দ্য ব্ল্যাক ডালিয়া। কোনও ফুল নয়, এটি আমেরিকার ইতিহাসে অন্যতম ভয়ঙ্কর এবং নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নাম। ২২ বছরের তরুণীকে নৃশংস ভাবে কে বা কারা খুন করেছিল, আজও তা জানা যায়নি। সে দেশের পুলিশ থেকে শুরু করে দুঁদে গোয়েন্দা, সকলের রাতের ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিল ব্ল্যাক ডালিয়া।
লস অ্যাঞ্জেলসের বাসিন্দা এলিজাবেথ শর্টস। ১৯৪৭ সালের ১৫ জানুয়ারি তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার হয় স্থানীয় একটি উদ্যান থেকে। খোলা মাঠের মাঝে রক্তশূন্য অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছিল এলিজাবেথের দেহ।
এলিজাবেথের দেহ কোমর থেকে কেটে দু’ভাগে ভাগ করেছিল খুনি। বার করে এনেছিল নাড়িভুঁড়ি। ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাঁর মুখও ভয়ানক ভাবে বিকৃত করে দেওয়া হয়েছিল।
এলিজাবেথের ঠোঁটের দু’দিকের ধার থেকে দুই কান পর্যন্ত এমন ভাবে কেটে দেওয়া হয়েছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল মৃত্যুর পরেও তিনি হাসছেন। আকর্ণ সেই হাসি স্থায়ী হয়েছিল তরুণীর মুখে। ইংরেজিতে একে বলা হয় ‘গ্লাসগো স্মাইল’।
১৫ জানুয়ারি সকালে এলিজাবেথের সেই বীভৎস দেহ প্রথম দেখেন এক মহিলা। তিনি তাঁর সন্তানকে নিয়ে পার্কে হাঁটতে গিয়েছিলেন। পুলিশকে তিনি জানিয়েছেন, মাঠে দেহটি দেখে তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন, পোশাকের দোকানে সাজিয়ে রাখা কোনও মডেল পুতুল বুঝি কেউ ফেলে রেখে গিয়েছে। পরে বুঝতে পারেন, সেটা ছিল সদ্যমৃত তরুণীর দেহ।
এলিজাবেথের দেহ ছিল রক্তশূন্য। সমস্ত রক্ত বার করে দেওয়া হয়েছিল তাঁর দেহ থেকে। ফ্যাকাশে সাদা হয়ে পড়েছিল দেহের দুই টুকরো।
শুধু তাই নয়, খুনের পর দেহটিকে ভাল করে পরিষ্কার করা হয়েছিল। জল দিয়ে ধুয়ে দেওয়া হয়েছিল মৃতদেহ। পুলিশের অনুমান, অন্যত্র খুন করে আততায়ী ওই উদ্যানে দেহ ফেলে রেখে গিয়েছিল।
এলিজাবেথের দেহের সামনে থেকে একটি সিমেন্টের বস্তা উদ্ধার করেছিল পুলিশ। পাওয়া গিয়েছিল জুতোর হিলের ছাপ।
এলিজাবেথের পেটে ভর্তি ছিল মল। পুলিশের অনুমান, খুনের আগে তাঁকে মল খেতে বাধ্য করেছিল আততায়ী। এ ছাড়া, তরুণীর থাই থেকে মাংস কেটে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল যৌনাঙ্গে।
জানা যায়, ছ’মাস আগেই লস অ্যাঞ্জেলসের হলিউডে থাকতে এসেছিলেন এলিজাবেথ। সিনেমায় কাজ করা, নাম-যশ-খ্যাতি তাঁর স্বপ্ন ছিল। কিন্তু তিনি হলিউডে কাজ পাননি।
তদন্তের অগ্রগতিতে পুলিশ এবং গোয়েন্দারা জানতে পারেন, ১৯৪৩ সালে এক বার নাবালিকা অবস্থায় মদ্যপানের জন্য গ্রেফতার হয়েছিলেন এলিজাবেথ। তখন থানার রেকর্ডে তাঁর আঙুলের ছাপ নথিভুক্ত ছিল।
এলিজাবেথের এই মৃত্যু শুধু লস অ্যাঞ্জেলসে নয়, সারা আমেরিকা জুড়ে শোরগোল ফেলে দেয়। এই হত্যাকাণ্ডের নাম দেওয়া হয় ‘দ্য ব্ল্যাক ডালিয়া’।
সে সময় আমেরিকায় ‘দ্য ব্লু ডালিয়া’ নামের একটি সিনেমা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই এলিজাবেথ হত্যার নামকরণ করা হয়। গোয়েন্দারা জানান, কালো পোশাকের প্রতি এলিজাবেথের ঝোঁক ছিল। তাই তাঁর নাম দেওয়া হয় ব্ল্যাক ডালিয়া।
এলিজাবেথের মৃত্যুর খবর তাঁর মা জানতেন না। সংবাদমাধ্যমের তরফে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। মেয়ে সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করেছে, এই বলে এলিজাবেথের মায়ের কাছ থেকে মেয়ে সম্পর্কে অনেক তথ্য জেনে নেন আমেরিকার সাংবাদিকরা। শেষে মহিলাকে জানানো হয়, তাঁর মেয়ে খুন হয়েছেন।
এলিজাবেথের মৃত্যুর পর তাঁর সম্পর্কে একাধিক তথ্য উঠে আসে। কেউ কেউ বলেন, ছেলেদের প্রতি বিরূপ ছিলেন এলিজাবেথ। ছেলেদের নিয়ে মজা করতেন। তাঁর যৌনজীবন নিয়েও উঠে আসে নানা তথ্য।
অনেকে বলেছিলেন, এলিজাবেথ যৌনপেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কারও মতে, তিনি ছিলেন সমকামী। তাঁর যৌনজীবনে তথাকথিত কিছু অস্বাভাবিকতা ছিল, মেনেছিলেন সকলেই।
পুলিশের তদন্তে উঠে আসে, মৃত্যুর সময় অন্তত ৫০ জন পুরুষের সঙ্গে পরিচিতি ছিল এলিজাবেথের। তাঁদের মধ্যে অন্তত ২৫ জনের সঙ্গে মৃত্যুর ৬০ দিন আগেও এলিজাবেথকে ঘোরাফেরা করতে দেখা গিয়েছিল।
এলিজাবেথের মৃত্যুর প্রায় এক সপ্তাহ পর তদন্তকারীদের কাছে একটি ফোন যায়। এক ব্যক্তি দাবি করেন, তিনিই এই খুন করেছেন। প্রমাণস্বরূপ তরুণীর জিনিসপত্র পাঠিয়ে দেওয়ার কথাও জানান তিনি। কিছু দিন পর সত্যি সত্যিই এলিজাবেথের জন্মের শংসাপত্র-সহ একাধিক জিনিস তদন্তকারীদের কাছে এসে পৌঁছয়। সব কিছু গ্যাসোলিন দিয়ে ভাল করে ধোয়া হয়েছিল। ফলে কোনও আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি।
এরও কিছু দিন পর তদন্তকারীরা হাতে লেখা একটি চিঠি পান। তাতে দিন ক্ষণ জানিয়ে আততায়ী দাবি করেছিলেন তিনি ধরা দেবেন। কিন্তু কেউ আসেননি। পরের চিঠিতে লেখা ছিল, ‘‘ধরা দেব না ঠিক করলাম। ডালিয়াকে খুন করে বেশ করেছি।’’
লস অ্যাঞ্জেলস পুলিশ ব্ল্যাক ডালিয়া খুনের কিনারা করতে এক সময় এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছিল যে, মোট ৭৫০ জন অফিসারকে এই একটি খুনের রহস্য সমাধানে নিয়োজিত করা হয়েছিল। জেরা করা হয়েছিল শ’দেড়েক সন্দেহভাজনকে। এঁদের মধ্যে ৬০ জনের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করা গিয়েছিল। কিন্তু কাউকেই দোষী হিসাবে চিহ্নিত করা যায়নি।
৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্ল্যাক ডালিয়া হত্যা রহস্য অমীমাংসিত। তবে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। লস অ্যাঞ্জেলস পুলিশের এক আধিকারিক দীর্ঘ তদন্তের পর দাবি করেন, এলিজাবেথের খুনি ওই পুলিশ আধিকারিকের বাবা জর্জ হোডেল।
১৯৯৯ সালে বাবার মৃত্যুর পর তাঁর সংগ্রহ থেকে এক তরুণীর ছবি খুঁজে পান ওই পুলিশ আধিকারিক। তরুণীর সঙ্গে এলিজাবেথের মুখের মিল ছিল। জর্জ হোডেলের হাতের লেখার সঙ্গে আততায়ীর হাতের লেখার মিলও ছিল লক্ষ্যণীয়। হোডেল পেশায় চিকিৎসক ছিলেন। যে পদ্ধতিতে শর্টসের দেহ কেটে রক্তশূন্য করা হয়েছিল, সেই জ্ঞানও হোডেলের থাকা সম্ভব বলে দাবি করা হয়েছিল। এমনকি তাঁর নাম প্রাথমিক ভাবে ব্ল্যাক ডালিয়ার তদন্তকারীদের সন্দেহের তালিকাতেও ছিল। পরে তা বাদ দেওয়া হয়।
এলিজাবেথের খুনি তাঁর বাবা জর্জ হোডেল- এই মর্মে নিজের তদন্তের যাবতীয় খুঁটিনাটি লিখে একটি বই প্রকাশ করেন স্টিভ হোডেল। ২০০৩ সালের সেই ‘ব্ল্যাক ডালিয়া অ্যাভেঞ্জার: ট্রু স্টোরি’ নামক বই হয়েছিল বেস্টসেলার।
একাধিক তত্ত্ব সত্ত্বেও ব্ল্যাক ডালিয়া হত্যারহস্য এখনও অধরা। এলিজাবেথ শর্টসের খুনি কে, কেন তাঁকে খুন করা হল, এখনও সরকারি ভাবে কিছু জানানো হয়নি।
অনেকে মনে করেন, আসল সত্যিটা এখনও অধরা। ভবিষ্যতে আরও নিখুঁত কোনও তদন্তে হয়তো সেই সত্যি সামনে আসবে। আমেরিকার অন্যতম রহস্যময় এই খুনের ঘটনার নিষ্পত্তি হবে।