হ্যালোউইনের আগে বিপর্যয় নেমে এসেছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। উৎসবের শহরে গিজগিজে ভিড় প্রাণ কেড়েছে শতাধিক মানুষের। পদপিষ্ট হয়ে পথেই মারা গিয়েছেন অন্তত ১৫১ জন। আহত আরও অনেকে।
দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী শহর সোলে ‘ভূতের উৎসব’ হ্যালোউইন ডেকে এনেছে এই মর্মান্তিক বিপর্যয়। যার ছবি দেখে শিউরে উঠেছে গোটা বিশ্ব। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে সমবেদনা জানিয়েছেন রাষ্ট্রনেতারা। কিন্তু কী ভাবে ঘটল এমন বিপর্যয়?
হ্যালোউইন ৩১ অক্টোবর, সোমবার। তার আগে সোলের রাস্তায় ঘুরতে বেরিয়েছিলেন উৎসবমুখর মানুষ। কিছু ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে প্রকাশ্যে এসেছে। যদিও সেই ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন। তবে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তরফে দাবি করা হয়েছে, এই ভিডিয়ো সোলের ওই গলিরই। ভিডিয়োগুলিতে দেখা যাচ্ছে, নতুন জামাকাপড় পরে রাস্তায় বেরিয়েছে জনতা। এক লহমায় ভিডিয়োটি দেখলে বড়দিনের পার্ক স্ট্রিট বলে ভুল হতে পারে।
কোভিড অতিমারির পর সোলে এ বছর বড় করে হ্যালোউইন উদ্যাপনের আয়োজন করা হয়েছিল। আনন্দে সামিল হতে শহরে জড়ো হয়েছিলেন অন্তত হাজার দশেক মানুষ। সেখানেই বিপত্তি।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের দাবি, সোলের আইটেওন জেলায় একটি বাজারে শনিবার অনেক মানুষ কেনাকাটায় ব্যস্ত ছিলেন। আশপাশের পাব এবং বারগুলিতেও জড়ো হয়েছিলেন অনেকে। প্রায় লক্ষ লোকের ভিড় হয়েছিল হ্যামিলটন হোটেলের সামনের রাস্তাটিতে।
সূত্রের খবর, রাজধানী শহরের প্রাণকেন্দ্রে যে রাস্তায় শনিবার রাতে শতাধিক মানুষ মারা গিয়েছেন, সেই রাস্তাটি বেশ সঙ্কীর্ণ। মাত্র ৪ মিটার চওড়া সে গলি দেখে বেনারসের সরু অলিগলির কথা মনে পড়ছে অনেকের। যে সঙ্কীর্ণ পথ বেয়ে এগিয়েছিল সত্যজিতের ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর কাহিনি।
সোলের ৪ মিটার চওড়া রাস্তাটিতে শনিবার রাতে ১ লক্ষ মানুষের ভিড় হয়েছিল বলে দাবি। সেই সঙ্গে হ্যামিলটন হোটেল থেকে বহির্মুখী জনতা এবং আইটেওন সাবওয়ে স্টেশন থেকে এক দল মানুষ ভিড়ের মাঝে পড়ে গিয়েছিলেন।
ভিড়ের চাপ ক্রমশ বাড়তে থাকলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন মানুষ। আর তাতেই ঘটে বিপত্তি। অনেকে রাস্তাতেই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন।
সোলের রাস্তায় উৎসবের উদ্যাপনে যাঁরা শনিবার জড়ো হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগেরই বয়স তিরিশের নীচে। মূলত তরুণ প্রজন্মই মর্মান্তিক বিপর্যয়ের সাক্ষী থেকেছে।
সোল থেকে যে ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে দেখা গিয়েছে সরু এক ফালি রাস্তা মানুষের ভিড়ে কী ভাবে গিজগিজ করছে। তিলধারণেরও জায়গা ছিল না সেই গলিতে।
রাস্তার ধারে মৃতদেহের স্তূপ জমা হয়ে গিয়েছিল এক সময়। এ ছাড়া, ভিড়ের মাঝে কেউ অসুস্থদের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করছিলেন, কেউ রাস্তায় শুয়ে থাকা ব্যক্তির কৃত্রিম শ্বাসকার্য চালানোর চেষ্টা করছিলেন, সবই ধরা পড়েছে ক্যামেরায়।
একটি ভিডিয়োতে দেখা গিয়েছে, ভিড় থেকে বাঁচতে কেউ কেউ রাস্তার ধারের দেওয়াল বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করছেন। পথে সকলের মুখেই আতঙ্কের ছাপ ছিল স্পষ্ট।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে এক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান অনুযায়ী, ‘‘আমি একটি বারে বসেছিলাম। আমার বন্ধু ফোন করে জানায়, বাইরে সাংঘাতিক কিছু ঘটছে। আমি বাইরে বেরিয়ে দেখি রাস্তায় লোকজন অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। তাঁদের কৃত্রিম ভাবে শ্বাস প্রক্রিয়া সচল রাখার চেষ্টা চলছে।’’
বিপর্যয়ের খবর পেয়ে উদ্ধারকাজে হাত লাগায় প্রশাসন এবং স্থানীয় মানুষ। প্রাথমিক চিকিৎসার মাধ্যমে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করা হয় অনেকের। যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁদের দেহ চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় রাস্তাতেই।
স্থানীয়দের দাবি সোলের ওই এলাকায় উৎসবের দিন ভিড় থাকেই। শহরের প্রাণকেন্দ্রে উৎসব পালনের জন্য অনেকে জড়ো হন। কিন্তু শনিবারের মতো বিপর্যয় আগে কখনও দেখা গিয়েছিল বলে মনে করতে পারছেন না কেউ।
দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি ইউন সুক-ইওল রবিবার সকালে জাতীয় শোক ঘোষণা করেছেন। তিনি এ-ও জানিয়েছেন, শনিবার রাতের ঘটনায় যাঁরা আহত, তাঁদের চিকিৎসার ভার বহন করবে সরকার। মৃতদের সৎকারের ব্যবস্থাও হবে সরকারি উদ্যোগে।
ইউন বলেছেন, ‘‘সোলের প্রাণকেন্দ্রে শনিবার যা হয়েছে, তা হওয়ার কথা ছিল না।’’ দেশের এমন ঘটনায় গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, রাস্তায় সকলের দাঁড়ানোর জায়গা হচ্ছিল না। মানুষ এক জন আর এক জনের উপর উঠে পড়েছিলেন। সমাধির মতো দেখাচ্ছিল তাঁদের অবস্থান। কেউ কেউ সংজ্ঞা হারাচ্ছিলেন। কাউকে দেখে মৃত বলেই মনে হচ্ছিল।
হ্যালোউইনের আগে সোলের এই ট্র্যাজেডি অনেক দিন পর্যন্ত তাড়া করবে দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষকে, দাবি পর্যবেক্ষকদের। সব ছবি রয়টার্স এবং টুইটার থেকে নেওয়া।