জিমে তো বটেই, আজকাল স্বাস্থ্যসচেতন অনেকের ঘরেও ঠাঁই পেয়েছে ট্রেডমিল। শরীরচর্চার অঙ্গ হিসাবে অনেকের কাছে তা অপরিহার্য। তবে এক কালে জেলবন্দিদের উপর অত্যাচারের যন্ত্র হিসাবেও ব্যবহৃত হত ট্রেডমিল। ফিরে দেখা যাক এ যন্ত্রের গোড়ার কথা।
আপাত ভাবে মনে হতে পারে যে, আজকাল ট্রেডমিলের চলন বেড়েছে। তবে ইতিহাস ঘাঁটলে উল্টো তথ্য মিলবে। বহু যুগ ধরেই এটি নানা কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। ট্রেডমিলের গোড়ার কথা বলতে গেলে ফিরে যেতে হয় রোম সাম্রাজ্যের সময়কালে।
ট্রেডমিল নয়, গোড়ার দিকে এই যন্ত্রটি পরিচিত ছিল ট্রেডহুইল নামে। সে সময় অর্থাৎ প্রথম শতকের শেষের দিকে তখন রোম সাম্রাজ্যের রমরমা। তখনকার দিনে অবশ্য শরীরচর্চা করতে নয়, ভারী জিনিসপত্র তুলতে ব্যবহার করা হত ট্রেডহুইল।
ভারী জিনিসপত্র তোলার ক্রেনজাতীয় যন্ত্রে কপিকলের বদলে ট্রেডহুইল ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন রোমানরা। এতে সে ধরনের জিনিসপত্র তোলাটা বেশ সহজ হয়ে ওঠে। ট্রেডহুইলের ব্যাস এতটাই বড় ছিল যে তাতে আস্ত মানুষ ঢুকে পড়তে পারতেন। এ ভাবে কম সংখ্যক শ্রমিক দিয়ে বেশি ওজনের জিনিসপত্র তোলায় সুবিধা হত।
অষ্টাদশ শতকে কৃষকদের হাতে বড় ‘অস্ত্র’ হয়ে উঠেছিল ট্রেডমিল। সে সময় স্থবির মেশিনপত্র চালাতে বায়ু বা জলবাহিত শক্তির বদলে ট্রেডমিলের ব্যবহার শুরু হয়েছিল।
আঠারোশো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ঘর-গেরস্থালির কাজেও ট্রেডমিলের প্রবেশ ঘটে গিয়েছিল। তবে আকারে তা ছিল বেশ ছোট। কুকুর, ভেড়া, ছাগলের মতো গৃহপালিতদের দিয়ে চালানো হত ট্রেডমিল। ঘরের চৌহদ্দিতে মাখন তৈরি করা, দুধ থেকে ক্রিম আলাদা করতে বা পাথর ভাঙার কাজেও লাগানো হত ট্রে়ডমিলকে।
ঘরের চার দেওয়াল ছেড়ে ট্রেডমিল পা়ড়ি দিয়েছিল জেলের কুঠুরিতেও। ভিক্টোরীয় যুগে ব্রিটিশ উদ্ভাবক তথা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার উইলিয়াম কুবিট প্রথম সে ধরনের ট্রেডমিলের জন্ম দিয়েছিলেন। সেটি ছিল ১৮১৮ সাল।
একসময় জেলবন্দিদের উপর অত্যাচার চালানোর অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল ট্রেডমিল। বন্দিদের এতে চাপিয়ে তার মাধ্যমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা উৎপাদনশীল কাজে লাগানো হত।
কারাগারে ভুট্টার দানার পেষাই করতে বা জলের পাম্প চালাতে যে শক্তির প্রয়োজন, তা পাওয়া যেত এই ট্রেডমিল থেকেই। এবং সে শক্তি উৎপন্ন করতে কাজে লাগানো হত জেলবন্দিদের। মূলত, তাঁদের শাস্তির অঙ্গ হিসাবে ট্রেডমিল চালানোও ছিল।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, আইরিশ কবি তথা নাট্যকার অস্কার ওয়াইল্ডকেও ট্রেডমিলের ঘানি টানানো হয়েছিল। সমকামিতার ‘অপরাধে’ বছর দুয়েক জেলে থাকার সময় শাস্তি হিসাবে তাঁকে ট্রেডমিল চালাতে হত। বস্তুত, জেলের সেই শাস্তির অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে পারেননি ওয়াইল্ড। মাত্র ৪৬ বছরে মৃত্যু হয় তাঁর।
শেষমেশ জেলবন্দিদের এই কড়া শাস্তির হাত থেকে মুক্তি মিলেছিল। ১৮৮৯ সালের দ্য প্রিজনস অ্যাক্টের আওতায় কয়েদিদের ট্রেডমিল চালানো নিষিদ্ধ করেছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। যদিও তার বদলে কয়েদিদের গঠনমূলক উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো শুরু হয়েছিল।
ট্রেডমিলের আধুনিক রূপ দেখা গিয়েছিল ১৯৫২ সালে। সে বছর রবার্ট ব্রুস নামে আমেরিকার ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কার্ডিওলজিস্টের গবেষণার সুফল পেয়েছিল গোটা দুনিয়া। হৃদ্যন্ত্রের নানা রোগ এবং পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে সহকর্মী ওয়েন কুইনটনের সঙ্গে মিলে একটি ট্রেডমিলের সাহায্য নিয়েছিলেন ব্রুস।
ব্রুসের গবেষণাটি পরিচিত ব্রুস প্রোটোকল নামে। হৃদ্যন্ত্রের কাজকর্ম খতিয়ে দেখতে যা আজও কাজে লাগানো হয়। বস্তুত, ব্রুসকে কার্ডিও ব্যায়ামের জনক বলে মনে করেন অনেকে।
ট্রেডমিলের রূপে আরও বদল আসে গত শতকে। ষাট-সত্তরের দশকে বিল স্টাবের সঙ্গে মিলে কেনেথ কুপার নামে এক চিকিৎসক প্রথম শরীরচর্চার যন্ত্র হিসাবে এটিকে বাজারে ছাড়েন। জিম থেকে আমজনতার ঘরে ঘরে অ্যারোবিক ব্যায়ামের যন্ত্র হিসাবে পৌঁছে যায় ট্রেডমিল!
ভারিক্কি চেহারা থেকে হালকা ওজনের ছিমছাম চেহারা পেতে বেশ কিছু কাল অপেক্ষা করতে হয়েছে ট্রেডমিলকে। ১৯৯১ সালে লাইফ ফিটনেস নামে এক সংস্থার তৈরি ট্রেডমিলের ৯৫০০এইচআর মডেলের যন্ত্রাংশ জুড়তেই পেরিয়ে যেত সপ্তাহখানেক। তবে আজকাল অবশ্য ট্রেডমিল ব্যবহারে তেমন ঘাম ঝরাতে হয় না।