চিনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্প পাকিস্তান পেরিয়ে এ বার পা রাখতে চলেছে আফগানিস্তানেও। সম্প্রতি, আফগানিস্তানের তালিবান সরকার এই মর্মে আনা প্রস্তাবে পাকিস্তান এবং চিনের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছে।
‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ এত দিন পাকিস্তানেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই প্রকল্পের মাধ্যমে চিনের হাত ধরে পাক অর্থনীতির উন্নতি হবে বলে দাবি করেছিল বেজিং। গত কয়েক বছর ধরে প্রকল্পের কাজ খানিকটা এগিয়েছে পাক মুলুকে।
কিন্তু ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্পে পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখের নয়। উন্নয়নের বদলে চিনের পাল্লায় পড়ে তাদের উল্টে ডুবতেই হয়েছে বলে দাবি। এখন আফগানিস্তানেও সেই একই পন্থায় অনুপ্রবেশ করতে চায় বেজিং।
তালিবানশাসিত আফগানিস্তানে এমনিতেই অর্থনীতি নড়বড়ে। তালিবানের শাসনে আন্তর্জাতিক স্তরে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে দেশটির উপর।
এই পরিস্থিতিতে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্পের আওতায় আফগানিস্তানে বহু কোটি টাকার নির্মাণকাজ শুরু করার উদ্যোগ নিচ্ছে চিন। পাকিস্তানের পর ভারতের উত্তর-পশ্চিমের এই দেশটিতেও বেজিংয়ের প্রভাব বিস্তৃত হতে চলেছে।
গত শনিবার চিনের বিদেশমন্ত্রী কিন গ্যাং পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী বিলাবল ভুট্টোর সঙ্গে ইসলামাবাদে দেখা করেন। প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানের পুনর্গঠনের স্বার্থে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করার জন্য সেই বৈঠকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে।
চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি)-এর জন্য মোট বরাদ্দের পরিমাণ প্রায় ৪ লক্ষ ৯২ হাজার কোটি টাকা। সেই প্রকল্প আফগানিস্তানে গেলে দেশটির উন্নতিসাধন হবে বলে দাবি করছে বেজিং এবং ইসলামাবাদ।
পাকিস্তান এবং চিনের তরফে বিদেশমন্ত্রীদের বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, আফগানিস্তানের মানুষের অর্থনৈতিক সহায়তা এবং দেশের উন্নয়নের স্বার্থে সিপিইসি আফগানিস্তান পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে।
এক দশক আগে শি জিনপিং পাকিস্তানে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্প চালু করেছিলেন। আফগানিস্তানের তালিবান সরকার এই প্রস্তাব পেতেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের আশায় তা লুফে নিয়েছে।
আফগানিস্তানের বেশ কিছু অর্থনৈতিক সম্পদ বিদেশে গচ্ছিত রয়েছে। তালিবান ক্ষমতায় আসার পর সন্ত্রাসবাদী ক্রিয়াকলাপে ব্যবহৃত হতে পারে, এই আশঙ্কায় সেই সম্পদে তাদের হাত দিতে দেওয়া হয়নি।
চিন এবং পাকিস্তান নতুন সমঝোতায় আফগানিস্তানের সেই বিদেশি সম্পদ মুক্ত করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে। সে বিষয়ে তারা নিজেরা উদ্যোগীও হবে।
আফগানিস্তানের বিদেশি সম্পদের অর্ধেক মুক্ত করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজে লাগানোর জন্য রাজি হয়েছিল আমেরিকা। কিন্তু তালিবান সে দেশে স্কুল এবং কর্মস্থানে মহিলাদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায় আবার পিছিয়ে আসে ওয়াশিংটন।
তবে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্পে আফগানিস্তানের আদতে কতটা উন্নতি হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ, পাকিস্তানের অন্দরে এই প্রকল্প নিয়ে খুব একটা আশার কথা শোনা যায়নি। বরং, দেশটি চিনের সহায়তা সত্ত্বেও ক্রমাগত অর্থনৈতিক সঙ্কটের দিকে এগিয়ে গিয়েছে।
পাক অন্দরমহলে অভিযোগ, ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্পকে হাতিয়ার করে একতরফা লাভ করছে চিন। ক্ষতির মুখে পড়ছে পাকিস্তানের ব্যবসায়িক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি। ফলে সিপিইসি নিয়ে পাক ব্যবসায়ীদের মধ্যেও ক্ষোভ দিন দিন বেড়েছে।
২০১৫ সালে সড়ক প্রকল্প চালুর সময় বেজিং প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, এর ফলে পাকিস্তানের বার্ষিক আর্থিক বৃদ্ধি অন্তত আড়াই শতাংশ হবে। বাড়বে কর্মসংস্থান। বিদ্যুৎ পরিকাঠামোর উন্নয়ন এবং জ্বালানির জোগানও স্থিতিশীল হবে কিন্তু সেই পূর্বাভাস মেলার কোনও ইঙ্গিত মেলেনি। বরং ছ’বছরে ক্রমশ দুর্বল হয়েছে পাক অর্থনীতি।
পশ্চিমি দুনিয়া অবশ্য সিপিইসি নিয়ে পাকিস্তানকে আগেই সতর্ক করেছিল। আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলি জানিয়েছিল, সিপিইসি-র লাভের গুড় পুরোটাই চিনের ঘরে যাবে।
সেই আশঙ্কা এবং ভবিষ্যদ্বাণী মিলে গিয়েছে বলে দাবি। অভিযোগ, চিন তাদের উৎপাদিত পণ্য এই সড়ক পথে রফতানি করছে পাকিস্তানে। আর তার ফলে মার খাচ্ছে পাক উৎপাদন ক্ষেত্র। পাশাপাশি, পাকিস্তানের ক্ষুব্ধ বণিক মহল বলছে, সিপিইসি ধরে চিন থেকে পাকিস্তানে কোনও পণ্য নিয়ে আসা যতটা সহজ, পাকিস্তান থেকে কোনও কিছু চিনে নিয়ে যাওয়া ততটাই কঠিন। কারণ চিনা কর্তৃপক্ষের নানা বিধিনিষেধ।
এ বার আফগানিস্তানেও সেই একই পরিস্থিতি হতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। চিন নিজের লাভের স্বার্থেই এই তালিবানশাসিত দেশটিকে কাজে লাগাবে, আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।