রবিবারের ম্যাচের পর কেকেআরের ‘হিরো’র নাম রিঙ্কু সিংহ। উত্তরপ্রদেশের এই ক্রিকেটার ব্যাট হাতে গুজরাতের বিরুদ্ধে চমকে দিয়েছেন। শেষ পাঁচ বলে মেরেছেন পাঁচটি অবিশ্বাস্য ছক্কা।
রিঙ্কুর নামের পাশে রবিবার অর্ধশতরান ছিল না। পাঁচ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে তিনি ২১ বলে ৪৮ রানের ঝোড়ো ইনিংস খেলেন। নিশ্চিত হারের হাত থেকে কলকাতাকে বাঁচিয়ে তোলেন নাইটদের তরুণ তুর্কি।
বাইশ গজে শুধু নয়, রিঙ্কুর জীবনেও যেন রয়েছে রূপকথার ছোঁয়া। একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে নিজের প্রতিভা এবং পরিশ্রমের জোরে জীবনের ইনিংসে মাথা তুলেছেন তিনি।
আলিগড়ের এক দরিদ্র পরিবারে রিঙ্কুর জন্ম। তাঁর পরিবারে ৯ থেকে ১০ জন সদস্য রয়েছেন। আইপিএলে সাফল্যের পর গোটা পরিবারের দায়িত্ব রিঙ্কুর কাঁধেই।
রবিবারের ম্যাচের পর রিঙ্কুর বাবা জানিয়েছেন, তাঁর ছেলে যা করেছেন, সবটাই নিজের চেষ্টা এবং ইচ্ছাশক্তির জোরে। তিনি এক টাকা দিয়েও ছেলেকে সাহায্য করতে পারেননি। বরং ছোটবেলায় খেলার বদলে পড়াশোনার মন দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন রিঙ্কুকে।
সংবাদ সংস্থা এএনআই-কে রিঙ্কুর বাবা খানচন্দ্র সিংহ জানিয়েছেন, তিনি ছেলেকে ক্রিকেট খেলার জন্য সামান্য ব্যাটটুকুও কিনে দিতে পারেননি। মাঠে রিঙ্কু রান পেতেন, বাহবা কুড়োতেন, কিন্তু তিনি ছেলেকে খেলা ছেড়ে পড়াশোনা করতে বলতেন বার বার। খেলায় কোনও ভবিষ্যৎ নেই বলে মনে করতেন খানচন্দ্র।
রিঙ্কু অবশ্য বাবাকে ভুল প্রমাণিত করেছেন। আইপিএল খেলে তিনি এখন কোটিপতি। পরিবারের খরচ একাই চালান। রিঙ্কুর বাবা চান আগামী দিনে তাঁর ছেলেকে ভারতের জার্সিতে খেলতে দেখতে।
অর্থের অভাব, বাবা পাশে না দাঁড়াতে পারলেও অবশ্য রিঙ্কুর ক্রিকেট খেলা থেমে থাকেনি। তাঁর কোচ তাঁকে ক্রিকেটের যাবতীয় সরঞ্জাম কিনে দিয়েছিলেন। পাশে থেকেছেন বটগাছের মতো।
স্পোটর্সের কোটাতেই নামী বেসরকারি স্কুলে রিঙ্কু পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। যদিও বেশি দূর পড়াশোনা তিনি করতে পারেননি। নবম শ্রেণিতে ফেল করার পর আর পড়াশোনা এগোয়নি। মন দেন বাইশ গজে।
কলকাতা নয়, পঞ্জাবের হাত ধরে আইপিএলে রিঙ্কুর যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু ২০১৭ সালে দলে এলেও প্রথম দিকে বাইশ গজে সুযোগ পেতেন না তিনি। কলকাতার হয়েও রিঙ্কু নিয়মিত ছিলেন না ২০২২ সালের আগে।
আইপিএলের সব ম্যাচে খেলার সুযোগ না পেলেও ঘরোয়া ক্রিকেটে রিঙ্কু কিন্তু একাই একশো। তিনি উত্তরপ্রদেশের হয়ে রঞ্জি খেলেন। ২০১৬ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর হাতেখড়ি হয়েছিল।
২০১৮-১৯ সালের রঞ্জিতে উত্তরপ্রদেশের সর্বোচ্চ রান করা ব্যাটার ছিলেন রিঙ্কু। ৯ ম্যাচ খেলে তাঁর নামের পাশে ছিল ৮০৩ রান। শেষ পর্যন্ত ১০ ম্যাচে ৯৫৩ রান করে টুর্নামেন্ট শেষ করেন রিঙ্কু।
ঘরোয়া ক্রিকেটে রিঙ্কুকে কিন্তু অন্য এক ডাকনামে চেনেন সতীর্থেরা। তাঁকে বলা হয় ‘জুনিয়র রায়না’।
আসলে সুরেশ রায়নার ভক্ত রিঙ্কু। বাঁহাতি ওই ব্যাটারের খেলা দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন বার বার। একটি সাক্ষাৎকারে রিঙ্কু বলেন, ‘‘রায়না ভাই এক বার আমাদের ক্লাবে প্র্যাকটিস করতে এসেছিলেন। আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমাকে নিজের সেরাটা উজাড় করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। রায়নাই আমার আদর্শ।’’
২০১৭ সালে রিঙ্কুকে ১০ লক্ষ টাকায় পঞ্জাব কিনেছিল। পরে কেকেআর তাঁকে কেনে ৮০ লক্ষ টাকায়। বর্তমানে আইপিএলে তাঁর মূল্য ৫৫ লক্ষ টাকা।
৮০ লক্ষ টাকা দর ওঠার পর সাক্ষাৎকারে রিঙ্কু জানিয়েছিলেন, তিনি এত টাকা আশা করেননি। ভেবেছিলেন, ১০ থেকে ২০ লক্ষ টাকায় তাঁর উত্তরণ হবে। আইপিএলের টাকায় পারিবারিক সমস্যা মেটান রিঙ্কু।
দাদার বিয়েতে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করেছেন রিঙ্কু। টাকা জমিয়েছেন বোনের বিয়ের জন্যও। রিঙ্কু নিজেই জানিয়েছিলেন, তাঁর লক্ষ্য একটা ভাল বাড়িতে থাকা।
আইপিএলের অর্থে নিজের বাড়ি করেছেন কেকেআরের রিঙ্কু। কিন্তু সেই বাড়িতে বাবাকে নিয়ে যেতে পারেননি। রিঙ্কুর হাতে টাকা এলেও পুরনো জীবন ছাড়তে চাননি তাঁর বাবা। তিনি এখনও বাড়ি বাড়ি গ্যাস পৌঁছে দিয়ে আসেন। ছেলের টাকায় গড়া বাড়িতে তিনি থাকতে চাননি।
রিঙ্কু জানান, তিনি এক বার চোটে বেজায় কাবু হয়েছিলেন। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছিলেন না। এই সময় তাঁর বাবাও নাকি নাওয়া-খাওয়া ভুলেছিলেন।
রিঙ্কুই পরিবারের একমাত্র সফল রোজগেরে সদস্য। চোটে তাঁর এমন অবস্থা হয়েছিল যে, তাঁর বাবা ভেবেছিলেন, রিঙ্কু হয়তো আর মাঠে নামতে পারবেন না। ২ থেকে ৩ দিন তিনি না খেয়ে ছিলেন। চিন্তায় চিন্তায় তাঁরও শরীর খারাপ হয়ে পড়েছিল।
কঠিন সময় পেরিয়ে রিঙ্কু এখন আইপিএলের ‘হিরো’। তাঁর নামে চার দিকে জয়জয়কার। অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলে রিঙ্কু আবার প্রমাণ করেছেন, ক্রিকেট আসলে অনিশ্চয়তার খেলা। বাইশ গজের লড়াইয়ে কখন যে কী হয়...!