মধ্য এশিয়ার জটিল খনিজ (ক্রিটিক্যাল মিনারেল) এবং বিরল ভূ উপাদানের (রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস্) উপর পড়েছে আমেরিকার নজর। কৌশলে সেগুলি হস্তগত করার ফন্দি আঁটছে যুক্তরাষ্ট্র। আর সেই লক্ষ্যে উজবেকিস্তানে পা জমানোর চেষ্টা চালাচ্ছে ওয়াশিংটন। আটলান্টিকের পারের মহাশক্তিধরের এই পদক্ষেপ বিশ্ব রাজনীতির সমীকরণ বদলাতে পারে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
ওয়াশিংটনের রাডারে উজ়বেকিস্তান চলে আসার অন্যতম প্রধান কারণ হল এর জটিল খনিজ সম্পদের ভান্ডার। ইতিমধ্যেই সেগুলির অনুসন্ধান এবং উত্তোলন সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক (মউ) চুক্তি তাসখন্দের সঙ্গে সম্পন্ন করেছে আমেরিকা। এ ব্যাপারে বেশ কয়েকটি উচ্চ পর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও হয়েছে।
২০২৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর উজ়বেক ভূতাত্ত্বিক মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী ওমনুল্লো নাসরিতদিনক্সোদজায়েভ সঙ্গে মউ চুক্তিতে সই করেন তাসখন্দের আমেরিকান রাষ্ট্রদূত জোনাথন হেনিক। পরে এই ইস্যুতে বিবৃতি দেয় ওয়াশিংটন। সেখানে বলা হয়েছে, ‘‘বিশ্বের খনিজ সরবরাহে শৃঙ্খলা এবং বৈচিত্র্য আনতে এই চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। এর মাধ্যমে রক্ষা পাবে মধ্য এশিয়ার অনন্য বাস্তুতন্ত্র।’’
অন্য দিকে উজ়বেক সরকার জানিয়েছে, খনিজ সম্পদ উত্তোলন এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের পরিকাঠামো উন্নয়নে সাহায্য করবে আমেরিকা। যৌথ ভাবে নতুন নতুন এলাকায় খনিজ সম্পদের অন্বেষণ চালানো হবে। গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) নভেম্বরে ‘কৌশলগত অংশীদারিত্বে’র বিষয়ে ওয়াশিংটন এবং তাসখন্দের মধ্যে হয়েছে ইতিবাচক আলোচনা।
‘খনিজ সুরক্ষা অংশীদার’ (মিনারেল সিকিউরিটি পার্টনারশিপ) সংগঠনের অন্যতম সদস্য হল উজ়বেকিস্তান। এই সংস্থার মূল উদ্দেশ্য জটিল খনিজের সরবরাহের ক্ষেত্রে সমন্বয় সাধন। বর্তমানে দূষণ নিয়ন্ত্রণে সবুজ শক্তির দিকে ঝুঁকেছে বিশ্ব। পাশাপাশি দুনিয়ার ঘটেছে ডিজ়িটাল রূপান্তর। দু’টি ক্ষেত্রেই জটিল খনিজ উপাদানের ভূমিকা অপরিসীম।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয়ান ইউনিয়ানের (ইইউ) দেশগুলি ‘খনিজ সুরক্ষা অংশীদার’ সংগঠনের সদস্য। বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, আমেরিকা মধ্য এশিয়ার দেশটির জটিল খনিজ সম্পদের দখল নিতে পারলে আখেরে লাভ হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের। তখন ওয়াশিংটনের হাত ঘুরে খুব সহজেই ওই খনিজ পৌঁছবে সেখানকার দেশগুলিতে।
উজ়বেকিস্তান ছাড়া মধ্য এশিয়ার জটিল খনিজ সমৃদ্ধ দেশ হল কাজ়াখস্তান। ওয়াশিংটনের সেখানেও বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) ফেব্রুয়ারিতে সি৫+১-এর মতো জটিল খনিজ উপাদানের উত্তোলন নিয়ে সেখানকার সরকারের সঙ্গে কথা বলেন যুক্তরাষ্ট্রের পদস্থ কর্তারা। যদিও আলোচনা এখনও অনেক দূর এগিয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়নি।
সূত্রের খবর, মধ্য এশিয়ার অন্তত পাঁচটি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করতে চাইছে আমেরিকা। ওয়াশিংটনের যুক্তি, এতে বিশ্ব জুড়ে জটিল খনিজ সরবরাহের শৃঙ্খল অনেকটাই মজবুত হবে। পাশাপাশি, কয়েক গুণ বাড়ানো যাবে সবুজ শক্তির ব্যবহার। অন্য দিকে এতে শক্তিশালী হবে মধ্য এশিয়ার অর্থনীতিও।
এই ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রই যে আগ বাড়িয়ে পদক্ষেপ করেছে, এমনটা নয়। গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) এপ্রিল মাসে তাসখন্দের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারকে (মউ) সই করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সেখানে জটিল খনিজ কাঁচামাল নিয়ে কৌশলগত অংশীদারিত্বের কথা বলা রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এর পর উজ়বেকিস্তান-ইইউ সম্পর্কের সমীকরণ অনেকটাই বদলেছে।
সমতল মরভূমির দেশ উজ়বেকিস্তানের মাটির গভীরে মজুত রয়েছে পর্যান্ত গ্যাস এবং অপরিশোধিত তেল। জটিল খনিজের মধ্যে সেখানে মেলে জার্মেনিয়াম এবং সিলিকন। এ ছাড়া বিশ্বের প্রথম ১০টি ইউরেনিয়াম, রেনিয়াম এবং টেলুরিয়াম সমৃদ্ধ দেশের তালিকায় নাম রয়েছে উজ়বেকিস্তানের।
২০১৮ সালে উজ়বেকিস্তানের জটিল খনিজ এবং বিরল ভূ উপাদান সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে আমেরিকার ভূতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ বিভাগ (ইউএস জ়িওলজিক্যাল সার্ভে)। সেখানে বলা হয়েছে দেশটির মাটির নীচে বিপুল পরিমাণ তামা জমা রয়েছে। মলিবডেনাম এবং ক্যাডমিয়ামের মতো খনিজ সম্পদের নিরিখে বিশ্বের প্রথম ২০টি দেশের মধ্যে রয়েছে এর নাম।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূ বিজ্ঞানীরা জটিল খনিজ এবং বিরল ভূ উপাদান সমৃদ্ধ উজ়বেকিস্তানের অন্তত ৮৭টি জায়গাকে চিহ্নিত করেছেন। ২০২৩ সালে ভূতাত্ত্বিক শিল্পে ১,১০০ ডলার বিনিয়োগ পেয়েছে তাসখন্দ। এই অঙ্ক আরও বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা।
তবে মধ্য এশিয়ার দেশটিতে পা জমানো ওয়াশিংটনের পক্ষে মোটেই সহজ নয়। কারণ, গত কয়েক বছরে তাসখন্দের চিনা নির্ভরতা বেশ কিছুটা বেড়েছে। এর ফলে ধীরে ধীরে উজ়বেকিস্তানের উপর প্রভাব বিস্তার করা শুরু করেছে বেজিং। সেখান থেকে দেশটিকে বার করে আনা যথেষ্টই কঠিন।
দ্বিতীয়ত, উজ়বেকিস্তানের উপর রুশ প্রভাবও কম নয়। ১৯২০ সালে মধ্য এশিয়ার দেশটিকে পুরোপুরি কব্জা করে ফেলে মস্কো। ১৯২৪ সালের ২৭ অক্টোবর সেখানে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী প্রায় সাত দশক ধরে তা বজায় ছিল।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে গেলে উজ়বেকিস্তান স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু তার পরেও রুশ ছায়া পুরোপুরি গা থেকে মুছে ফেলতে পারেনি তাসখন্দ। বরাবরই মস্কোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলে উজ়বেক সরকার।
উজ়বেকিস্তানের জটিল খনিজ সম্পদ আমদানির উপর নজর রয়েছে ভারতেরও। কিন্তু মাঝে পাকিস্তান থাকায় স্বাধীনতার পর লম্বা সময় ধরে মধ্য এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে সে ভাবে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি নয়াদিল্লি। বর্তমানে ইরানের মধ্যে দিয়ে সেখানে পৌঁছচ্ছে এ দেশের সামগ্রী। প্রসঙ্গত, মধ্য এশিয়ার দেশটির সঙ্গে ভারতীয় ইতিহাসের নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। সেখান থেকেই এ দেশে আসেন প্রথম মোগল বাদশা বাবর।
মধ্য এশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের লক্ষ্যে পারস্য উপসাগরের তীরে ইরানের চাবাহার বন্দরটি তৈরি করেছে ভারত। এই সমুদ্রবন্দর থেকে মুম্বইয়ের দূরত্ব খুব বেশি নয়। উজ়বেকিস্তান এবং কাজ়াখস্তানের মতো দেশগুলি থেকে পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমানে এই রুটটি ব্যবহার করছে নয়াদিল্লি।
পাশাপাশি, সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজ়েশন বা এসসিও) সদস্যপদ রয়েছে ভারত এবং উজ়বেকিস্তানের। এই সংগঠনের মাধ্যমেও মধ্য এশিয়ার দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করছে নয়াদিল্লি।