের একটি দলকে দেখা গিয়েছিল ওই তরুণীকে টেনে-হেঁচড়ে বাইকের পিছনে বসিয়ে চম্পট দিতে। একটি ভিডিয়োয় ধরা পড়েছিল সেই দৃশ্য। যেখানে আতঙ্কিত নোয়াকে চিৎকার করে বলতে শোনা যাচ্ছিল, ‘‘প্লিজ় আমায় মেরে ফেলো না!’’
সেই চিৎকার আর আতঙ্কের মুখ একটা সময়ে হামাসের হাতে পণবন্দি ২৫১ জন ইজ়রায়েলির প্রতিভূ হয়ে উঠেছিল। হামাসও মাঝেমধ্যে নোয়ার ভিডিয়ো প্রকাশ করে ভয় দেখাতে শুরু করে ইজ়রায়েলকে। যুদ্ধ বিশেষজ্ঞেরা বলেছিলেন, এটা আসলে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ। নোয়াকে দিয়ে ইজ়রায়েলের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে চাইছে প্যালেস্তাইনে সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। ইজ়রায়েল সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে।
তত দিনে নোয়ার বাবা-মা মেয়েকে বাঁচানোর জন্য সরকারের বিভিন্ন দফতরের ঘুরে ফেলেছেন। নোয়া ইজ়রায়েলের বাসিন্দা হলেও জন্মসূত্রে চিনের সঙ্গে যোগ আছে। তাই চিনের দূতাবাসেরও সাহায্য চেয়েছিলেন তাঁরা। শেষে আমেরিকার সরকারকে চিঠি লেখেন নোয়ার মা।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে নোয়ার মা জানান, তিনি ব্রেন ক্যানসারের রোগী। মৃত্যুর আগে মেয়ে নিরাপদ আছে জেনে যেতে চান। মেয়েকে সামনে থেকে দেখতে চান। নোয়ার মায়ের সেই আর্জিতেই সম্ভবত নড়েচড়ে বসে আমেরিকা। উদ্যোগী হয় ইজ়রায়েলও। ঠিক হয় নোয়া-সহ গত ৭ অক্টোবর ইজ়রায়েলের অনুষ্ঠান থেকে যাঁদের তুলে নিয়ে গিয়েছিল হামাস, তাদের মুক্ত করা হবে।
কয়েক হাজার সেনা, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, ইজ়রায়েলের গোয়েন্দাবাহিনীর থেকে পাওয়া তথ্যের পাশাপাশি আমেরিকা সাহায্য করে ড্রোনে তোলা ভিডিয়ো ফুটেজ, ডিজিটাল তথ্য বিশ্লেষণ এবং পণবন্দিদের কেথায় রাখা হয়েছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে।
৮ জুন সকালে শুরু হয় অভিযান। প্যালেস্তানীয় শরণার্থী সেজে নুসেইরতে এসে পৌঁছন ইজ়রায়েলের স্পেশ্যাল ফোর্সের কিছু অফিসার। গাড়ির মাথায় তোশক, বালিশ, গদি চাপিয়ে তাঁরা সেখানে পৌঁছন। স্থানীয় বাসিন্দাদের জানান, তাঁরা রাফা থেকে আসছেন।
প্যালেস্তাইনের সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী বাহিনীর বাকিরা শরণার্থী শিবিরে পৌঁছন ত্রাণসামগ্রীর ট্রাকে বিদেশ থেকে আসা ত্রাণকর্মী হিসাবে। এ ছাড়া একটি বাণিজ্যিক ট্রাক এবং আসবাবে বোঝাই গাড়িতে আসেন বাকিরা।
নুসেইরতে ২০০ মিটারের দূরত্বে দু’টি বহুতলে শুরু হয় অভিযান। এই দু’টি বহুতলেরই বাসিন্দা দুই পরিবারের জিম্মায় রাখা হয়েছিল নোয়া-সহ চার পণবন্দিকে।
গোয়েন্দারা জানতে পেরেছিলেন নোয়াকে যেখানে রাখা হয়েছে সেই পরিবারের তিন সদস্যই পুরুষ। এ ছাড়া সেখানে হামাসের সশস্ত্র রক্ষীরাও নজর রাখেন সর্ব ক্ষণ। বাকি তিন পুরুষ পণবন্দিকে রাখা হয়েছিল এক চিকিৎসকের কাছে। সেই চিকিৎসকের পুত্র পেশায় সাংবাদিক হলেও এক সময়ে হামাসদের মুখপাত্র ছিলেন।
বেলা ১১টা নাগাদ ইয়ামাম এবং শিন বেটের স্পেশ্যাল অফিসারেরা নুসেইরত শিবিরের কেন্দ্রে এই দুই বহুতলে প্রবেশ করেন। নোয়ার রক্ষকদের চোখে ধুলো দিয়ে সন্তর্পণে তাঁকে বার করে আনতে সমর্থ হয় স্পেশ্যাল ফোর্স।
কিন্তু তিন পুরুষ পণবন্দিকে মুক্ত করতে গিয়ে আচমকা শুরু হয় গুলির লড়াই। কয়েক মুহূর্তে বদলে যায় পরিস্থিতি। গাজ়ার ওই এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, আচমকাই নুসেইরতের আকাশে উড়ে আসে বিমান। শুরু হয় গুলি, বোমা বৃষ্টি।
কেউ কেউ জানিয়েছেন তাঁরা ১০ মিনিটের মধ্যে শ দেড়েক রকেট পড়তে দেখেন নুসেইরতের বাজার এলাকায়। মুহূর্তে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় গোটা এলাকা। এর মধ্যেই পণবন্দিদের নুসেইরত থেকে বার করে আনেন ইজ়রায়েল বাহিনীর অফিসারেরা। কোনও মতে হামাসের আক্রমণ প্রতিহত করে বিমানে করে উড়িয়ে নিয়ে যায় তাঁদের।
কিন্তু তত ক্ষণে গাজ়ার নুসেইরতে শুরু হয়েছে অবিরাম গুলি, বোমা বর্ষণ। প্যালেস্তানীয় সংবাদপত্রকে শরণার্থী শিবিরের এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, ‘‘মনে হচ্ছিল কোনও ভয়ের সিনেমা দেখছি।’’ ওই রিপোর্টে এ-ও বলা হয়েছে, ইজ়রায়েলের যুদ্ধবিমান রাত পর্যন্ত চক্কর দিয়েছে এলাকায়। ঘরের বাইরে বেরোলেই ড্রোনচালিত রাইফেল গুলিবর্ষণ করেছে নির্বিচারে।
অভিযান শেষে নোয়া তাঁর বাড়িতে ফিরেছেন। ইজ়রায়েলের বিমানবন্দরে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বাবার আদর করার ছবি ভাইরাল হয়েছে। কিন্তু এর জন্য প্রাণ দিয়ে দাম দিতে হল ২৭৬ জন প্যালেস্তিনীয়কে। যাঁদের মধ্যে রয়েছে ৬৪টি শিশু এবং ৫৭ জন মহিলা।
পণবন্দিদের মুক্ত করার উদ্দেশ্যে এই অভিযান হলেও সেই উদ্দেশ্যই এখন সমালোচনার মুখে পড়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, আকাশপথে গুলিবর্ষণ করার প্রয়োজন কি আদৌ ছিল? আরও একটু দায়িত্ববান হওয়ার প্রয়োজন কি ছিল না? এতগুলি প্রাণ নষ্ট হওয়ার পরে কি এই অভিযানকে সত্যিই সফল বলা চলে? তবে যুক্তিবিদদের একাংশ বলছেন, হামাস যদি প্রথমে হামলা না চালাত, তবে এই দিন দেখার প্রয়োজনই পড়ত না।