পার্টিতে যাওয়ার জন্য অচেনা সওয়ারির গাড়িতে লিফ্ট নিয়েছিল তিন বোন। এর পর আর পার্টিতে পৌঁছয়নি তারা। তিন স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের পর খুন করা হয়েছিল। তার আগে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল তাদের স্তন ও যোনিতে। তাদের দেহ মিলেছিল একটি গর্ত থেকে।
৩০ বছর আগেকার এই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত আজও অধরা। তবে ধরা পড়েছিল তার এক সঙ্গী। স্পেনের অপরাধের ইতিহাসে কুখ্যাত এই ঘটনা উঠে এসেছিল বইয়ের পাতা থেকে টেলিভিশনের পর্দায়।
স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া কাউন্টির আলকাজ়ারের বাসিন্দা ছিল ওই তিন কিশোরী। ফলে সংবাদমাধ্যমের দৌলতে তাদের পরিচয় হয়ে যায় ‘আলকাজ়ার গার্লস’ নামে।
১৯৯২ সালে ১৩ নভেম্বর। স্কুলের পার্টিতে যাওয়ার জন্য নাইটক্লাবে নিয়ে যেতে বাবার কাছে বায়না জুড়েছিল তিন বোন— মিরিয়াম গার্সিয়া ইবোরা, আন্তোনিয়া ‘টোনি’ গোমেজ রবদিগেজ় এবং ডেজ়িরে হার্নান্দেজ় ফোক। মিরিয়ামদের বাবা ফার্নান্দো গার্সিয়া সে সময় ইনফ্লুয়েঞ্জায় কাবু। ফলে বাধ্য হয়েই বাবার গাড়ি রেখে তিন জনে মিলে রাস্তায় পা বাড়িয়েছিল।
বাড়ি থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে একটি নাইটক্লাবে স্কুলের পার্টি ছিল। ১৩ নভেম্বরের রাতে সেখানে যেতে তৈরি হয়েছিল মিরিয়ামরা। পথে এক কমবয়সি দম্পতি তাদের লিফ্ট দিয়েছিল। গাড়ি করে তিন জনকে পিকাসেন্ট শহরের একটি পেট্রল পাম্প পর্যন্ত পৌঁছে দেন ওই দম্পতি।
গন্তব্য ছিল, পিকাসেন্ট শহরের ‘কুলার্স’ নাইটক্লাব। তবে রাতের বেলা সেখানে পৌঁছনো যায় কী ভাবে? অবশেষে ‘হিচহাইকিং’ করার কথা মাথায় এসেছিল তিন বোনের। এর আগেও তো তারা এ ভাবেই কত জায়গায় গিয়েছে!
পেট্রল পাম্পের কাছে এক স্থানীয় পুলিশকে পরে জানিয়েছিলেন, ১৩ নভেম্বর রাতে একটি সাদা রঙের ওপেল কোরসা সেডানে উঠতে দেখা গিয়েছিল তিন বোনকে। সে গাড়িতে বসেছিল একগাদা লোক। সে বারই মিরিয়ামদের জনসমক্ষে শেষ বারের মতো দেখা গিয়েছিল বলে দাবি।
মিরিয়ামদের অপহরণ করে ধর্ষণ এবং তার পর খুনের অভিযোগে মূল অভিযুক্ত হিসাবে নাম উঠে এসেছিল আন্তোনিও অ্যাঙ্গলেসের। সঙ্গী ছিলেন তাঁর সহযোগী মিগুয়েল রিকার্ট।
পুলিশের কাছে বয়ানে রিকার্ট জানিয়েছিলেন, গাড়িতে করে তিন জনকে নাইটক্লাবে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতি দিলেও সেখানে যাননি তাঁরা। পিকাসেন্ট শহরের ওই নাইটক্লাব পেরিয়ে যাওয়ার পর বিপদ আঁচ করতে পারে তিন কিশোরী। তবে তাদের চিৎকার-চেঁচামেচি সত্ত্বেও গাড়ি থামেনি।
রিকার্টের বয়ান অনুযায়ী, তিন কিশোরীর চিৎকার শুনে গাড়ির মধ্যে তাদের একটি হ্যান্ডগান দিয়ে আঘাত করতে থাকেন আন্তোনিও। এর পর তাঁরা পৌঁছন শহর থেকে দূরে লা রামোনা গ্রামে। পাহাড়ঘেরা ওই নির্জন জায়গায় একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে তিন জনকে নিয়ে তোলেন তাঁরা।
পুলিশের জেরায় রিকার্ট জানায়, ওই পোড়ো বাড়িতে একে একে দুই বোনকে ধর্ষণ করেন আন্তোনিওরা। এর পর বাইরে বেরিয়ে খাবার আনতে যান। ঘণ্টা দুয়েক পরে ফিরে এসে আর এক বোনকেও ধর্ষণ করেন তাঁরা।
তিন জনকে ধর্ষণের পরে তাঁদের উপর সারা রাত ধরে চলতে থাকে নির্মম অত্যাচার। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট জানিয়েছে, ডেজ়িরের ডান স্তনে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের ক্ষতচিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। যার জেরে স্তনের একাংশচ্ছেদ হয়েছিল তাঁর। অভিযোগ, এর পর তার পিঠে দু’বার ছুরির কোপ মারা হয়।
রিকার্টের দাবি, ডেজ়িরের মতোই তার দুই বোনের উপরও চলে অকথ্য অত্যাচার। মিরিয়ামের যোনিতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেছিলেন আন্তোনিওরা। গোটা রাত ধরে মিরিয়াম এবং আন্তোনিয়াকে লাঠি দিয়ে বেদম পেটানো হয়েছিল বলে তদন্তে জানা গিয়েছে।
রাতভর অত্যাচারের পর তিন কিশোরীকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় একটি গর্তের কাছে। রিকার্টের দাবি, ওই পরিত্যক্ত বাড়ির অদূরে আগে থেকেই গর্ত খুঁড়ে রেখেছিলেন তাঁরা। সেখানে গুলি করে খুন করে তাদের গর্তে ফেলে মাটিচাপা দিয়ে দেন অভিযুক্তরা।
মিরিয়ামরা নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই তল্লাশিতে নেমে পড়েছিল পুলিশ। ঘটনার ৭৫ দিন পর ১৯৯৩ সালের ২৭ জানুয়ারি মিরিয়ামদের দেহ উদ্ধার হয়।
বৃষ্টিতে ওই গর্তের মাটি সরে গিয়ে তিনটি কঙ্কাল বেরিয়ে এসেছিল। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হয়েছিল রিকার্টের একটি গ্লাভস। আন্তোনিওর ভাই মার্টিনের জন্য সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বরের সুপারিশ করা একটি নোট। এবং একটি গুলির খোল।
সেই সূত্র ধরেই রিকার্টের কাছে পৌঁছে যায় পুলিশ। তাঁকে ১৭০ বছরের কারাবাসের সাজা দেয় আদালত। তবে আইনের ফোঁকফোকর গলে ২১ বছর জেল খেটেছিলেন তিনি। ২০১৩ সালে জেলের বাইরে পা রাখেন রিকার্ট।
মিরিয়ামদের দেহাবশেষের সঙ্গে পুলিশ উদ্ধার করে সাতটি চুল। এই চুলগুলির ডিএনএ পরীক্ষা করে চমকে যায় পুলিশ। কারণ এই ডিএনএর সঙ্গে মিল ছিল না খুন হওয়া তিন বোন, রিকার্ট বা আন্তোনিওর। তা হলে এই চুলগুলি কার? তবে কি খুনে জড়িত ছিলেন তৃতীয় কেউ? সে রহস্যের সমাধান হয়নি।
আন্তোনিওকে অবশ্য ধরতে পারেনি পুলিশ। অনেকের দাবি, আয়ারল্যান্ডে পালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। আবার অনেকের মতে, ভুয়ো পাসপোর্টে ব্রাজিলে বসবাস করছেন তিনি। তবে ইন্টারপোলের শত চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁর খোঁজ মেলেনি।
‘আলকাজ়ার গার্লস’দের ঘটনা ঠাঁই পেয়েছে ক্রাইম থ্রিলারের পাতায়। জেনি অ্যাশফোর্ডের ‘দ্য ফেসলেস ভিলেন: ভলিয়ুম থ্রি’তে উঠে এসেছে আন্তোনিওরা। অন্য দিকে, ‘দি আলকাজ়ার মার্ডারস’ নামের তথ্যচিত্রের পাঁচ পর্ব জুড়ে দেখা যায় মিরিয়ামদের শিউরে ওঠার মতো কাহিনি।