ফেলুদা হলে বলত, ‘ব্যাপারটা একটু গোলমেলে ঠেকছে রে!’ বাস্তবের গোয়েন্দা স্ট্যানচুলারও যে সব কিছু খুব স্বাভাবিক লেগেছিল তা নয়। কিন্তু তাঁর কাছে ঘটনাটির আর কোনও ব্যখ্যাও নেই। সাদা চোখে দেখলে, এটা মনে হতে বাধ্য যে, মৃত্যুর পর খুনীকে চিনিয়ে দিয়েছিলেন মৃত ব্যক্তির আত্মাই।
ঘটনাটি ঘটে ১৯৭৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, শিকাগোয়। তেরেসিটা বাসা নামের এক মহিলাকে তার অ্যাপার্টমেন্টের ভিতর রহস্যজনক ভাবে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ।
শিকাগোর ২৭৪০ নর্থ পাইন গ্রোভ অ্যাভিনিউয়ের ১৫ বি নম্বর ফ্ল্যাটের বাসিন্দা ছিলেন তেরেসিটা। পেশায় শ্বাসযন্ত্র বিশেষজ্ঞ। শিকাগোরই এডগেওয়াটার হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন।
তেরেসিটাকে যখন উদ্ধার করা হয় তখন তাঁর কার্পেটে মোড়া দেহ দাউ দাউ করে জ্বলছিল। আগুন নেভানোর পর দেখা যায় তাঁর বুকেও একটি ছুরি আমূল বেঁধানো রয়েছে। শরীরে কোনও পোশাক নেই।
নগ্ন দেহ দেখে পুলিশের সন্দেহ হয়েছিল ঘটনাটি হয়তো কোনও যৌন অপরাধ। কিন্তু ময়নাতদন্তের রিপোর্ট দেখে তাঁরা অবাক হয়ে যান। কারণ তেরেসিটার শরীরে যৌন অত্যাচারে কোনও চিহ্ণই পাওয়া যায়নি। ।
খুনের ঘটনাটির অন্য দিকগুলি এরপর দেখতে শুরু করেন গোয়েন্দারা। কিন্তু খুনের কারণ বা খুনির পরিচয় কিছুই জানা যাচ্ছিল না।
তদন্তে তেরেসিটা সম্পর্কেই একের পর এক তথ্য উঠে আসতে থাকে। জানা যায়, ১৯৩০ সালে তেরেসিটার জন্ম। কর্মসূত্রে শিকাগোয় থাকলেও তেরেসিটার বড় হয়েছেন ফিলিপিন্সে। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন। বেশ কয়েকবার সম্পর্কে জড়ালেও বিয়ে করেননি তেরেসিটা।
শিকাগোর এডগেওয়াটার হাসপাতালর শ্বাসযন্ত্রর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন তিনি। রোগীরাও তাঁকে পছন্দ করতেন। মূলত পড়াশোনা নিয়েই থাকতেন তেরেসিটা। তবে ছোটবেলা থেকে সঙ্গীতের শখও ছিল।মৃত্যুর আগের বছর নিজের পুরনো মিউজিক স্কুলে নামও লেখান তিনি। নতুন করে সঙ্গীতচর্চা করবেন বলে।
যদিও খুনিকে খুঁজে পেতে এ সব তথ্য কোনও কাজে লাগেনি। একটি সূত্র অবশ্য তদন্তকারীদের হাতে এসেছিল। সেটি তেরেসিটারই হাতে লেখা একটি চিরকুট। যেখানে এ. এস নামে জনৈক ব্যক্তির জন্য থিয়েটারের টিকিট সংগ্রহ করার কথা লিখে রেখেছিলেন টেরেসা। তবে এই ‘এ.এস’-ই খুনি কি না? বা তাঁকে কোথায় গেলে পাওয়া যাবে তা অনেক খুঁজেও বুঝতে পারেনি পুলিশ।
তদন্তে নেমে তেরেসিটার শেষ ফোনের কথাও জানতে পারেন গোয়েন্দা স্ট্যানচুলা। শেষ ফোন তেরেসিটা করেছিলেন রুথ লোব শেষ ফোন করেন । রুথের সঙ্গে কথোপকথনের সময় তাঁকে বাড়িতে এক পুরুষ অতিথির আসার কথাও জানিয়েছিলেন তেরেসিটা। কিন্তু সেই অতিথি কে? তাঁর নাম কি? তা রুথ জানতে চাননি। তেরেসিটাও বলেননি।
৭টা ৪০ মিনিটে রুথের ফোন রাখেন তেরেসিটা। সাড়ে ৮টায় তাঁর দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মাঝের ৫০ মিনিটে কী হয়েছিল? কে ছিলেন ওই পুরুষ অতিথি? তাঁর নামই এ.এস কি না এবং এই এ. এসই তেরেসিটার খুনি কি না তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেশ কয়েকমাস হাতড়ে বেড়ান গোয়েন্দারা।
অবশেষে ওই বছরই জুলাই মাসে মামলাটি নতুন করে খবরে আসে। ততদিনে তেরেসিটার খুনের তদন্তে নিযুক্ত গোয়েন্দারা ধরেই নিয়েছেন আরও অজস্র রহস্যজনক হত্যার ঘটনার মতো এই ঘটনাটিরও সমাধান হবে না। হঠাৎই একটি নোট সব বদলে দেয়। নোটটি রাখা ছিল গোয়েন্দা স্ট্যানচুলার ডেস্কে। তাতে লেখা ছিল, তেরেসিটা খুনের অনুসন্ধান করতে এই নম্বরে ফোন করুন।
ফোন নম্বরটি ছিল ইভানস্টন পুলিশ দফতরের। সেখানে ফোন করে স্ট্যানচুলা জানতে পারেন তেরেসিটার হাসপাতালের এক সহকর্মীর কাছে তার হত্যাকারীর বিষয়ে তথ্য আছে।
তেরেসিটার ওই সহকর্মীর নাম চিকিৎসক রেমেবায়স ওরফে রেমি চুয়া। তেরেসিটার মতোই তিনিও শ্বাসযন্ত্রের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। কাজ করতেন এডগেওয়াটার হাসপাতালে। এমনকি রেমিও এককালে ফিলিপিন্সের বাসিন্দা ছিলেন। তবে তেরেসিটার সঙ্গে সরাসরি তাঁর আলাপ ছিল না।
গোয়েন্দার সঙ্গে অবশ্য যোগাযোগ করেন রেমির স্বামী চিকিৎসক হোসে চুয়া। তিনি যা বলেন, তা শুনে স্ট্যানচুলা ভেবেছিলেন তাঁকে ডেকে আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে অপদস্থ করা হচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিষয়টি এড়িয়েও যেতে পারেননি স্ট্যানচুলা।
হোসে তাঁকে জানিয়েছিলেন, তাঁর স্ত্রী-র উপর না কি মাঝে মধ্যেই ভর করছে তেরেসিটার আত্মা। প্রথমে তিনি নানা জায়গায় তেরেসিটার মুখ দেখতে পাচ্ছিলেন। পরে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। এরপর একদিন ঘুমের মধ্যে সম্পূর্ণ অন্যরকম কণ্ঠস্বরে কথা বলে ওঠেন রেমি।
হোসে দাবি করেন, ওই কণ্ঠস্বর নিজেকে তেরেসিটা বলে পরিচয় দেন। সেই সঙ্গে নিজের খুনের ঘটনার হুবহু বর্ণনাও দেন। অপরিচিত কণ্ঠস্বর জানিয়েছিল, তাঁকে খুন করেছে অ্যালান সাওয়ারি নামে এক ব্যক্তি। হোসেকে ওই কণ্ঠস্বর অনুরোধ করেছিল তাঁকে সাহায্য করতে। বিষয়টি পুলিশকে জানাতে। হোসে অবশ্য একটি বর্ণ পুলিশকে জানাননি।
দিন কয়েক পর না কি আবারও মাঝরাতে অপরিচিত কণ্ঠস্বরে কথা বলে ওঠেন রেমি। এ বার ওই কণ্ঠস্বর রীতিমতো অসন্তুষ্ট স্বরে জানতে চায়, কেন তার কথা শুনে পুলিশকে ঘটনটি জানানো হয়নি। হোসে পাল্টা প্রশ্ন করেন। জানান, প্রমাণ ছাড়া তিনি কোনও মতেই বিষয়টি জানাতে পারবেন না। এর জবাবে প্রমাণের কথাও বলে ওই কণ্ঠস্বর। জানায়, অ্যালানের সেদিন তেরেসিটার বাড়িতে টিভি সারাতে আসার কথা ছিল। তেরেসিটার দামি কিছু গহনা চুরি করেছিল অ্যালান। সেই গহনা নিজের প্রেমিকাকে উপহারও দেন। এমনকি কারা ওইসব গহনা দেখে তেরেসিটার বলে চিনতে পারবেন, তাদের নামও বলে ওই কণ্ঠস্বর। দেয় ফোন নম্বরও। প্রমাণ হাতে পেয়েই গোয়েন্দা বিভাগে খবর দেন হোসে।
ঘটনাটি বিশ্বাস না করলেও স্ট্যানচুলা ঠিক করেন, খতিয়ে দেখবেন বিষয়টি। অ্যালান নামের ওই ব্যক্তিকে ডেকে পাঠিয়ে জেরা শুরু করেন তিনি। একে একে মিলে যেতে থাকে অচেনা কণ্ঠস্বরের বলা তথ্য। মিথ্যে কথা বলে ধরা পড়ে যান অ্যালান। জানা যায়, ঘটনার দিন তিনি সত্যিই গিয়েছিলেন তেরেসিটার বাড়িতে। টিভি সারাতে সাহায্য করার নামে আসলে তেরেসিটার বাড়িতে ডাকাতি করারই অভিসন্ধি ছিল তাঁর। সে সময় অর্থকষ্টে ভুগছিলেন অ্যালান। বাড়ির ভাড়া জোগানোর অর্থও ছিল না তাঁর। তেরেসিটার বাড়িতে ঢুকেই তাঁকে আক্রমণ করেছিলেন অ্যালান। তেরেসিটার মৃত্যুর পরে প্রমাণ লোপাট করতে তার পোশাক খুলে কার্পেটে জড়িয়ে আগুন ধরিয়ে দেন। চুরি করেন তেরেসিটার গহনা এবং মূল্যবান সামগ্রীও।
অ্যালান খুনের অপরাধ স্বীকার করে। অদ্ভুত ভাবে তার প্রেমিকার কাছ থেকেও পাওয়া যায় তেরেসিটার চুরি যাওয়া গহনা। যা ওই অচেনা কণ্ঠস্বরের বলা কয়েকজন তেরেসিটার বলে চিহ্নিতও করে।
তবে এরপরও মাত্র পাঁচ বছরের জেল হয় অ্যালানের। উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তাঁকে প্রথমে ছেড়েই দিয়েছিলেন বিচারকেরা। পরে অ্যালান নিজেই বিচার কক্ষে দোষকবুল করেন। ১৪ বছরের সাজা হয় অ্যালানের। কিন্তু পাঁচ বছর পরই প্যারোলে মুক্তিও পেয়ে যান।
কিন্তু সত্যিই কি তেরেসিটার আত্মা চিনিয়ে দিয়েছিল নিজের খুনিকে। গোয়েন্দা স্ট্যানচুলা এর জবাব দিতে পারেননি। প্রশ্ন করা হলে বলেছেন, ‘‘আমি এর কোনও ব্যাখ্যা পাইনি। তবে হয়তো ঘটনাটি আরও তলিয়ে দেখা যেত। হয়তো অন্য কোনও সত্যি প্রকাশ্যে আসত!’’
স্ট্যানচুলার আরেক সহকর্মী অবশ্য বলেছেন, এমনও তো হতে পারে একই শহরের বাসিন্দা রেমি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েছিলেন তেরেসিটার মৃত্যুর ঘটনায়। তদন্তে জানা গিয়েছিল, অ্যালানকে পছন্দ করতেন না রেমি। হয়তো তিনি সন্দেহ করেছিলেন অ্যালানকে। হয়তো সেই সন্দেহের ভিত্তিতেই ঘটনাটি নিজের মতো করে সাজিয়েছিলেন এবং কেউ তাঁকে বিশ্বাস করবে না এই ভয়ে তেরেসিটার গলা নকল করে ভুতের গল্প বানিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।
এই সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দিতে পারেননি গোয়েন্দাদের একটি মহল। তবে তেরেসিটার রহস্য শেষপর্যন্ত রহস্য হয়েই থেকে গিয়েছে।