চলছে গণনা, হাসছেন হাসিনা। রবিবার সারা দিন ভোটের পরে বিকেল ৪টে থেকে বুথে বুথে ব্যালট গণনা যত এগিয়েছে ততই চওড়া হয়েছে শেখ হাসিনার হাসি। প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৯৮টি আসনের মধ্যে হাসিনার দল আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে ২২২টি আসনে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে জয়ী হয়েছেন ৬২ জন। যাঁদের মধ্যে আবার অনেকেই আওয়ামী লীগের নেতা। সংসদের এই মুহূর্তের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি জয়ী হয়েছে ১১টি আসনে। আরও ৩টি আসনে জয়ী হয়েছেন অন্যরা।
বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। রবিবার সকাল ৮টা থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয় ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া, যা চলে বিকেল ৪টে পর্যন্ত। মোট ৩০০টি আসনে ভোট হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এক প্রার্থীর মৃত্যু হওয়ায় নওগাঁ-২ কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বাতিল হয়েছে। এ ছা়ড়া আর এক কেন্দ্রে সব প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হওয়ায় রবিবার ২৯৮টি কেন্দ্রে ভোট হয়। বাংলাদেশের ২৮টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। মোট প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ১,৯৬৯ জন।
হাসিনা সরকারের তত্ত্বাবধানে কোনও নির্বাচনে অংশ না-নেওয়ার কথা আগেই ঘোষণা করেছিল বিএনপি, জামাত-এ-ইসলামি, বাম জোটের মতো বিরোধী শিবির। ভোট বয়কটের দাবিতে প্রচারও চালিয়েছিল তারা। তাদের দাবি ছিল, ‘নিরপেক্ষ’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাপনায় সাধারণ নির্বাচন। কিন্তু সেই দাবি শাসকদল আওয়ামী লীগ খারিজ করায় তৈরি হয় সংঘাতের আবহ।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ভোটে অংশ নেয়নি। প্রতিপক্ষ কিছু স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং নামসর্বস্ব কয়েকটি রাজনৈতিক দল। সুতরাং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থ দফায় সরকার গঠন করবে, তা ছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
সেই ছবিই স্পষ্ট হয়েছে, রবিবার ভোট গণনা এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে। ইগল, ট্রাক বা কাঁচি প্রতীক নিয়ে যেখানে যেখানে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে হারিয়েছেন নির্দলেরা, তাঁদেরও অনেকেই আওয়ামী লীগের নেতা।
সভানেত্রী শেখ হাসিনা আগেই ঘোষণা করেছেন জয়ীদের জন্য দলের দরজা খোলা থাকবে। বিএনপি, জামাতে ইসলামি এবং ‘সমমনা’ দলগুলি ভোট বয়কট করে শনিবার থেকে ৪৮ ঘণ্টা হরতালের ডাক দেওয়ায় ফলাফলকে ছাপিয়ে নজরের কেন্দ্রে চলে এসেছিল ভোটের হার।
বিরোধীদের বয়কটের ডাক অগ্রাহ্য করে প্রতিদন্দ্বিতার আঁচ না-থাকা একটা নির্বাচনে কত মানুষকে ভোটকেন্দ্রে টানতে পারা যাবে— সেটাই ছিল হাসিনার দলের চ্যালেঞ্জ। দিনের শেষে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছে, সারাদেশে গড়ে প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে— যা ডিস্টিংশন নিয়ে পরীক্ষায় পাশ বলেই মনে করছে আওয়ামী লীগ।
আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য দেশের পর্যবেক্ষকেরা এ দিন বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখে ভোটের প্রক্রিয়া নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন— যার ফলে আরও স্বস্তির শ্বাস ফেলেছেন শেখ হাসিনা।
ভোটে জয়ের চেয়েও ভোটের হার ছিল বেশি মাথাব্যথা কারণ। এই হার খুব কম হলে এক দিকে বিএনপি-জামাত যেমন সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন বলার সুযোগ পেয়ে যেত, তেমনই আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমি শক্তি নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে চাপে ফেলতে পারত হাসিনা সরকারকে।
৪০ শতাংশ ভোটের হার তাই জয়ের থেকে এতটুকু কম গুরুত্বপূর্ণ নয় আওয়ামী লিগের কাছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাই বলেছেন, “ভোটারেরা বাংলাদেশের গণতন্ত্রকেও জিতিয়েছেন। আর বয়কট করেছেন ভোট বয়কটের ডাক দেওয়া বিএনপিকে।”
গোপালগঞ্জ-৩ (টুঙ্গিপাড়া-কোটালিপাড়া) আসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পেয়েছেন ২ লক্ষ ৪৯ হাজার ৯৬২ ভোট। তাঁর সব চেয়ে কাছের প্রতিদ্বন্দ্বী আবুল কালাম ৪৬০টি ভোট পেয়েছেন। দু’দিন আগে টুঙ্গিপাড়ায় স্থানীয় এক যুবকের কাছে শেখ হাসিনার প্রতিদ্বন্দ্বীপ্রার্থীদের নাম ও ডেরার খোঁজ করায়, তাঁর তো হাসিই থামে না। পরে জানালেন, সকলেই তো পরিচিতমুখ, দেখুন হাসিনার হয়েই প্রচার করেছেন কোথাও!
প্রচারে ‘তাঁর’ খামখেয়ালি আচরণে দলের কর্মী থেকে ভোটারেরা বিরক্ত। ভোটের দিনেও এক অল্পবয়সি ভক্ত বেশি কাছাকাছি চলে আসায় সপাটে থাপ্পড় কষিয়েছেন, যার ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছে। তবে শেখ হাসিনার প্রার্থী হিসাবে মাগুরা-১ আসন থেকে বিপুল ভোটে জিতেছেন প্রথম বার ভোটে দাঁড়ানো সেই ক্রিকেটার শাকিব আল হাসান। তিনি পেয়েছেন ১ লক্ষ ৮৫ হাজার ৩৮৮ ভোট। ৫৯৯৩টি ভোট পেয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বী এক স্বতন্ত্র প্রার্থী।
প্রথম বার ভোটে দাঁড়িয়ে জয়ী হয়েছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অভিনেতা ফেরদৌস আহমেদ। তাঁর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ৬৫,৮৯৮। ঢাকা ১০ নম্বর কেন্দ্র থেকে নৌকার চিহ্নের প্রার্থী ছিলেন তিনি।
বিপুল ভোটে এগিয়ে রয়েছেন নড়াইল-২ আসনে নৌকার প্রার্থী বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরফী বিন মোর্ত্তজা। নড়াইলের লোহাগড়া মোড়ের চায়ের দোকানি ফারুক আলির কথায়, “শুধু খেলোয়াড় নয়, মাশরফি এক জন মানুষের মতো মানুষ। কাউকে অশ্রদ্ধা দেখায় না। বিপদে-আপদেপাশে থাকে।”
প্রায় একই কথা আরও এক জনের সম্পর্কে বলেন উত্তরের সুদূর নীলফামারিতে ভোট দিতে যাওয়ার জন্য তোড়জোড় করা ঢাকার এক বাসিন্দা সাইফুল। তাঁর কথায়, “নুর ভাই (আসাদুজ্জামান নুর)-কে ভোটটা না দিলে অবিচার হবে, তা সে যত কষ্টই হোক। বিএনপি-র লোকেরাও তাঁকে ভোট দেবে।” বিপুল ভোটে জিতেছেন ‘নুর ভাই’, বর্ষীয়ান তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু-ও।
নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু ভাবে করার জন্য বুধবার থেকে সেনাবাহিনীকে নামিয়েছে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন। সারা দেশে এক লক্ষ ৭৪ হাজার কর্মী নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন।
তবে, রবিবার কোথাও কোথাও অনিয়মের অভিযোগ যে হয়নি, তা নয়। ১৩টি বুথের ভোট বাতিল করা হয়েছে। চট্টগ্রাম-১৬ আসনের প্রার্থী মুস্তাফিজুর রহমানের প্রার্থিপদ খারিজ করেছে নির্বাচন কমিশন। চট্টগ্রামের পাহাড়তলি কলেজের ভোটকেন্দ্রের সামনে দু’জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
শুক্রবার রাতে যশোরের বেনাপোল থেকে যাত্রী নিয়ে রাজধানী ঢাকাগামী ইন্টারসিটি এক্সপ্রেসে আগুন ধরে যায়। কমলাপুর স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় ওই ঘটনায় চার জনের মৃত্যু হয়। পুড়ে যায় ট্রেনের তিনটি কামরা।
সেই ঘটনায় শনিবার বিএনপির সাত জনকে গ্রেফতার করে বাংলাদেশ পুলিশ। শেষ বেলার নির্বাচনী প্রচারে বাংলাদেশে খুনও হয়েছেন তিন জন। শনিবার সকাল থেকে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল (ধর্মঘট) শুরু করেছিল বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার দল। তা চলবে সোমবার পর্যন্ত। এ প্রসঙ্গে হাসিনা রবিবার বলেন, ‘‘বিএনপি সন্ত্রাসী দল, বাংলাদেশের মানুষ তাদের হরতালের তালে নাচে না।’’
চট্টগ্রামে পুলিশ এবং বিএনপি কর্মীদের সংঘর্ষও ঘটেছে। মুন্সীগঞ্জে এক জন প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু এই সব কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদ দিলে গোটা বাংলাদেশেই মানুষ শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোট দিয়েছেন।
নতুন করে কোনও অশান্তি যাতে না হয়, কর্মীদের তাই বিজয়-মিছিল করতে বারণ করেছেন শেখ হাসিনা। এ বার নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার তোড়জোড় শুরু করতে হবে পঞ্চমবারের প্রধানমন্ত্রী মুজিবর কন্যাকে।