চোখের সামনে দেখেছিলেন দিনের পর দিন বিনা চিকিৎসায় একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছেন বাবা। সে দিন কিছুই করতে পারেনি ছোট্ট সুবোধ। বাবা চলে যাওয়ার পর মাকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদেছিল সে। বড় হয়ে সেই ছেলে ডাক্তার হলেন। এখন গরিবের আশা-ভরসার অপর নাম সুবোধ ডাক্তার।
নাম সুবোধকুমার সিংহ। বাড়ি উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে। দারিদ্রের সঙ্গে লড়তে লড়তেই আজ তিনি ডাক্তার। বাবাকে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে দেখেছিলেন। এখন সেই সুবোধই নিখরচায় প্রায় ৩৭ হাজার অস্ত্রোপচার করেছেন।
সুবোধের ছোটবেলা ছিল খুব কষ্টের। বাবা রেলের নিচুতলার কর্মী ছিলেন। সংসার চালাতে গিয়ে বিপুল ধার করেন। তার উপর পড়েন কঠিন অসুখে। তখন সুবোধের বয়স মেরেকেটে ১৩।
প্রায় বিনা চিকিৎসায় বাবাকে চলে যেতে হয়েছিল। পুরো সংসার পড়ে অকূলপাথারে। বাবার করে যেওয়া দেনা মেটাতে হবে। তার উপর সংসার চালানো! অল্প বয়সে সুবোধ ও তাঁর দাদাকে নামতে হয় সংসার সংগ্রামে।
দাদা-ভাই সংসার চালাতে গিয়ে বিভিন্ন কাজ করেছেন। রাস্তার মোড়ে খাঁ-খাঁ রোদে দাঁড়িয়ে কখনও সাবান, কখনও সস্তার রোদচশমা বিক্রি করেছেন কিশোর সুবোধ।
ছোট থেকেই পড়াশোনায় প্রবল আগ্রহ সুবোধের। কিন্তু বাধ সাধে দারিদ্র। কী ভাবে পড়াশোনা হবে?
দিনের পর দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর রাতে পেটে কিছু দিয়ে পড়তে বসা। এ ভাবেই দশম শ্রেণিতে পৌঁছলেন সুবোধ।
যখন সুবোধের দশম শ্রেণি, মা পড়লেন বড় অসুখে। প্রায় শয্যাশায়ী তিনি। তত দিনে বাবার চাকরিটা পেয়েছেন দাদা। কিন্তু তাতে সংসারের হাল ফেরেনি। কাজ করতেই হত সুবোধকে।
সারা দিনের কাজের পর বাড়ি ফিরে সবার জন্য রান্নাবান্না করতেন সুবোধ। তার পর পড়তে বসতেন। ভাইয়ের পড়াশোনায় একাগ্রতা দেখে ভরসা দেন কয়েক বছরের বড় দাদা।
সুবোধের কথায়, ‘‘পারিবারিক অর্থকষ্টে দাদা বেশি দূর পড়াশোনা করতে পারেনি। কিন্তু আমি যাতে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারি, সেই ভরসা জুগিয়েছিল। দাদার এই ত্যাগ এবং কষ্টের যথাযথ মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’’
শুধু দাদার চেষ্টা এবং ভরসাতেই ডাক্তারি পড়া শুরু করেন সুবোধ। ১৯৮৩ সালে উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের মেডিক্যাল এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করেন। ভর্তি হন বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ডাক্তারি পড়তে পড়তে নিজের অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা শুরু করেন।
এমবিবিএস পাশ করার পর জেনারেল সার্জারিতে স্নাতকোত্তর করেন। তার পর প্লাস্টিক সার্জারি বিশেষজ্ঞ হন।
১৯৯৩ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত প্র্যাকটিস শুরু করেন। বিনামূল্যে বহু গরিব মানুষের চিকিৎসা করেছেন।
২০০৪ সালে নিজেই একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন সুবোধ। বাবার নামেই হাসপাতালের নাম রাখেন জ্ঞান সিংহ স্মৃতি হাসপাতাল।
ছোটবেলায় বাবাকে দেখেছেন চিকিৎসা না পেয়ে মারা যেতে। গরিব মানুষের জীবনের দৈনন্দিন লড়াইটা তাঁর চেয়ে ভাল আর কে বুঝবে! যথাসাধ্য চেষ্টা করেন কম খরচে অথবা নিখরচায় গরিবদের চিকিৎসা পরিষেবা দিতে।
সুবোধ ডাক্তারের নাম ছড়িয়েছে দূরদূরান্তে। হাসপাতালটি তৈরি করেছিলেন অনেকের সাহায্য নিয়ে। তার মধ্যে অন্যতম ছিল আমেরিকার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।
সুবোধের হাসপাতালে চিকিৎসা পরিষেবার মধ্যে অন্যতম গন্না কাটার চিকিৎসা। ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই অসুখ দেখা যায়। এমন অসুখে কথা বলার সমস্যা হয়। এমনকি, পরবর্তীতে বোবাও হয়ে যেতে পারে তারা।
২০০৪ সাল থেকে এমন শিশুদের বিনামূল্যে অস্ত্রোপচার করার ঘোষণা করেন সুবোধ। এখনও পর্যন্ত ৩৭ হাজার শিশুর বিনামূল্যে অস্ত্রোপচার করেছেন এই চিকিৎসক। বদলে দিয়েছেন তাঁদের মুখের আদল।
সুবোধের এই অস্ত্রোপচারের পন্থা গ্রহণ করেছেন বহু ডাক্তার। উত্তরপ্রদেশ থেকে ঝাড়খণ্ড, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ় এবং বাংলাতেও এমন ভাবে প্লাস্টিক সার্জারি হয়।
সুবোধের কথায়, ‘‘গরিব হয়ে জন্মানো অপরাধ নয়। আমি গরিব ছিলাম। এবং তার জন্য কোনও দিন লজ্জা পাইনি। কারও থেকে নিজেকে ছোট-ও মনে করিনি। চেষ্টা করি নিজের গল্প বলে কচিকাঁচাদের উদ্বুদ্ধ করতে। বলি, শেষ পর্যন্ত তোমাদের কাজই হবে তোমাদের পরিচয়। বাকি কোনও কিছুই কেউ মনে রাখবে না।’’